বাংলা ভাষা, সাহিত্য এবং সমাজসংস্কারের ইতিহাসে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন এমন এক আলো, যিনি অন্ধকারাচ্ছন্ন নারী সমাজকে শিক্ষার আলো দেখিয়েছেন। তিনি শুধু একজন প্রগতিশীল লেখক বা নারী অধিকারের কর্মী নন—তিনি ছিলেন এক মহাকাল-বিজয়ী ব্যক্তিত্ব, যিনি পুরো দক্ষিণ এশিয়ার নারী মুক্তি আন্দোলনে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। আজকের আধুনিক নারীবাদী চিন্তা, নারী অধিকার আইন এবং শিক্ষা বিস্তারের অগ্রগতির পেছনে তাঁর নিরব কিন্তু দৃঢ় সংগ্রামের অবদান অপরিসীম।
এই নিবন্ধে আমরা বেগম রোকেয়ার জীবন, শিক্ষা, চিন্তা-চেতনা, সাহিত্যকর্ম এবং নারী আন্দোলনে তাঁর উত্তরাধিকারের বিস্তৃত আলোচনা করবো।
বেগম রোকেয়া কে ছিলেন?
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন (১৮৮০–১৯৩২) ছিলেন বাঙালি মুসলিম সাহিত্যিক, নারী শিক্ষা আন্দোলনের পথিকৃৎ, সমাজসংস্কারক ও নারীবাদী চিন্তার অগ্রদূত। তিনি নারীর অধিকার, শিক্ষা, সামাজিক স্বাধীনতা এবং সমঅধিকারের পক্ষে সংগ্রাম করে গেছেন সারা জীবন। তাঁর জন্ম ও মৃত্যু—দুটি ঘটেই একই দিনে, ৯ ডিসেম্বর, যা আজ বাংলাদেশে “রোকেয়া দিবস” হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হয়।
জন্ম, পরিবার ও শৈশব
রোকেয়ার জন্ম রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে এক অভিজাত মুসলিম পরিবারে। পরিবারের সামাজিক মর্যাদা থাকলেও নারী শিক্ষার বিষয়ে ছিল কঠোর রক্ষণশীলতা। মেয়েদের বাইরে যাওয়া তো দূরের কথা, ঘরে পড়াশোনা করাও তখন অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে ছিল।
তাঁর বড় ভাই ইব্রাহিম সাবের ছিলেন অত্যন্ত প্রগতিশীল মনোভাবের। তিনিই রোকেয়া ও তাঁর বড় বোন করিমুননিসাকে গোপনে বাংলা ও ইংরেজি শিখিয়েছেন। এ শিক্ষা রোকেয়ার চিন্তাজগতকে খুলে দেয় এবং ভবিষ্যতের সংগ্রামের ভিত তৈরি করে।
নারী শিক্ষাবিষয়ক রোকেয়ার সংগ্রাম
১. সমাজের প্রতিকূলতায় দাঁড়িয়ে এগিয়ে যাওয়া
সেই সময়ে মুসলিম সমাজে নারী শিক্ষা প্রায় নিষিদ্ধ ছিল। রোকেয়া বিশ্বাস করতেন — “নারী শিক্ষিত না হলে সমাজের প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়।” এই বিশ্বাস থেকেই তিনি নারী শিক্ষার জন্য আজীবন কাজ করে গেছেন।
২. সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা
স্বামী সাখাওয়াত হোসেনের মৃত্যু পর ১৯১৬ সালে কলকাতার রাজাবাজারে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল। তখন নারীদের বিদ্যালয়ে পাঠানো সামাজিকভাবে লজ্জার বিষয় মনে করা হতো। কিন্তু রোকেয়া অবিচল ছিলেন।
প্রথমে মাত্র আটজন ছাত্রী নিয়ে শুরু হলেও পরবর্তীতে বিদ্যালয়টি মুসলিম মেয়েদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাকেন্দ্রে পরিণত হয়। আজও প্রতিষ্ঠানটি তাঁর স্বপ্নকে ধারণ করে এগিয়ে চলছে।
৩. নারী শিক্ষায় তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি
