কোন জীবিত বস্তু তা প্রানী বা উদ্ভিদ যাই হোক না কেন, একবার বিলুপ্ত হয়ে যাবার পর পুনরায় তাকে জীবন্ত করে পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে আসাকে অব-বিলুপ্তিকরন বা De-extinction বলে থাকি। বেশ কিছু প্রানী এবং উদ্ভিদের ক্ষেত্রে এটা ইতোমধ্যেই মধ্যেই সম্ভব হয়েছে, এবং সাম্প্রতিককালে ডায়ার উলফ (Dier Wolf) নিয়ে এধরনের একটা উদাহরণ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
Dier wolf প্রায় ১২,৫০০ বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া একটা জন্তু। ফসিল থেকে DNA সংগ্রহ করে সেটা তার নিকটাত্মীয় Gray wolf এর ভিতর প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে। Collossal Bioscience এই গবেষণা প্রকল্প পরিচালনা করে এবং তিনটা বাচ্চা নেকড়ে রোমুলাস, রেমাস এবং খালেসি জন্ম নিয়েছে। কেউ কেউ যদিও বলছেন, এগুলো হয়ত জেনেটিক্যালি মডিফায়েড গ্রে উলফ সত্যিকার অর্থে ডি-এক্সটিঙ্কট ডায়ার উলফ নয়। কিন্তু বৈজ্ঞানিকেরা বুঝে ফেলেছেন এই ধরনের গবেষণা সম্ভব। বৈজ্ঞানিকেরা চেষ্টা করছেন আবার লোমশ বা Wooly mammoth, অথবা Passenger pigeon কে ফেরত আনার।
এ পর্যন্ত জন্ম নেওয়া প্রানী এবং উদ্ভিদের প্রায় ৯৯% ধ্বংস হয়ে গেছে কালের গহ্বরে, এখন যারা আছে, তারাও ধ্বংস হয়ে যাবে সময়মত, আবার নতুন প্রানী বা উদ্ভিদের জন্ম হবে পৃথিবীর কলেবর বৃদ্ধির জন্য, এটাই জীবনের নিয়ম। একটা সাধারন হিসাবে দেখা যায় পৃথিবীতে কোন প্রানী বা উদ্ভিদই ১ লক্ষ বছরের বেশী টিকে থাকেনি। তাহলে, প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরে গিয়ে কেন এই প্রচেষ্টা।
বিজ্ঞানের এই জয় করার মানসিকতা, আবার কোন বিপদ বয়ে নিয়ে না আসে, আবার উপকারও তো হতে পারে, আমরা এখনও জানিনা। ডি-এক্সটিঙ্কশনের বেশ কয়েকটি পদ্ধতি আছে আমরা তা নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করবো।
১) ক্লোনিং
উপযুক্তভাবে সংরক্ষিত পুরাতন কোষের নিউক্লিয়াস ঐ জাতীয় অন্য একটি কোষের নিউক্লিয়াস বের করে ফেলার পর সেখানে সংস্থাপিত করলে যে নতুন কোষ তৈরি হয় তার থেকে নতুন প্রানী তৈরি করা হয়। জীবন্ত কোন প্রানী যদি বিলুপ্ত হওয়ার মুখমুখি হয়, তবে ঐ প্রানীর যে কোন সদস্য, সে পুরুষ বা মহিলা যেই হোক না কেন, সেখান থেকে কোষ সংগ্রহ করে, সেই কোষের নিউক্লিয়াস কাছাকাছি প্রানীর কোষে প্রতিস্থাপিত করে ঐ প্রানীর জরায়ুতে স্থাপন করা হয়, পরে বাচ্চা জন্মালে সেই শাবকটি হারিয়ে যাওয়া ঐ প্রানীটিকে টিকিয়ে রাখতে পারে।

