তারবিহীন বিদ্যুৎ পরিবহন (Wireless Power Transmission – WPT) প্রযুক্তি বহু দশক ধরে বিজ্ঞানীদের স্বপ্ন ছিল, যা নিকোলা টেসলার যুগান্তকারী কাজের মাধ্যমে প্রথম আলোর মুখ দেখে। কিন্তু সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে যে প্রকৌশলগত চ্যালেঞ্জগুলো ছিল, তা অতিক্রম করতে অনেক সময় লেগেছে।
সম্প্রতি, মার্কিন প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডার্পা (DARPA – Defense Advanced Research Projects Agency) তাদের পার্সিস্টেন্ট অপটিক্যাল ওয়্যারলেস এনার্জি রিলে (Persistent Optical Wireless Energy Relay – POWER) প্রোগ্রামের মাধ্যমে তারবিহীন বিদ্যুৎ পরিবহনে এক অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে, যা এই প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে।
ডার্পার সাম্প্রতিক সাফল্য:
লেজারের মাধ্যমে ৮০০ ওয়াট বিদ্যুৎ ৮.৬ কিলোমিটার দূরে!
ডার্পার POWER প্রোগ্রামের অধীনে সাম্প্রতিক পরীক্ষাগুলো তারবিহীন বিদ্যুৎ পরিবহনে একটি নতুন বিশ্ব রেকর্ড স্থাপন করেছে। নিউ মেক্সিকোতে পরিচালিত এই পরীক্ষাগুলোতে একটি লেজার ব্যবহার করে ৮০০ ওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ প্রায় ৫.৩ মাইল (৮.৬ কিলোমিটার) দূরত্বে সফলভাবে প্রেরণ করা হয়েছে এবং ৩০ সেকেন্ড ধরে তা বজায় রাখা গেছে।
এটি পূর্বের সকল রেকর্ডকে ছাপিয়ে গেছে, যেখানে তুলনামূলকভাবে কম শক্তি (২৩০ ওয়াট) কম দূরত্বে (১.৭ কিলোমিটার) প্রেরণ করা হয়েছিল। এই সফলতার মাধ্যমে ডার্পা প্রমাণ করেছে যে, উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বিদ্যুৎ শক্তি তারবিহীনভাবে দীর্ঘ দূরত্বে প্রেরণ করা কেবল কল্পনা নয়, বরং বাস্তব।
এই পরীক্ষার মূল চাবিকাঠি ছিল পাওয়ার রিসিভার অ্যারে ডেমো (Power Receiver Array Demo – PRAD) নামের একটি বিশেষ রিসিভার প্রযুক্তি। এই রিসিভারে একটি ছোট অ্যাপারচারের (ছিদ্র) মাধ্যমে লেজার রশ্মি প্রবেশ করে এবং একটি প্যারাবলিক আয়নায় প্রতিফলিত হয়ে বহু সংখ্যক ফটোভোল্টেইক সেলে ছড়িয়ে পড়ে।
এই ফটোভোল্টেইক সেলগুলো লেজার আলোকে আবার ব্যবহারযোগ্য বিদ্যুতে রূপান্তরিত করে। যদিও বর্তমান ব্যবস্থায় লেজার আউটপুট থেকে রিসিভারে বৈদ্যুতিক শক্তিতে রূপান্তরের দক্ষতা প্রায় ২০% এর মতো, তবে এটি এখনও প্রাথমিক পর্যায় এবং ভবিষ্যতে এর দক্ষতা আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
ডার্পার POWER প্রোগ্রাম এবং এর লক্ষ্য
ডার্পার POWER প্রোগ্রামের মূল লক্ষ্য হলো এমন একটি প্রযুক্তি তৈরি করা যা “পাওয়ার ওয়েব” বা বিদ্যুতের একটি তারবিহীন নেটওয়ার্ক তৈরি করতে পারে, যেখানে বিদ্যুৎ শক্তি চাহিদা অনুযায়ী বিশাল এলাকা জুড়ে অবকাঠামো ছাড়াই সরবরাহ করা যেতে পারে।
এই প্রযুক্তির প্রাথমিক লক্ষ্য সামরিক এবং প্রতিরক্ষা খাতের চাহিদা পূরণ করা, যেখানে দূরবর্তী বা প্রতিকূল পরিবেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা অত্যন্ত কঠিন এবং ঝুঁকিপূর্ণ।

এই প্রোগ্রামের তিনটি পর্যায় রয়েছে:
- প্রথম পর্যায় (বর্তমান): এএই পর্যায়ে, রূপান্তর প্রক্রিয়ার সময় রশ্মি নির্দেশিকার নির্ভুলতা বৃদ্ধি, তরঙ্গফ্রন্ট সংশোধন উন্নত করা এবং শক্তি অপচয় কমানোর উপর জোর দেওয়া হচ্ছে।
- পরবর্তী পর্যায়: এই পর্যায়ে সিস্টেমটিকে আরও স্কেল আপ করা হবে এবং এয়ারবোর্ন প্ল্যাটফর্মগুলোতে (যেমন ড্রোন) এই প্রযুক্তি একীভূত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
- চূড়ান্ত লক্ষ্য: ডার্পার চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো, এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি দূরবর্তী স্থল উৎস থেকে ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত দূরত্বে ১০ কিলোওয়াট অপটিক্যাল শক্তি সরবরাহ করা। এর অর্থ হলো, সামরিক ড্রোন বা অন্যান্য সরঞ্জাম দীর্ঘ সময় ধরে বা অনির্দিষ্টকালের জন্য উড়তে পারবে, যা সামরিক অভিযানগুলোতে নতুন সক্ষমতা যোগ করবে।
তারবিহীন বিদ্যুৎ পরিবহনের প্রযুক্তিগত ভিত্তি এবং সামরিক প্রয়োগ
