খুব বেশি দিন আগের কথা নয় যখন মহাকাশ পর্যটন শিল্পকে কেবলমাত্র কল্পকাহিনী হিসাবে ভাবা হতো। সময়ের পরিক্রমায় এই কাল্পনিক শিল্পটি বাস্তবে রুপ নিতে চলেছে। মহাকাশ ভ্রমণে আগ্রহ থাকবে সকলের এটাই স্বাভাবিক, আর এই আগ্রহকে পুঁজি করেই বাড়ছে বেসরকারী উদ্যোগে মহাকাশ পর্যটন শিল্প।
মহাকাশ পর্যটন ব্যবসাকে আরো আকর্ষনীয় করে তুলতে তৈর হচেছ পরবর্তী প্রজন্মের বিলাসবহুল মহাকাশযান। যুক্ত হচ্ছে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। আসুন এই প্রতিযোগিতায় কারা বা কোন কোন প্রতিষ্ঠান রয়েছেে একটু জেনে নেওয়া যাক।
মাহাকাশ পর্যটন বিকাশে কাজ করছে যারা
ইতোমধ্যে বেসরকারি উদ্যোগে মহাকাশযান স্পেসএক্স নাসার দুই মহাকাশচারীকে নিয়ে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (ISS) থেকে ঘুরে নিরাপদেই পৃথিবীতে ফিরে এসেছে। সেই সাথে সাথে ভার্জিন গ্যালাক্টিকও মহাকাশ পর্যটন নিয়ে অনেটা এগিয়েছে, হয়ত খুব তাড়াতরিই তারা স্পেসে পর্যটক পাঠাবে।
তবে সব মিলিয়ে ধরে নেওয়া যায় মহাকাশ পর্যটন শুরু হতে আর খুব একটা বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবেনা। মহাকাশ পর্যটনের এই উদ্যোগকে বাস্তবে রুপ দিতে যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের জন্য প্রতিযোগিতা করছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্যঃ
- ভার্জিন গ্যালাকটিক (Virgin Galactic)
- স্পেসএক্স (SpaceX)
- ব্লু অরিজিন (Blue Origin)
ভার্জিন গ্যালাকটিক (Virgin Galactic)
২০০৯ সালের মধ্যে মহাকাশে যাত্রী পরিবহনের লক্ষ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি ২০০৪ সালে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু নানা জটিলতায় শুধু সময় পিছিয়েছে। ব্রিটিশ শিল্পপতি রিচার্ড ব্রনসনের ‘স্পেসশিপ’ সংস্থা ভার্জিন গ্যালাকটিক (Virgin Galactic) আশা করছেন এ বছরের শেষে পর্যটকদের প্রথম দল নিয়ে যাত্রা শুরু করতে পারবেন এবং এটাই হবে পৃথবীর ইতিহাসে প্রথম মাহাকাশ পর্যটন।
ভার্জিন গ্যালাকটিকের অন্যতম লক্ষ্য বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মহাকাশে পর্যটক নিয়ে যাওয়া আর সেই জন্য পর্যটক টানার নানা উদ্যোগ ইতোমধ্যে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। সম্প্রতি তাদের নতুন মহাকাশযান ভিএসএস ইউনিটি উদ্বোধন করেছে এবং প্রকাশ করেছে মহাকাশ যানটিতে যাত্রীদের বসার কেবিনের নকশা।
সংস্থাটি মনে করছে মহাকাশযানের এই কেবিনটিই হতে চলেছে পর্যটক টানার মূল আকর্ষণ। ভার্জিন গ্যালাক্টিকের অত্যন্ত বিলাসবহুল কেবিনটিতে ৬ জন যাত্রী এবং দুজন ক্রু বসতে পারবেন।
পৃথিবী থেকে ৬৮ মাইল উচ্চতায় পৌঁছে মহাকাশের একেবারে প্রান্তে ভ্রমণ করার সুযোগ পাবেন পর্যটরকরা আর এই যাত্রায় প্রতিটি টিকিটের দাম ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার। কোম্পানির তথ্য মতে, ইতোমধ্যে প্রায় ৬০০ যাত্রী টিকিট সংগ্রহ করেছেন এবং বুকিং দিয়ে রেখেছেন আরও ৪০০ জন।
স্পেস এক্স (SpaceX)
Space Exploration Technologies Corp. (SpaceX), স্পেস এক্স নামে পরিচিত আমেরিকান মহাকাশযান প্রস্তুতকারক একটি সংস্থা। স্পেস এক্স পৃথিবীর ভেতর একমাত্র প্রতিষ্ঠান যারা খুবই কম খরচে রকেট তৈরি করে মহাকাশে স্পেসক্রাফ্ট পাঠিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
মঙ্গল গ্রহে মানুষের বসবাসের স্বপ্ন নিয়ে এবং মহাকাশে ভ্রমন আরো সহজ করতে পেপাল এবং টেসলার প্রতিষ্ঠাতা ইলন মাস্ক ২০০২ সালে কোম্পানিটি স্থাপন করেন। বর্তমানে তাদের HUMAN SPACEFLIGHT প্রজেক্টের অধীনে মিশন আর্থ অরবিট, মিশন স্পেস স্টেশন, এবং মিশন মুন নামের তিনটি প্যাকেজ রয়েছে।
বানিজ্যিক কাজে নানাসময়ে রকেট পাঠিয়ে আসছে প্রতিষ্ঠানটি, তাদের তৈরি ফ্যালকন এবং ড্রাগন নামের মহাকাশযান বর্তমানে পৃথিবীর কক্ষপথে পেলোড ডেলিভার করছে। বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ কে মহাকাশের কক্ষপথে পাঠাতেও ব্যবহার করা হয়েছিলো স্পেসএক্স এর রকেট ফ্যালকন-৯।
