আপনার বাচ্চাটা কি একটু বেশিই দুষ্টুমি করছে? শিশুদের দুষ্টুমি খুবই স্বাভাবিক একটি বিষয়। সাধারনত দেখা যায় শিশুরা এক বছরের পর থেকেই হাটা শুরু করে আর তার আশেপাশের সব কিছুই ধরে দেখতে চায়। কারন একটি শিশু যখন একটু একটু করে বড় হয়, তখন আশেপাশের সবকিছু নিয়ে তার মনের মধ্যে প্রচন্ড আগ্রহ তৈরি হতে থাকে।
একটা শিশু জন্মের পর থেকে তার বয়সের বিভিন্ন অধ্যায় পার করে। জন্মলগ্ন থেকে বার্ধক্য, এ দীর্ঘ সময়ে মানুষের জীবনে যতগুলো পরিবর্তন দেখা যায় তার সবগুলোই খুবই স্বভাবিক।
এতক্ষণ যা বললাম তা একটি শিশুর সাধারন অবস্থা। সাধারনত শিশুর বেড়ে ওঠার সাথে দুষ্টামি ও চঞ্চলতা শব্দ দুটি খুব বেশি শোনা যায়। সাধারণত নতুন নতুন জিনিস দেখার কারনে বাচ্চাদের মনের মধ্যে সেসব জিনিসের প্রতি আগ্রহ তৈরি হতে থাকে।
তবে একেক বাচ্চার জন্য নতুন নতুন বিষয়গুলো জানার এবং দেখার প্রক্রিয়া বা প্রতিক্রিয়াগুলো আলাদা আলাদা রকমের হয়ে থাকে। আর এই প্রক্রিয়া বা প্রতিক্রিয়ার ফলে আমরা কিছু বাচ্ছাদের শান্ত আর কিছু বাচ্ছাদের দুষ্টু বা চঞ্চল বলে থাকি।
সব বাচ্চাই কম বেশি দুষ্টামি করে থাকে তবে সেই দুষ্টামি বা চঞ্চলতা যদি অতিরিক্ত হয়ে যায় তখন সেটা চিন্তার কারন হয়ে দাড়ায়। বাচ্চার অতিরিক্ত দুষ্টামিও যে একটি অস্বাভাবিক অবস্থার কারনে হতে পারে এটা আমরা অনেকেই জানি না। দুষ্টামি বা চঞ্চলতা যখন শুধু মনযোগ আকর্ষণ এর কারন হয়ে যায় তখন তা শিশুর জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাড়ায়। আর একে বলা হয় Attention Deficit Hyperactivity Disorder (ADHD)।
Attention Deficit Hyperactivity Disorder (ADHD) কি?
Attention Deficit Hyperactivity Disorder বা ADHD যাকে বাংলায় বলা হয়ে থাকে মনোযোগের অভাব বা অতিরিক্ত চঞ্চলতা । তবে চঞ্চলতা কিন্তু শিশুদের ক্ষেত্রে একটি স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। যখন একটি শিশু হামাগুড়ি দেওয়ার পরে হাটতে শেখে তখন সে দৌড়াতে চায়, তার আশেপাশের যা কিছু তার সবকিছুই ধরতে চায়। মোটকথা সে তার নতুন জগতটাকে জানতে চায়।
শিশুর চঞ্চলতা যেমন স্বাভাবিক তেমন প্রত্যাশিত, কারণ তা শিশুর বেড়ে ওঠা এবং মানসিক বিকাশে ভূমিকা রাখে। তবে কখনও কখনও শিশুর এই স্বভাবসুলভ চঞ্চলতা মাত্রাতিরিক্ত হয়ে ওঠে। তখন আমারা এটাকে অস্বাভাবিক অবস্থা বলতে পারি। তবে শিশুর এই অস্বাভাবিক চঞ্চলতা Attention Deficit Hyperactivity Disorder কিনা তা বুঝতে আরো কিছু বিষয় বিবেচনার প্রয়োজন রয়েছে।
বাচ্চা Attention Deficit Hyperactivity Disorder এ ভুগছে কিনা তা জানতে হলে আপনাকে যে বিষয়গুলো জানতে হবে তা নিচে বলার চেষ্টা করছি।
Attention Deficit Hyperactivity Disorder এর লক্ষণসমূহঃ
Attention Deficit Hyperactivity Disorder এ আক্রান্ত বাচ্চার ক্ষেত্রে Attention এর অভাব বা Hyperactivity এ দুটোর যে কোন একটি অথবা দুইটাই হতে পারে। Inattention বা অমনোযোগী বা মনোযোগের অভাব এর ৯টি বৈশিষ্ট্য থাকে জার মধ্যে ৬ টি লক্ষণ থাকলেই বুঝে নিতে হবে বাচ্চার মনযোগের অভাব বা ADHD আছে।
লক্ষণগুলো নিচে পর্যায়ক্রমে দেওয়া হোলো.
