বিজ্ঞান শুরু হয়েছে অপবিজ্ঞান বা ছদ্মবিজ্ঞান (Pseudoscience) দিয়ে, এর পর ক্রমশ সে নিজেকে পরিশীলিত করে আজ এই পর্যায়ে এসে দাড়িয়েছে। ম্যাজিক আর কুসংস্কারে ভরা কর্মকান্ড থেকে দর্শন, বিজ্ঞান-দর্শন আর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মাধ্যমে আজ একটা প্রতিনিধিত্বশীল অবস্থায় পৌছতে তার একটা দীর্ঘ সময় লেগেছে। এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বিজ্ঞানের অবয়ব, শাখা-প্রশাখা সব বৃদ্ধি পেয়ে এক মহীরুহের রুপ নিয়েছে।
তারপরেও ছদ্মবিজ্ঞান অপবিজ্ঞান রয়ে গেছে কিছু মানুষের অন্তরে, বিশ্বাসে আর কর্মকান্ডে। মানুষ বিজ্ঞান পড়লেই কেবল বিজ্ঞানমনষ্ক হয়ে ওঠে না, তার জন্য চাই মননে আর জীবনাচরণের মধ্যে বিজ্ঞানের পদ্ধতিসমূহের সামগ্রিক চর্চা।
বিজ্ঞান আর টেকনোলজির মধ্যে তফাৎ রয়েছে বিস্তর। টেকনোলজি হচ্ছে ফলিত ব্যবহারিক বিজ্ঞান যার পাওনা নগদ (Ready to use), আর বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের ফলাফল এবং নগদ মুল্য অনেক দূরাগত বা সময়সাপেক্ষ ব্যপার, এবং অনেক সময় অনেকটাই মূল্যহীন। তাই সাধারন মানুষ টেকনোলজি ব্যবহার করতে কখনও পিছপা না হলেও কখনও কখনও বিজ্ঞানের কঠোর সমালোচক রূপে নিজেকে উপস্থাপন করে থাকে।
অপবিজ্ঞানের চর্চা এখন পর্যন্ত অশিক্ষিত, অপশিক্ষিত, অনগ্রসর, পশ্চাত্মূখী পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠির ভিতর সীমাবদ্ধ। তবে আশার কথা এই যে, যত দিন যাচ্ছে, মানুষ তত অপবিজ্ঞান থেকে বেরিয়ে এসে বিশুদ্ধ বিজ্ঞান চর্চায় মনোনিবেশ করছে।
ছদ্মবিজ্ঞান বা অপবিজ্ঞান কি?

Science (বিজ্ঞান) লিখে গুগল সার্চ করে পেলাম ৩,৮৪০,০০০,০০০ টি আর্টিকেল আর Pseudoscience (ছদ্মবিজ্ঞান/অপবিজ্ঞান) লিখে সার্চ দিয়ে পেলাম ৬,৬৯০,০০০ টি আর্টিকেল। আপনি যখন গুগলে সার্চ করবেন তখন এই সংখ্যার কিছুটা হের ফের হতে পারে। তবে একটা বিষয় নিশ্চিত যে, বিজ্ঞানের তুলনায় ছদ্মবিজ্ঞানের (Pseudoscience) সার্চ ভলিউম নেহায়েত কম নয়।
ছদ্মবিজ্ঞান হচ্ছে এক ধরনের অপবিজ্ঞান যা বিজ্ঞানের আদলে বিভিন্ন ধরনের অযৌক্তিক আজগুবি তত্ত্ব, তথ্য, ধারণা, মতামত, বক্তব্য ইত্যাদি প্রচার করে, যা মোটেও বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত নয় বা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি দ্বারা পরীক্ষিত হয়নি কখনও।
এগুলো পরীক্ষাগারে প্রমান করা সম্ভব নয় বা এদের ফলাফল পুনঃউতপাদনযোগ্য (Reproducible) নয় বা এগুলো সহকর্মীদের দ্বারা পরীক্ষিত নয় (Peer reviewed)। শুধুমাত্র কিছু বৈজ্ঞানিক পরিভাষা (Scientific term) ব্যবহার করে একজাতীয় বানোয়াট, দো-আঁশলা তত্বের জন্ম দেওয়া হচ্ছে, যা সাধারণ মানুষ যাদের বিশ্লেষণী ক্ষমতা কম তাদের কাছে সহজেই বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে।
