হাজার বছর আগে থাইরয়েড সমস্যা এবং এর চিকিৎসার প্রমান পাওয়া গেলেও এই গ্রন্থির নামকরণ ও বর্ণনা পাওয়া যায় রেনেসাঁ যুগের পরের সময় অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ২৭০০ তে। চীনে সামুদ্রিক শৈবাল ও পোড়া স্পঞ্জ ব্যবহার করে গলগন্ড রোগের চিকিৎসা করা হতো ১৬০০ খ্রিস্টপূর্ব সময়ে যা পরে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও প্রচলিত হয়। হাইপারথাইরয়েডিজম (Hypothyroidism), হাইপোথাইরয়েডিজম (hypothyroidism) ও গলগন্ড (Goiter) রোগের বর্ণনা পাওয়া যায় ১৪০০ খ্রিস্টপূর্ব সময়ের আয়ুর্বেদের বই শুশ্রত সমহিতা তে। আর চার শতকের দিকে হিপোক্রেটস ও প্লেটো থাইরয়েড গ্রন্থিকে বর্ণনা করেন লালাগ্রন্থি হিসেবে।
থাইরয়েড গ্রন্থি কি এবং এর কাজ কি?
থাইরয়েড (Thyroid) একটি অন্তঃস্রাবী গ্রন্থি (Endocrine gland) আমাদের গলার ঠিক শ্বাসনালীর সামনে থেকে দুই পাশে অবস্থিত যা দেখতে অনেকটা প্রজাপতির মত। এটা এমন একটি গ্রন্থি যেখান থেকে হরমোন তৈরি হয়ে রক্তের মাধ্যমে শরীরে ছড়িয়ে পড়ে এবং তা শরীরের বিভিন্ন কার্যক্রমকে প্রভাবিত করে।
থাইরয়েড গ্লান্ড বা গ্রন্থির ওজন প্রায় ২৫ গ্রাম গ্রন্থি থেকে আমাদের শরীরের ট্রাইডোথাইরোনাইন (T3) ও থাইরক্সিন (T4), এবং ক্যালসিটোনিন (Calcitonin) হরমোন তৈরি হয়। এবং থাইরয়েডের সাথেই লাগানো আরো একটি গ্রন্থি থাকে যার নাম প্যারাথাইরয়েড গ্লান্ড, এই গ্লান্ড থেকে তৈরি হয় প্যারাথাইরয়েড (PTH) হরমোন।
থাইরয়েড হরমোনের কাজ কি?
থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে যেসব হরমোন নিঃসৃত হয়, তা আমাদের বিভিন্ন শরীরবৃত্তিও কাজগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে, এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছেঃ
- শরীরের বিপাকীয় (কার্বহাইড্রেট এবং প্রোটিন মেটাবলিজমে) প্রক্রিয়া।
- শরীরের তাপ উৎপন্ন করা।
- হাড়ের ক্ষয় প্রতিরোধ করা।
- রক্তে চর্বির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা
থাইরয়েড গ্রন্থি বড় হওয়া মানেই কি ক্যান্সার?
থাইরয়েড গ্রন্থি সাধারণত চোখে দেখা যায় না তবে কোন কোন সময় থাইরয়েড সমস্যা দেখা দিলে গ্ল্যান্ড ফুলে উঠলে এটা দৃশ্যমান হতে পরে তখন এটাকে আমরা বলি গলগন্ড। গলগন্ড বিভিন্ন কারণে হতে পারে তার মধ্যে অন্যতম আয়োডিনের অভাব। আবার কারো কারো ক্ষেত্রে বয়সন্ধিকালে এ গ্রন্থটি ফুলে উঠতে পারে যা বয়স বাড়ার সাথে সাথে আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়। যাদের শরীরের গড়ন হালকা-পাতলা তাদের ক্ষেত্রে থাইরয়েড গ্রন্থি এমনিতেই ফোলা দেখা যেতে পারে তাছাড়া আরো যে কারনগুলোতে থাইরয়েড গ্রন্থি ফুলতে পরে সেগুলো হচ্ছেঃ
- কিছু অটোইমিউন রোগ
- পিটুইটারি গ্রন্থির সমস্যা
- ইনফেকশন
- জেনেটিক কারন উল্লেখযোগ্য।
থাইরয়েড সমস্যা হলে গ্রন্থি ফুলে উঠতে পারে সেক্ষেত্রে অনেকে মনে করেন যে ক্যন্সার হয়েছে! আদতে এটা একটি ভুল ধারনা, এভাবে আতঙ্কিত হওয়ার কোন দরকার নেই কারন যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া থাইরয়েড ক্যান্সার নির্ণয় সম্ভব নয়। তবে গলা বা থাইরয়েড সমস্যা দেখা দিলে বা থাইরয়েড গ্রন্থি ফুলে গেলে অবহেলা না করে অবশ্যই নাক কান গলা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
থাইরয়েড হরমোন বেড়ে বা কমে গেলে কি হয়?