- নারীর আর্থিক স্বাবলম্বিতা প্রয়োজন
- ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক বিজ্ঞান জানা জরুরি
- পিতৃতান্ত্রিক সমাজকে বদলাতে হবে
- শিক্ষা হতে হবে মুক্ত চিন্তার ভিত্তিতে
সাহিত্যিক জীবন ও প্রধান রচনা
রোকেয়া ছিলেন এক অনন্য প্রতিভার অধিকারী। তিনি লেখালেখির মাধ্যমে নারীর দুরবস্থা, সামাজিক কুসংস্কার, অজ্ঞতা এবং পুরুষতন্ত্রের কঠিন বাস্তবতা তুলে ধরেছেন।
১. সুলতানার স্বপন (1905)
নারীবাদী বিজ্ঞানকল্পকাহিনির প্রথম দিকের অন্যতম সৃষ্টি। এখানে দেখানো হয়েছে এমন একটি সমাজ যেখানে নারীরা শিক্ষিত, বিজ্ঞানমুখী এবং ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে। এটি নারীর সম্ভাবনা ও শক্তির প্রতীক।
২. অবরোধবাসিনী
এই গ্রন্থে তিনি বর্ণনা করেছেন মুসলিম নারীর অবরুদ্ধ জীবন, তাদের কষ্ট, বঞ্চনা ও অমানবিকতা। এটি সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী দলিল।
৩. পদ্মরাগ
এটি একটি শক্তিশালী উপন্যাস যেখানে নারীর আত্মমর্যাদা, স্বাধীনতা এবং মানবিক অধিকারের গল্প ফুটে উঠেছে। এখানে নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
৪. অন্যান্য রচনা
- মতিচূড়
- অয়নাতি
- ছুটি
- শিক্ষা
- নারীর অধিকারবিষয়ক প্রবন্ধসমূহ
সবগুলোতেই রয়েছে তাঁর তীক্ষ্ণ যুক্তি, স্বচ্ছ কণ্ঠস্বর এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি।
রোকেয়ার নারীবাদী দর্শন
বেগম রোকেয়ার নারীবাদ কোনো পশ্চিমা অনুকরণ ছিল না; এটি ছিল তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতা, মুসলিম সমাজের বাস্তবতা এবং মানবিক বোধ থেকে নির্মিত এক প্রগতিশীল আদর্শ। দক্ষিণ এশিয়ার নারীমুক্তি আন্দোলনের সবচেয়ে যুক্তিনির্ভর, সুসংগঠিত ও বাস্তবমুখী নারীবাদী দর্শনের অন্যতম স্রষ্টা ছিলেন তিনি।
১. শিক্ষা—নারী মুক্তির মূল চাবিকাঠি
রোকেয়া দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে সমাজে নারীর অবস্থান বদলাতে হলে তাকে শিক্ষায় শিক্ষিত করতেই হবে। তাঁর মতে—
- নারী অশিক্ষিত হলে পরিবার অশিক্ষিত থাকে
- নারী শিক্ষিত হলে পুরো সমাজ পরিবর্তনের পথ তৈরি হয়
- নারীকে ‘গৃহবন্দি পরাধীনতা’ থেকে মুক্ত করতে চাইলে তার হাতে কলম ধরানো জরুরি
তিনি স্পষ্টভাবে বলেন— “নারীকে বন্দী করে রেখে তোমরা সমাজের অর্ধেক শক্তিকে অকার্যকর করে রাখছ।” শিক্ষাই নারীকে আত্মবিশ্বাসী, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম করে তোলে—এটাই ছিল তাঁর প্রধান দর্শন।
২. মৌলভীবাদী ও কঠোর পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে যুক্তিভিত্তিক অবস্থান
রোকেয়া কখনো ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলেননি; বরং ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা ও পিতৃতান্ত্রিক ব্যবহারের সমালোচনা করেছেন। তাঁর মতে—
- ধর্ম নারীর শত্রু নয়