ছদ্মবিজ্ঞানকে পার্থক্য করতে হবে বিজ্ঞানকে অস্বীকার (Science denial) করা থেকে এবং বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তসমূহের প্রতি প্রতিরোধকতা (Resistance to the Facts) থেকে।
বিজ্ঞানের এমন কোন শাখা নেই যেখানে ছদ্মবিজ্ঞানের হাত পড়েনি যমন, জোত্যির্বিদ্যা, মহাকাশবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, চিকিৎসা বিদ্যা, আবহাওয়াবিদ্যা ইত্যাদি সবখানেই। মানুষের একটা সাধারন প্রবনতা এই যে, এরা বিজ্ঞানের চেয়ে অপবিজ্ঞানকে সহজেই বিশ্বাস করে এবং মানতে চায়।
যেমন, জোতির্বিদ্যা (Astronomny) হচ্ছে বিজ্ঞান আর জ্যোতিষ শাস্ত্র (Astrology) হচ্ছে অপবিজ্ঞান। আজকাল হরোস্কোপ (Horoscope), ভাগ্য গননা, হাত দেখায় বিশ্বাসীদের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। বর্তমান সময়ে কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিন নিয়েও ষড়যন্ত্র তত্ত্ব (Conspiracy Theory) কম হয়নি, যা সহজেই কিছু মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে।
কোয়ান্টাম কথাটার অপব্যবহার, কম্পিউটার কথাটার অপব্যবহার যত্রতত্র দেখা যায়। এর মূল বক্তব্যের সাথে এসব কোয়ান্টাম মেথড, অথবা কম্পিউটারাইজড সেন্টারের কোন মিল নেই। পরখ করতে চাইলে গুগল সার্চ দিয়ে উইকিপিডিয়াতে ঢুকুন, এরকম হাজার খানেক সিওডোসায়েন্সএর উদাহরন পেয়ে যাবেন।
কারা ছদ্মবিজ্ঞান তৈরি করে?
শিক্ষিত ব্যক্তি, কিছু কিছু বৈজ্ঞানিক, শিক্ষক, প্রকৌশলী, জীব বিজ্ঞানী, চিকিৎসক ইত্যাদি সব শ্রেনী-পেশার ভিতরই ছদ্মবিজ্ঞানী রয়েছেন। কেউ প্রত্যক্ষ ভাবে ছদ্মবিজ্ঞান তৈরির কাজটি করছেন আবার কেউ করছেন পরোক্ষভাবে। কেউ সক্রিয়ভাবে, কেউ নিষ্ক্রিয়ভাবে ছদ্মবিজ্ঞান তৈরি করছেন, প্রচার করছেন, ছড়িয়ে দিচ্ছেন। এরা একজাতীয় হোয়াক্স (Hoax) বা গুজব ছড়াচ্ছেন প্রতিনিয়ত।
এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বের স্বীকার হয়েছে এপোলো-১১ থেকে শুরু করে আজকের কভিড-১৯ ভাইরাস পর্যন্ত। যারা নানারকম মিথ ছড়িয়ে সৃষ্টিতত্ত্ব সমন্ধে অন্যরকম ব্যাখ্যা দেন তাদেরকে বিজ্ঞান বিরোধী (Anti-science) বলা যায়, কিন্তু ছদ্মবিজ্ঞান বা অপবিজ্ঞান বলা যায় না। সেই অর্থে ছদ্মবিজ্ঞান যারা তৈরি করেন তদেরকে বিজ্ঞান বিরোধীদের থেকেও খারাপ বলা চলে।
