’সাইবর্গ’ বিষয়টি আমরা বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী বিষয়ক সিনেমাতে দেখেছি আবার গল্প, উপন্যাসেও পড়েছি। কিন্তু যখন বাস্তবে এর প্রয়োগ দেখি তখন তা অনেক সময় আমাদের কল্পনাকেও হার মানায়। আজকাল বেঁচে থাকার জন্য মানুষ বিভিন্ন অর্গান ট্রান্সপ্লান্টেশন করছে, মানুষের অর্গান ছাড়াও জেনেটিক্যালী মডিফায়েড অন্যান্য পশুর দেহ থেকে হিউম্যানাইজড অর্গান নিয়ে তা ট্রান্সপ্লান্টেশন করা হচ্ছে মানুষের শরীরে।
কিন্তু এসবের পরেও মানুষের তৈরী কৃত্রিম অর্গান মানুষের শরীরেই আবার প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে, ট্রান্সপ্লান্টেশনের মত রিজেকশনের ঝুকি নেই যেখানে, কিন্তু রয়েছে অন্য সমস্যা, আমরা এগুলি নিয়েই সংক্ষিপ্ত আলোচনা করবো এই প্রবন্ধে।
সাইবর্গ কি?
মানুষের শরীরে অনেক রকম কৃত্রিম যন্ত্রপাতি সংযোজন করা হয়ে থাকে, রোগের কারনে অথবা এক্সিডেন্টের কারনে অঙ্গ- প্রত্যঙ্গ নিরাময়-অযোগ্য মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেলে, জন্মগত কারনে কোন অঙ্গ তৈরি না হলেও সেটাকে স্থাপন করা হচ্ছে ইদানীং কালে। এই মানুষ আর যন্ত্রের সংমিশ্রনে যে মানুষ তৈরী হলো তাকে এখন সাইবর্গ বলা হচ্ছে, অংগ সংযোজনের নাম অনুযায়ীও এদের নামকরন করা হয়ে থাকে, যেমন চক্ষু পরিবর্তন করলে তাকে আইবর্গ বলা হয়ে থাকে।
সাইবর্গ কীভাবে কাজ করে?
এখানে ইলেকট্রনিক্স একটা বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে, ব্রেনের সাথে লাগানো ইলেকট্রোড ব্রেন থেকে উদ্দীপনা (Sensory Impulse) সংগ্রহ করে, সেটাকে সফট-ওয়ারের মাধ্যমে বিশ্লেষন করে, তারপর নির্দেশিকা (Motor Impulse) তৈরি করে উপযুক্ত অর্গানে পাঠায়, এবং সে অনূযায়ী কার্য্য সম্পাদন হয়।
চোখের রেটিনার ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র চিপস (Chips) রেটিনার নীচে স্থাপন করা হয়, সেটার উপর আলো পড়লে ইম্পালস তৈরী হয়ে মগজে পৌঁছায়, সফট- ওয়ারের মাধ্যমে ব্রেন সেটাকে ব্যাখ্যা করে নির্দেশিকা প্রনয়ন করে। চক্ষু সম্পুর্ন নষ্ট হয়ে গেলে কৃত্রিম ইলেক্ট্রনিক ক্যামেরা চক্ষুগোলকের মধ্যে লাগানো হয়, এবং সেখান থেকে ইম্পালসের মাধ্যমে ইমেজের ছবি পাঠানো হয় মগজে।
হাত এবং পায়ের ক্ষেত্রেও কৃত্রিম হাত বা পা তৈরি করে শরীরে লাগানো হয়, এখান থেকে ব্রেনে নির্দেশনা পাঠানো হয়, এবং ব্রেন থেকে আবার নির্দেশনা লিম্বে পৌছায়। এখানে মূল জিনিসটি হলো ব্রেন-চিপস ইন্টারফেজ তৈরি করতে পারা যাতে করে উভয়ের মধ্যে তথ্যের আদান-প্রদান হতে পারে। চিপস ব্রেনের তৈরি ইলেকট্রিক সিগন্যাল পড়তে পারে আবার ব্রেনও চিপস থেকে প্রদত্ত ইলেকট্রিক সিগন্যাল গ্রহন করতে পারে ।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligene) এবং সাইবর্গ
আজকাল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মেশিন লার্নিং ইত্যাদির সঙ্গে যন্ত্রপাতির ব্যবহার ক্রমশই বাড়ছে। সাইবর্গের সঙ্গেও এসব তৎপরতা ক্রমশই বেড়ে চলেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মূলতঃ ব্রেনের ইলেকট্রিক্যাল সিগন্যাল পড়ার জন্য যে সফটওয়ারের প্রয়োজন হয় তা বিনির্মান করে, ক্রমে ব্রেনের তৎপরতার উপর নির্ভর করে এরা একটা প্যাটার্ন তৈরি করে যা পরবর্তী মূভমেন্ট সম্বন্ধে অগ্রিম ধারনা নিয়ে পরবর্তী কার্যাবলী তৈরি করতে পারে।
এখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কিছুটা স্মৃতি এবং পুর্বপরিকল্পনা (Anticipation reflex) ধরে রাখতে পারে এবং সেই অনুযায়ী কাজও করতে পারে। AI এর ব্যবহার অনবরত বাড়ছে এবং পরবর্তী ২০০ থেকে ৩০০ বছরের মধ্যে অজৈব প্রান (Inorganic life), অজৈব মানুষ, অজৈব চেতনা ইত্যাদি তৈরি করতে পারে।
শেষ কথা
ইউভাল হারারি (Yuval Noah Harari) একটা লেখায় এমনটাই উল্লেখ করেছেন। সামনের ২০০-৩০০ বছরের মধ্যে এসব পরিবর্তন হয়ে যাবে বলে তার ধারনা। এইসব নতুন যুগের মানুষেরা হয়ত বর্তমান যুগের মানুষদের প্রতিস্থাপিত করে পৃথিবী দখল করে নেবে, এবং গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে অভিযান চালিয়ে যাবে। এর মাধ্যমে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে টিকে থাকার যে পরিবেশ তা আর থাকবে না।
হয়ত যান্ত্রিক মানুষ নতুন যুগে পুরাতন যুগের মানুষের নানারকম সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠবে। হয়ত এসব স্বার্থের দ্বন্দ্ব, হিংসা-হিংসি, যুদ্ধ, শোষন, নির্যাতন এসব কিছুই আর থাকবে না, তৈরি হবে নতুন যুগের যন্ত্র-মানব যা হয়ত নায্যতা প্রতিষ্ঠা করবে, কিন্তু তাতে প্রান থাকবে না। আমরা এতদুর পর্যন্ত না এগিয়েও শুধু সাইবর্গ পর্যন্ত থাকতে পারতাম, তাতে হয়ত মানব প্রজাতি টিকে যেতে পারত আরও কয়েক শতাব্দী।