হরমনের তারতম্যের ফলে থাইরয়েড সমস্যা দেখা দেয়, অর্থাৎ কোন কারনে রক্তে থাইরয়েড হরমোনের পরিমাণ কমে গেলে হাইপোথাইরয়েডিজম এবং বৃদ্ধি পেলে হাইপারথাইরডিজম বা থাইরোটক্সিকোসিস হয়। নিচে রোগ দুটির উপসর্গ বা লক্ষনগুলি উল্লেখ করা হয়েছেঃ
হাইপারথাইরডিজম রোগের লক্ষণঃ
- মেজাজ খিটখিটে হয়ে যেতে পারে
- গরম সহ্য করতে না পারা
- খাদ্যাভ্যাস ভালো ঠিক থাকলেও ওজন কমে যায়
- ডায়রিয়া হতে পারে
- বুক ধরফর করবে
- দুর্বল লাগবে
- মেয়েদের মাসিক এর পরিমাণ কমে যেতে পারে
- হাত ঘেমে যায়
- চোখ বড় বড় হতে পারে
হাইপোথাইরডিজমের লক্ষণ
- শরীর মোটা হয়ে যায়
- দুর্বল লাগে
- চুল পড়ে যায়
- সবকিছু ভুলে যাবার প্রবনতা তৈরী হয়
- মেয়েদের ক্ষেত্রে মাসিক বেশি হয় এবং অনেক দিন থাকে।
বাচ্চাদের ক্ষেত্রে জন্মের পরপরই হাইপোথাইরডিজম হতে পারে সেক্ষেত্রেঃ
- বাচ্চার মুখ ফুলে যাবে
- জিহ্বাটা অনেক বড় হবে
- পায়খানা কষা হবে
- বাচ্চার চুল ভঙ্গুর থাকবে
- জন্ডিস দেখা দিতে পারে
- বাচ্চার চেহারা বোকা বোকা হবে
- বাচ্চার খাবারের প্রতি অনিহা থাকবে
কি কি কারনে গলগন্ড রোগ হয়?
মুলত আয়োডিনের অভাবে গলগন্ড রোগ হয় তবে, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, রাই সরিষা জাতীয় ফসল বেশি খেলে অনেকের ক্ষেত্রে থাইরয়েড ফুলে যেতে পারে বা গলগন্ড হতে পারে। এছাড়া কিছু জেনেটিক ফ্যাক্টরের কারনে এবং এন্টি থাইরয়েড ড্রাগ যেমন, কার্বিমাজল, প্রোপাইল থাইয়োইউরাসিল ওষুধের কারণেও গলা বা থাইরয়েড গ্রন্থি ফুলে যেতে পারে।
কখন গলগন্ড অপারেশন করতে হয়?
গলগন্ড রোগ হলে সাধারণত অপারেশন লাগে না তবে টিউমার বেশি বড় হলে বা শ্বাসকষ্ট হলে বা ক্যান্সারের ভয় থাকলে তখন অপারেশন করতে হয়। অপারেশনের পরে রোগী ভালো থাকতে পারে তবে, যদি ক্যান্সার হয় সে ক্ষেত্রে চিকিৎসা দীর্ঘায়িত হয়।
থাইরয়েড সমস্যা নির্ণয়ের পরিক্ষা
- রক্তের কিছু পরীক্ষা যেমনঃ TSH, F.T4, F.T3 ইত্যাদি
- গলার আল্ট্রাসাউন্ড
- FNAC বা সুঁই পরীক্ষা
- কিছু এক্সরে
- কিছু স্ক্যান পরীক্ষা ইত্যাদি
মেডিকেল ইমেজিং বিষয়ে পড়ুনঃ রোগ নির্ণয়ে মেডিকেল ইমেজিং
থাইরয়েড ক্যান্সারের লক্ষন কি ?