- নারীর শত্রু হলো অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা
- ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা নারী-পুরুষ উভয়ের উন্নতি চায়
এই যুক্তি-নির্ভর অবস্থান তাঁকে মুসলিম নারীবাদী চিন্তার পথিকৃৎ করেছে।
৩. সমান মর্যাদা—শত্রুতা নয়, অংশীদারিত্ব
রোকেয়ার নারীবাদ পুরুষকে প্রতিপক্ষ করে গড়ে ওঠেনি। তিনি দেখেছেন—পুরুষও শিক্ষার অভাবে বা সামাজিক বাধ্যবাধকতার কারণে ভুল ধারণা বহন করে। তাই তিনি চান—
- নারী ও পুরুষ একসঙ্গে সমাজ উন্নয়নে কাজ করুক
- পরিবারে পারস্পরিক সম্মানের ভিত্তিতে সম্পর্ক গড়ে উঠুক
- সমাজে নারীকে ‘দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক’ ভাবার প্রবণতা দূর হোক
তাঁর দর্শন ছিল harmonious feminism—যা সমতা চায়, বৈরিতা নয়।
৪. পর্দা ও নারী স্বাধীনতা: যুক্তি, ভারসাম্য ও বাস্তবতা
তাঁর সময়ে পর্দা প্রথা নারীকে শিক্ষা, জ্ঞান ও স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করতো। রোকেয়া এই প্রথার অমানবিক দিকগুলো তুলে ধরেছেন, তবে তিনি চরম বিরোধিতাও করেননি।
তিনি বলেছেন—
- পর্দা হতে পারে ‘শালীনতার প্রতীক’
- কিন্তু পর্দা কখনো ‘অজ্ঞতার প্রাচীর’ হওয়া উচিত নয়
তিনি বরাবরই বাস্তবভিত্তিক, মধ্যপন্থী এবং ধর্মীয় মূল্যবোধকে সম্মান করে নারীর স্বাধীনতার দিকটি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন।
৫. অর্থনৈতিক স্বাধীনতা—নারীর শক্তির উৎস
রোকেয়া জানতেন, আর্থিকভাবে নির্ভরশীল নারী কখনোই সম্পূর্ণ স্বাধীন হতে পারে না। তাই তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন—
- কর্মসংস্থান
- আর্থিক স্বাবলম্বিতা
- দক্ষতা উন্নয়ন
- পেশাগত শিক্ষা
তিনি প্রথম দিকেই বলেন—
“নারীকে শুধু ঘর সামলানোর জন্য রেখে দিলে তার প্রতিভা নষ্ট হয়, আর সমাজও তার অর্ধেক শক্তি হারায়।”
৬. নারীর ব্যক্তিত্ব, আত্মসম্মান ও মানবিক অধিকার
রোকেয়ার মতে, নারী কোনো ‘সম্পত্তি’ নয়; সে এক পূর্ণাঙ্গ মানুষ। তাই তিনি জোর দিয়ে বলেন—
- নারীর নিজস্ব মতামত দেওয়ার অধিকার আছে
- নিজের সিদ্ধান্তে জীবন পরিচালনার অধিকার আছে
- শিক্ষিত নারী নিজেকে ও পরিবারকে উন্নত পথে নিতে পারে
তিনি নারীকে শুধু মা, বোন বা স্ত্রী হিসেবে দেখেননি—একজন মানুষ, চিন্তাশীল সত্তা হিসেবে দেখেছেন।
৭. সাহিত্যকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার
রোকেয়ার সাহিত্য আসলে তাঁর নারীবাদী দর্শনের শক্তিশালী অস্ত্র।
‘সুলতানার স্বপন’-এ তিনি দেখান শিক্ষিত নারী সমাজ কেমন পরিবর্তন আনতে পারে।
‘অবরোধবাসিনী’-তে নারীর জীবনযন্ত্রণা তুলে ধরে সমাজের নড়বড়ে ভিত্তিকে প্রশ্ন করেন।
‘পদ্মরাগ’-এ তিনি নারী আশ্রম দেখিয়ে বলেন—নারীরও নিজের নিরাপদ আশ্রয় ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োজন।
তাঁর সাহিত্য তীব্র প্রতিবাদ হলেও ছিল মার্জিত, যুক্তিপূর্ণ ও নান্দনিক।
৮. সততা, যুক্তি ও সামাজিক দায়িত্ব—তাঁর নারীবাদের মূল স্তম্ভ