ইতোমধ্যে নাসার দুই মহাকাশচারীকে নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরিয়ে এনেছে স্পেসএক্স রকেট যা কোন বেসরকারী প্রতিষ্ঠান থেকে পরিচালিত প্রথম মিশন। ২০১১ সালে স্পেস শাটল বাতিল ঘোষণার পর থেকে প্রায় ১০ বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ভরসা করতে হয়েছে রাশিয়ার ওপর। চড়া দামে রুশ মহাকাশযান সয়ুজ-এ আসন ভাড়া করে আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রে নভোচারী পাঠাত নাসা।
এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে বেসরকারি সংস্থা স্পেস এক্সের সঙ্গে চুক্তি করে নাসা। চুক্তি অনুযায়ী স্পেস এক্স নাসার দুই মহাকাশচারীকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মাটি থেকে উড্ডয়ন করে আন্তর্জকিত মহাকাশ স্টেশন হয়ে প্রায় দুমাস পরে আবার পৃথিবীতে সফলভাবে অবতরন করে।
অত্যাধুনিক এই মহাকাশযানটি সয়ংক্রীয়ভাবে উৎক্ষেপন ও অবতরণ করতে পারে। দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্যও যানটিতে রয়েছে বিশেষ প্রযুক্তি।
ব্লু অরিজিন (Blue Origin)
ব্লু অরিজিনের (Blue Origin) পরীক্ষামূলক উড্ডয়ন ইতোমধ্যে সম্পন্ন করেছে। ধারণা করা হচ্ছে জেফ বিজোসের ব্যক্তি মালিকানাধীন এই প্রতিষ্ঠানটি খুব শিগগিরই বাণিজ্যিকভাবে মহাকাশ যান চালু করতে যাচেছ।
পরীক্ষামূলক উড্ডয়নে নিউ শেফার্ড নামে ব্লু অরিজিনের রকেটটি মার্কিন মহাকাশ সংস্থা ‘নাসা’র গবেষণা সংক্রান্ত কিছু কাজেও ইতোমধ্যে সহযোগিতা করেছে। সংস্থাটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, ৬ জন আরোহী ধারনক্ষমতা সম্পন্ন ক্যাপসুলটি পৃথিবী থেকে ৩ লাখ ৫০ হাজার ফিট বা ৬৬ মাইল ওপরে রকেট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়।
আগামী উড্ডয়নগুলোতে এই ক্যাপসুলে চড়ে পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারবেন মহাকাশ পর্যটকরা। এর আগে নিউ শেফার্ড নামে রকেটটি আরও ৫ বার পরিক্ষামুলকভাবে আকাশে উড়েছে।
মহাকাশ পর্যটন খরচ
মহাকাশ পর্যটনের ক্ষেত্রে খরচের বিষয়টি আগে বিবেচ্য আর এ কারনেই আপাতত ধনী যারা তদেরই নাগালের মধ্যে থাকছে এই শিল্পটি। মাহাকাশ পর্যটনের ক্ষেত্রে ব্যক্তি প্রতি খরচ নির্ভর করে পর্যটনের স্থান এবং কোম্পানির প্রযুক্তিগত সামর্থ্যের উপর। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ভার্জিন গ্যালাকটিক এবং স্পেসএক্স এর মধ্যেকার খরচের তুলনা।
ভার্জিন গ্যালাকটিক এবং স্পেসএক্স উভয়ই পূর্ব ঘোষনা অনুযায়ী হয়তো খুব কম সময়ের মধ্যেই মহাকাশে পযটক নিয়ে যাত্রা করবে। এখানে ফেডারাল এভিয়েশন প্রশাসনের সংজ্ঞা অনুসারে যাত্রীদের খরচের ক্ষেত্রে ভার্জিন গ্যালাকটিকের তুলনায় এলন মাস্কের স্পেস এক্সের খরচ পড়বে ২০০ গুণ বেশি।
রাশিয়ার প্রতিষ্ঠান সয়ুজ স্পেসফ্লাইটের জন্য ব্যক্তিগত অভিযাত্রীদের খরচ করতে হবে কয়েক মিলিয়ন ডলার। মার্কিন মহাকাশ সংস্থাও পর্যটক পাঠানোর পরিকল্পনা করেছে এবং তার জন্য তারা তারা স্পেসএক্স এবং বোয়িং এর সঙ্গে চুক্তি করেছে।
মাহাকশ পর্যটনের ভবিষ্যৎ
শুধু মহাকাশ পর্যটনই না পৃথিবীরই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় দ্রুত পৗছানোর জন্য জন্য পৃথিবীর কক্ষপথ ব্যবহারেরও পরিকল্পনা চলছে। স্পেসএক্স একটি ফ্লাইটের পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে যেখানে তারা দেখিয়েছে নিউ ইয়র্ক থেকে সাংহায় পৌছানো যাবে মাত্র ৪০ মিনিটে।
এক্ষেত্রে তারা ব্যবহার করবে স্পেস ফ্লাইট প্রযুক্তি, যেখানে একটি স্পেসশীপ পৃথিবীর নীচু কক্ষপথকে ব্যবহার করে দ্রুত যেকোন গন্তব্যে পৌঁছে যাবে। সুইস ব্যাংক ইউবিএস এর তথ্য মতে, আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ মহাকাশ পর্যটন হবে প্রায় দু হাজার কোটি ডলারের ব্যবসা।