ক্লোনিং এর প্রকারভেদ রয়েছে, এবং সম্পুর্ন নিউক্লিয়াস না নিয়ে DNA এর অংশবিশেষ নিয়ে সেটার অনেকগুলো কপি তৈরি করে Reproductive অথবা Therapeutic cloning করা যায়। অনেক সময় কোনভাবে সংরক্ষিত দেহ কোষ, জনন কোষ অথবা স্টেম সেল বা মূল কোষ ইত্যাদি পাওয়া যায়, এগুলো থেকেও ক্লোনিং, আই ভিএফ এর মাধ্যমে নতুন কোষ , ভ্রূণ, বা বাচ্চা তৈরি করা যায়।
ক্লোনিং এর প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে সেই ১৯৫০ সাল থেকেই। ১৯৯০ সালে জন্ম নেওয়া ভেড়া ডলির কথা আমরা সবাই জানি। ক্লোনিং এর অসুবিধা হচ্ছে দান করা কোষটা যে বয়সের থাকে, জন্ম নেওয়া শাবকটার কোষের বয়সটাও ঐ একই বয়সের থাকে, ফলে শাবকটা তাড়াতাড়ি বৃদ্ধ হয়ে যায়।
২) জীনোম এডিটিং
অনেক সময় ক্লোনিং করার জন্য জীবন্ত কোষ পাওয়া সম্ভব হয় না, সেখানে জীন এডিটিং পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। CRISPR- CAS9 (Clustered Regularly Interspaced Short Palindromic Repeat) এখানে কার্য কর। ভাইরাসের আক্রমন থেকে বাঁচার জন্য ব্যাক্টেরিয়া এগুলো অহরহই ব্যবহার করে থাকে। বৈজ্ঞানিকেরা সেখান থেকেই এই CRISPR- CAS 9 সিস্টেমের সন্ধান পেয়েছেন।
এই সিস্টেমের মাধ্যমে আমরা DNA এর অংশবিশেষ অন্য ক্রোমোজমের ভিতর ঢুকিয়ে দিতে পারি, নতুন ক্রোমোজমটি সেই পুর্বপুরুষের গুনাগুন প্রকাশ করবে। এইভাবে আমরা হারিয়ে যাওয়া প্রানী বা উদ্ভিদের কোন অংশ পেলেই সেখান থেকে DNA সংগ্রহ করে, তাকে পরিশোধিত করে ব্যবহার করে হারিয়ে যাওয়া স্পেসিস্টাকে (Species) পুনরুদ্ধার করতে পারি।
CRISPR-CAS9 সিস্টেম ছাড়াও আরও নানারকম সিস্টেমের মাধ্যমে জীন এডিটিং করা সম্ভব। এদের মধ্যে মেগানিউক্লিয়েজর (Meganuclease), Zinc finger endonuclese, TALEN, Base Editing, MAGE Editing, Hybrid Meganuclease ইত্যাদি গুরুত্বপুর্ন। ইতোমধ্যেই বিভিন্ন তামাকের ভাইরাস, ইঁদুরের কোষের উপর, মানুষের কিছু কোষের উপর এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছে।

জীন এডিটিং নিয়ে নানারকম প্রতিবন্ধকতা প্রথম থেকেই আছে , সেই ১৯৯০ সাল থেকে শুরু হওয়া বিতর্ক এখনও চলছে। বিশেষ করে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ানোর ক্ষেত্রে এর ভুমিকা, জীবাণু অস্ত্র তৈরিতে এর ভূমিকা খারাপ হাতে পড়লে ভয়ানক বিপর্যয় বয়ে নিয়ে আসতে পারে।
৩) সিলেক্টিভ ব্রিডিং
সহজভাবে বুঝাতে গেলে একটা উদাহরন দিয়ে বুঝাতে হবে। ধরুন, আপনি জানেন অতীতকালে গরুর তিনটি শিং ছিল। বিভিন্ন ফসিল থেকে এরকম একটা চিত্র আপনি পেয়েছেন। এখনকার কোন গরুরই তিনটা শিং নাই। কিন্তু আপনি বেশ কিছু গরু পরীক্ষা করে দেখলেন কিছু গরুর মাথার মাঝখানে শিঙয়ের এর মত একটা কিছু রয়েছে।
এরকম একটা পুরুষ গরু এবং একটা মেয়ে গরুকে নিয়ে বেশ কয়েকটি বাছুর তৈরি করলেন, দেখা গেল এদের মধ্যে দুইটার ভিতর একটু বড় তৃতীয় শিং গজিয়েছে, এরকম দুইজনকে আবার ক্রস-বৃডিং করালেন, একসময় তিন শিং-ওয়ালা গরু পেয়ে যাবেন। এটা বেশ পুরোনো পদ্ধতি এবং আমাদের কৃষিজীবি সমাজে বেশ কিছুকাল ধরেই তা প্রচলিত আছে। মেন্ডেলের সুত্রানুযায়ী এই ধরনের বংশবৃদ্ধি হতে থাকে।

সমালোচনা
বিলুপ্ত প্রানী বা উদ্ভিদকে ফিরিয়ে আনলে তা বর্তমান ইকোসিস্টেমের উপর কি প্রভাব বয়ে আনবে তা এখনও অজানা। যে যে কারনে তা এক্সটিঙ্কট হয়ে গেছে তা তো এখনও রয়ে গেছে। তাছাড়া সর্বগ্রাসী মানবসমাজ তো রয়ে গেছেই, তারা আবার এদের ধ্বংস করে ফেলবে।
নতুন ভাইরাস, ক্যান্সার, জীবানু অস্ত্র ইত্যাদি সৃষ্টি করতে পারে এগুলো। একসময় হয়তো তা স্পেসিস পরিবর্তনের উদ্দীপনা জোগাবে। মানুষ তার ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে উঠতে চায়, আমরা জানিনা এর শেষ কোথায়। তবে মানুষের ত্রুটি-বিচ্যুতি সারাতে এসব প্রযুক্তি যে কাজে লাগবে তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।