রোকেয়ার নারীবাদ ছিল—
- শান্ত
- যুক্তিনির্ভর
- বৈজ্ঞানিক চিন্তায় প্রোথিত
- মানবিকতার ভিত্তিতে দাঁড়ানো
- সমাজ পরিবর্তনের জন্য বাস্তবমুখী
তিনি নারী-পুরুষ উভয়েরই মানসিক পরিশুদ্ধতার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন, যা আজও আধুনিক সমাজে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
সামাজিক সংস্কার ও সংগঠনমূলক কার্যক্রম
১. মুসলিম নারী সমাজ গঠন
রোকেয়া “মুসলিম নারী সমাজ” নামের সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল—
- বঞ্চিত নারীদের সাহায্য করা
- শিক্ষার প্রসার করা
- সামাজিক অধিকার রক্ষা
- নারী-পুরুষ সমান মর্যাদার পরিবেশ তৈরি
২. নারী জাগরণে তাঁর অবদান
- কুসংস্কার ভাঙা
- পর্দা প্রথার ভ্রান্ত ব্যাখ্যা তুলে ধরা
- নারীর গৃহবন্দি অবস্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া
- ন্যূনতম অধিকার নিশ্চিত করার দাবি
রোকেয়ার সংগ্রাম এত কঠিন ছিল কেন?
বাংলাদেশ ও ভারতের মুসলিম সমাজ তখন গভীর রক্ষণশীলতায় আচ্ছন্ন ছিল।
- মেয়েদের স্কুলে পাঠানো ‘পাপ’ মনে করা হতো
- পর্দা প্রথা নারীদের স্বাধীনতা কেড়ে নিত
- নারীর মত প্রকাশের সুযোগ ছিল না
- শিক্ষিত নারীকে সমাজ ‘অশোভন’ ভাবত
এই পরিবেশে দাঁড়িয়ে তিনি যে বৃহত্তর পরিবর্তন আনতে পেরেছেন, তা তাঁর দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি ও সাহসের-বিরল উদাহরণ।
শেষ দিনগুলো ও মৃত্যু
১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর, নিজের জন্মদিনেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগের রাতেও তিনি নারীদের নিয়ে অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছেন—এটাই তাঁর নারীমুক্তির প্রতি অশেষ ভালোবাসার প্রমাণ।
বেগম রোকেয়ার উত্তরাধিকার
আজ বাংলাদেশে এবং ভারত উপমহাদেশে নারী শিক্ষা, নারী অধিকার আন্দোলন এবং নারীবাদে তাঁর প্রভাব গভীর।
তাঁর রেখে যাওয়া স্থায়ী অবদান
- নারী শিক্ষার ভিত্তি স্থাপন
- নারী অধিকারের বুদ্ধিবৃত্তিক কাঠামো তৈরি
- সাহিত্য ও সমাজবিজ্ঞানকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দেওয়া
- মুসলিম নারী সমাজকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলা
এছাড়া বাংলাদেশে প্রতি বছর ৯ ডিসেম্বর তাঁর স্মরণে “রোকেয়া দিবস” পালন করা হয় এবং সরকারিভাবে “রোকেয়া পদক” প্রদান করা হয়।
উপসংহার
বেগম রোকেয়া শুধু একজন লেখক বা শিক্ষাবিদ ছিলেন না; তিনি ছিলেন এক বিপ্লব। তাঁর লেখনী, শিক্ষা আন্দোলন এবং সমাজ সংস্কারের প্রচেষ্টা আজও আমাদের শিখিয়ে যায়—সমাজকে বদলাতে চাইলে প্রথমে চাই শিক্ষা, সচেতনতা ও সাহস।
নারীর ক্ষমতায়ন, স্বাধীন চিন্তা ও সমঅধিকারের পথ তিনি দেখিয়েছেন বহু আগেই। আধুনিক সমাজে নারীর অগ্রগতির যাত্রাপথে তাঁর ভূমিকা চিরকালই শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয় থাকবে।