ডার্পার এই সফলতার পেছনে রয়েছে লেজার-ভিত্তিক বিদ্যুৎ পরিবহন (Laser Power Transmission) প্রযুক্তি। এই পদ্ধতিতে বিদ্যুৎকে লেজার আলোতে রূপান্তরিত করে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে প্রেরণ করা হয়। গ্রাহক প্রান্তে ফটোভোল্টেইক সেলগুলো লেজার আলোকে পুনরায় বিদ্যুতে রূপান্তরিত করে।
সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই প্রযুক্তির সম্ভাবনা বিশাল:
- ড্রোন এবং ইউএভি (UAV) এর জন্য অনন্তকাল চার্জিং: যুদ্ধক্ষেত্রে বা নজরদারির জন্য ব্যবহৃত ড্রোনগুলো তারবিহীনভাবে চার্জ গ্রহণ করে দীর্ঘ সময় ধরে আকাশে থাকতে পারবে, যা তাদের অভিযানের পরিসর এবং কার্যকারিতা বৃদ্ধি করবে।
- দূরবর্তী সামরিক ঘাঁটিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ: দুর্গম বা ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় সামরিক ঘাঁটিতে তারবিহীনভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাবে, যা জ্বালানি সরবরাহের ঝুঁকি এবং খরচ কমাবে।
- প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় জরুরি বিদ্যুৎ: দুর্যোগ-কবলিত এলাকায় যেখানে বিদ্যুৎ অবকাঠামো ভেঙে পড়েছে, সেখানে দ্রুত তারবিহীনভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
- সেন্সর এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা: দূরবর্তী সেন্সর এবং যোগাযোগ কেন্দ্রগুলো তারবিহীনভাবে বিদ্যুৎ পেয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করতে পারবে।
চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যতের পথ
ডার্পার এই সাফল্য নিঃসন্দেহে একটি বিশাল অর্জন, তবে এর ব্যাপক বাণিজ্যিকীকরণ এবং সামরিক প্রয়োগের পথে এখনো কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে:
- দক্ষতা (Efficiency): বর্তমানে, লেজার-ভিত্তিক সিস্টেমের দক্ষতা তুলনামূলকভাবে কম। এটিকে আরও বৃদ্ধি করা প্রয়োজন যাতে বিদ্যুতের অপচয় কমানো যায়।
- নিরাপত্তা: উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন লেজার রশ্মি মানুষের স্বাস্থ্য বা পরিবেশের জন্য সম্ভাব্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। এই বিষয়ে ব্যাপক গবেষণা এবং নিরাপত্তা প্রোটোকল তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি।
- বায়ুমণ্ডলীয় প্রভাব: বৃষ্টি, কুয়াশা বা ধোঁয়ার মতো বায়ুমণ্ডলীয় অবস্থা লেজার রশ্মির পরিবহনকে প্রভাবিত করতে পারে। এই বাধাগুলো কাটিয়ে ওঠার জন্য উন্নত প্রযুক্তি প্রয়োজন।
- লক্ষ্য নির্ভুলতা: দীর্ঘ দূরত্বে লেজার রশ্মিকে নিখুঁতভাবে লক্ষ্যবস্তুতে ফোকাস করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
তবে, ডার্পা এবং অন্যান্য গবেষণা সংস্থাগুলো এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় কাজ করছে। আশা করা যায়, আগামী দিনগুলোতে এই প্রযুক্তির দক্ষতা বাড়বে, নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নত হবে এবং এর প্রয়োগ আরও ব্যাপক হবে। ডার্পার এই সাফল্য তারবিহীন বিদ্যুৎ পরিবহনের ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের সূচনা করেছে, যা কেবল সামরিক ক্ষেত্রে নয়, বরং আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে।
রেফারেন্স
ডার্পার এই সাম্প্রতিক সাফল্য এবং POWER প্রোগ্রাম সম্পর্কিত সকল তথ্যের জন্য নিম্নোক্ত তথ্যসূত্রগুলো ব্যবহার করা হয়েছে:
- Switchgear Magazine: DARPA sets new records for sending power wirelessly
- The Register: DARPA sets energy beaming distance, power record
- New Atlas: DARPA sets new records for sending power wirelessly
- Sound & Video Contractor: DARPA breaks record for wireless power transmission
- Photonics Spectra: DARPA Program Sets Distance Record for Power Beaming
- Human Progress: DARPA Tops Wireless Power Record, Beams Energy Five Miles
- Techno-Science: US military smashes wireless power transmission record
- Engineering.com: DARPA To Develop Wireless Power Beaming Technology
এই সাফল্যের বিস্তারিত তথ্য উপরোক্ত প্রকাশনাগুলিতে পাওয়া যাবে।