ADHA OR Attention Deficit Hyperactivity Disorder এর লক্ষণসমূহঃ
- গভীর মনোযোগ দিতে না পারা
- নিরবিছিন্ন মনোযোগ না দিতে পারা
- মনোযোগ দিয়ে কথা না শোনা
- নির্দেশনা ঠিকমতো মানতে না পারা
- মনে রাখতে না পারা
- গুছিয়ে কাজ করার অদক্ষতা
- অস্থিরতায় ভোগা
- ভুলে যাওয়া
- কাজে অনিহা
এবার লক্ষণগুলো নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা যাক
01. গভীর মনোযোগ দিতে না পারা
এসব বাচ্চারা গভিরভাবে কোন কিছুতে মনোযোগ দিতে না পারার কারনে দেখা যায় এরা প্রায় ই তাদের কাজে ভুল করে থাকে বা বলতে পারি একি ভুল তারা বার বার করে থাকে। সেটা হতে পারে তাদের পড়ার ক্ষেত্রে বা বাসার কাজে বা কোন খেলাধুলার ক্ষেত্রে। কারন যে কোন খেলার কিছু নিয়ম থাকে যেগুলো তারা মনোযোগ দিয়ে শোনে না তাই তারা কোন খেলা বা পড়াশুনা ঠিকমত আয়ত্ব করতে পারেনা।
02. নিরবিছিন্ন মনোযোগ না দিতে পারা
যেহেতু হাইপার একটিভ বাচ্চা কোন কিছুতে গভীরভাবে মনোযোগ দিতে পারেনা তাই তদের জন্য কোন কাজে একটানা মোনযোগ দিয়ে করতে অসুবিধা হয়। কোন কাজ করতে গেলে সেই কাজের জন্য একটানা কিছু সময় দিতে হয় যা হাইপার একটিভ বাচ্চারা দিতে পারে না।
03. মনোযোগ দিয়ে কথা না শোনা
যেহেতু হাইপার একটিভ বাচ্চাদের মনোযোগের অভাব আছে তাই তারা কোন কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবে না, ফলে তাকে কোন নির্দিষ্ট একটি কাজ করতে বলা হলে তা সে সঠিক ভাবে করতে পারবে না।
04. নির্দেশনা ঠিকমত মানতে না পারা
যেহেতু হাইপার একটিভ বাচ্চা মনোযোগ দীয়ে কথা শোনে না তাই সে কোন নির্দেশনাও ঠিকমতো মানতে পারে না। যেমন আপনি হাইপার একটিভ কোন বাচ্চাকে একটা কলম একটা নির্দিষ্ট জায়গায় রাখতে বললেন কিন্তু সে সেই কলমটি নির্দিষ্ট স্থানে ণা রেখে যে কোন যায়গায় রেখে দিলো কারণ সে মনোযোগ দিয়ে আপনার কথা শোনেনি।
05. মনে রাখতে না পারা
কোন বিষয় মনে রাখতে হলে তা আগে মনোযোগ দিয়ে আগে শুনতে হবে বা জানতে হবে। মনোযোগের অভাবের কারনেই হাইপার একটিভ বাচ্চারা কিছু মনে রাখতে পারে না।
06. গুছিয়ে কাজ করার অদক্ষতা
উপরেই আমরা জেনেছি যে হাইপার একটিভ বাচ্চাদের মনোযোগের অভাব থকাবে। আর এই জন্যই তারা একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কোন কাজই গুছিয়ে করতে পারবে না।
07. অস্থিরতায় ভোগা
হাইপার একটিভ বাচ্চারা সবসময় একধরনে অস্থিরতার মধ্যে থাকবে। একটি বিষয় সমাধান না করতে পেরে আর একটি বিষয় সমাধানের চেষ্টা করবে এবং আরো বেশি অস্থির হয়ে যাবে। এর মুল কারনও কোন বিষয়ে ঠিকমত মনোযোগ না দিতে পারা বা মনোযোগ দিয়ে কোন কিছু না শোনা।
08. ভুলে যাওয়া
হাইপার একটিভ বাচ্চাদের আর একটি বড়ো বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে, তারা কোন কথা বা কোন নির্দেশনা মনে রাখতে পারেনা। ভুলে যাওয়া এ ধরণের বাচ্চাদের আরো একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
09. কাজে অনিহা
হাইপার একটিভ বাচ্চাদের কাজে তেমন আগ্রহ থাকে না, তারা যেহেতু কাজে মনোযোগী না তাদের কথা মনে থাকে না তারা গুছিয়ে কোন কাজ একটা নিদৃষ্ট সময় পর্যন্ত করতে পারে না তাই তাদের যে কোন কাজে অনিহা দেখা যায়।
এতক্ষণ আমরা যে বিষয় নিয়ে আলোচনা করলাম সেগুল হল অমনোযোগী বা Inattention এর লক্ষন এবার জানা যাক বাচ্চার কি কি লক্ষণ থাকলে বুঝতে হবে বাচ্চা অতিরিক্ত চঞ্চল । বাচ্চা যদি মনযোগী হয় ও তাও তার যদি অতিরিক্ত চঞ্চলতা থাকে তাহলে সে হাইপার একটিভ ডেফিসিয়েনসি তে ভুগতে পারে অর্থাৎ বাচ্চার ADHD থাকতে পারে।