সাধারণত পরিক্ষা নীরিক্ষা ছাড়া ক্যন্সার বোঝা সম্ভব নয় তবে ক্যন্সার হলে নিম্নলিখিত লক্ষনগুলি থাকতে পারে
- অনেক সময় শুধু গলা ফোলা থাকতে পারে
- গলায় গোটা বা চাকা থাকতে পারে
- কন্ঠস্বর পরিবর্তন হতে পারে
- লসিকা গ্রন্থি ফুলে যেতে পারে
- গলা ব্যাথা যা চিকিৎসায় ভালো হচ্ছে না
থাইরয়েড ক্যান্সার ও তার চিকিৎসা
থাইরয়েড সমস্যা যেগুলো হতে পারে তার মধ্যে অন্যতম থাইরয়েড ক্যন্সার। থাইরয়েডে যেসব ক্যান্সার হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্যঃ
- প্যাপিলারি কার্সিনোমা বা ক্যান্সার
- ফলিকুলার কার্সিনোমা বা ক্যান্সার
- মেডুলারি কার্সিনোমা বা ক্যান্সার
- এনাপ্লাস্টিক কার্সিনোমা বা ক্যান্সার
- লিম্ফোমা
- আরও অন্য ক্যান্সার
প্যাপিলারি কার্সিনোমা ও ফলিকুলার থাইরয়েড কার্সিনোমা বা ক্যান্সার
প্যাপিলারি কার্সিনোমা ও ফলিকুলার থাইরয়েড কার্সিনোমা বা ক্যান্সার ক্ষেত্রবিশেষে অনেক ভাল ফলাফল দেয়। প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়লে অপারেশনের মাধ্যমে থাইরয়েড বা থাইরয়েড গ্ল্যান্ড এর অংশবিশেষ অপারেশন করে দিলে রোগী সুস্থ থাকতে পারেন।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রোগী অনেকদিন পর্যন্ত সুস্থ থাকে, সম্পূর্ণ গ্ল্যান্ড ফেলে দিলে রোগীকে পরবর্তী অবস্থায় রেডিও আয়োডিন অ্যাব্লেশন দিতে হয়। সেক্ষেত্রে রোগীকে সারা জীবন হরমোনের ট্যাবলেট খেতে হয়। আবার প্যাপিলারী কার্সিনোমা বা ফলিকুলার কার্সিনোমা যদি লসিকা গ্রন্থিতে ছড়িয়ে পড়ে সেক্ষেত্রে নেক ডিসেকশন (গলার অংশ বিশেষ অপারেশন) এর প্রয়োজন হয়।
মেডুলারি কার্সিনোমা
মেডুলারী কার্সিনোমা অপারেশন একটু বড়, সম্পূর্ণ গ্ল্যান্ড ফেলার সাথে সাথে নেক ডিসেকশন (গলার অংশ বিশেষ) অপারেশনের এর প্রয়োজন হয়।
এনাপ্লাস্টিক কার্সিনোমা
এনা প্লাস্টিক কার্সিনোমা ফলাফল খুব ভালো নয়, এই কার্সিনোমা বা ক্যান্সার হলে রোগীকে বেশিদিন বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয়না।
লিম্ফোমা
লিম্ফোমার ক্ষেত্রে অপারেশন এবং অপারেশন পরবর্তী অবস্থায় +/-কেমোথেরাপি / রেডিওথেরাপি দিলে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।
ক্যান্সার নিয়ে ভয় নয়, সঠিক সময়ে চিকিৎসায় ক্যান্সার ভালো হয়। থাইরয়েড এবং থাইরয়েডের সমস্যায়
চিকিৎসকের পরামর্শ নিন, সুস্থ থাকুন ভালো থাকুন।