অতিরিক্ত চঞ্চল (Hyperactivity) বা অস্থির (Impulsivity)
আপনার বাচ্চা অতিরিক্ত চঞ্চল (Hyperactivity) বা অস্থির (Impulsivity) কিনা তা কিভাবে বুঝবেন? এটা বোঝার জন্যও কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। আসুন এবার সেগুল নিয়ে আলচোনা করা যাক ।
- সারাক্ষন হাত পা নাড়ানো অর্থাৎ বাচ্চা কখনই স্থির ভাবে বসে থাকতে পারে না সবসময় মুভমেন্ট এর
- মধ্যে থাকে।
- সারাক্ষণ ছোটাছুটি করা , দেখা যায় বাচ্চা সারাক্ষণ কথায় বেয়ে উঠছে না হয় দৌড়ায় বেড়াচ্ছে এতাও
- অস্থিরতার লক্ষণ ।
- অতিরিক্ত কথা বলা, অর্থাৎ সারাক্ষণ কোন না কোন বিষয়ে একভাবে কথা বলতে থাকা ।
- শান্তভাবে কোন কাজ করতে না পারা ।
- অপেক্ষা করতে না পারা।
এসব বিষয় বা বৈশিষ্ট্যগুলো যদি কোন বাচ্চার থেকে থাকে তাহলে আসলে তার ADHD আছে ধারণা করা হয়। তবে এগুলো ছাড়াও তার নিউরোজিকাল কোন প্রবলেম আছে কিনা, তার অন্যান্য ডেভেলপমেণ্ট ঠিক আছে কিনা এসব বিষয়গুলো দেখেই তবে কোন বাচ্চার ADHD আছে কিনা তা বিবেচনা করা হয়।
Attention Deficit Hyperactivity Disorder এর চিকিৎসা
এতক্ষণ আমরা ADHD বা হাইপার একটিভ কি এবং কোন কোন বৈশিষ্ট্য থাকলে বাচ্চাকে হাইপার একটিভ বোলতে পারি তা জেনেছি। এখন এই সমস্যার সমাধান বা এই অস্বাভাবিকতার কি চিকিৎসা কি হতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করবো।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে এখন কিছু ব্যতক্রম ছাড়া সবধরনের রোগেরই চিকিৎসা রয়েছে। তেমনই Attention Deficit Hyperactivity Disorder (ADHD) এরও চিকিৎসা করা সম্ভব। অর্থাৎ কোন বাচ্চা যদি হাইপার একটিভ হয়ে থাকে তাহলে তার এই সমস্যা সমাধান করা সম্ভব।
হাইপার একটিভ এর ২ রকম চিকিৎসা হতে পারে যথা:
- মেডিকেশন বা ঔষধের মাধ্যমে চিকিৎসা এবং
- বিহেভিওরাল থেরাপি
মেডিসিন এর আবার ২ টা ভাগ আছে যথা,
- ইষ্টিমুলেনট
- নন-ইষ্টিমুলেনট
সাধারণত ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে মেডিসিন ব্যাবহার করা হয় না। তাদেরকে বিহেভিওরাল থেরাপির মাধ্যমে সংশোধন করা হয় বা চিকিৎসা করা হয়ে থাকে। বিহেভিওরাল থেরাপির মধ্যে থাকে
- অরগানাইজেসন স্কিল
- টাইম ম্যানেজমেনট
- প্যারেন্টিং মডিফিকেশন
ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এই থেরাপিগুলর উপর কাজ করলে সহজেই তাদের হাইপার একটিভিটি সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। আর একটু বড় বাচ্চাদের ক্ষেত্রে যেমন যাদের বয়স ৮, ১০ বা ১২ বছর, এমন বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ওষুধ আর বিহেভিওরাল থেরাপি ২টা একসাথে দেওয়া হয়। তবে এক্ষেত্রে নন স্টিমুলেট ওষুধ ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
আর যারা এর থেকে আরও একটু বড় তাদেরকে ইষ্টিমুলেট ওষুধ আর বেহেভিওরাল থেরাপি দিয়ে খুব দ্রুত সুস্থ করা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে ২-৩ সপ্তাহ ইষ্টিমুলেট ওষুধ ব্যবহারে রোগী অনেকটাই সুস্থ হয়ে ওঠে।
Attention Deficit Hyperactivity Disorder এ যারা আক্রান্ত তাদের আরও কিছু মানসিক সমস্যা থাকতে পারে। যেমন, ইরিটেবিলিটি ও ফ্রাশটেশন। শিশু ADHD তে ভুগলে তা নিয়ে চিন্তিত না হয়ে যত তারাতারি সম্ভব ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে চিকিৎসা শুরু করুন। আরে বিশেষ করে বাচ্চাদের বেড়ে ওঠার সময়টাতে একটু ভাল করে পর্যবেক্ষন করুন, আপনার বাচ্চার এধরনের কোন সমস্যা তৈরি হচ্ছে কিনা।