বৈজ্ঞানিক সূত্রগুলো ক্রমশ আবিষ্কৃত হতে থাকে। এর পরে সময়ের সাথে সাথে পুরাতন থিওরী বাতিল হয়ে নতুন থিওরী তার স্থান দখল করে নেয়, আর এভাবেই এগিয়ে চলে বিজ্ঞান।
যেমন বিগ ব্যাং থিওরীর সিংগুলারিটির সমস্যা (Singularity Problem), পৃষ্ঠদেশের মসৃণতা (Flatness or Smoothness of Universe) ইত্যাদি নানাবিধ সমস্যা রয়েছে, যেগুলো Roger Penrose, Paul Steinhardt এর মত বিজ্ঞানীদেরকে ভাবিয়ে তুলছে আরও যথাযথ থিওরী দাড় করানোর জন্য।
ছদ্মবিজ্ঞান কিভাবে বিজ্ঞান থেকে আলাদা
বিজ্ঞানের মুল দুটি ধারা যার মধ্যে একটি তাত্ত্বিক (Theoritical) বিজ্ঞান ও অপরটি হচ্ছে গবেষণামূলক বা ব্যবহারিক (Empirical/Practical) বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের মধ্যেও কল্পনা (Imagination) রয়েছে যার স্থান অনেক উপরে। বিজ্ঞানের কল্পনা ছদ্মবিজ্ঞান বা অপবিজ্ঞানের মত কোন আকাশ-কুসুম কল্পনা নয়। এই কল্পনা হচ্ছে, গবেষণা থেকে প্রাপ্ত পুরাতন সঞ্জীবিত জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে নতুন কিছুর কল্পনা করা। ছদ্মবিজ্ঞানকে চিনতে হলে আগে আমাদের জানা প্রয়োজন বিজ্ঞান ঠিক কিভাবে কাজ করে। কারন এখানেই রয়েছে বিজ্ঞানের সাথে ছদ্মবিজ্ঞানে সবথেকে বড় পার্থক্য।
বিজ্ঞান গবেষণা পদ্ধতি (Methodology)
অপবিজ্ঞান বা ছদ্মবিজ্ঞান কোন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির (Methodology) ধরা ধারেনা কারন এখানে কোন কিছুর প্রমাণ দিতে হয় না। কিন্তু বিজ্ঞানকে চলতে হয় একটা নির্দিষ্ট পথ ধরে, একটা সুস্পষ্ট মেথোডোলজী বা (Scientific Method) অনুসরণ করে যা নিম্নরুপঃ

- সমস্যাকে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করন (Problem identification)
- চিহ্নিত বিষয়ে পূর্বে যতগুলো গবেষনা হয়েছে তার সীমাবদ্ধতা, অসম্পুর্ণতা, পক্ষপাতদুষ্টতা বের করা
- সমস্যার ঠিক কোন ক্ষেত্রে গবেষণার প্রয়োজন তা নিরূপন করা (Rationale of the study)
- বিজ্ঞানভিত্তিক অনুমান নির্ভর প্রকল্প (Hypothesis) তৈরি
- গবেষণার লক্ষ্য নির্ধারণ (Objectives of the study),
- হাইপোথিসিস সত্যতা/ অসত্যতা নিরূপনের জন্য (Test of significance of Hypothesis) গবেষণা পদ্ধতি (Study design) তৈরি করা,
- তথ্য সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণ করা (Data collection and analysis),
- ফলাফল এবং এর গুরুত্ব নির্ধারন করা (Statistical analysis, Result and significance),
- অন্যান্য সাদৃশ্যপুর্ণ গবেষনার সাথে এর মিল, অমিল এবং এর কারণসমূহ বিশ্লেষণ করা (Discussion)
- পরিশেষে এর সমাপ্তি (Conclusion) টেনে সুপারিশসমূহের (Recommendation/ Inference) অবতারণা করা
- গবেষণাপত্রটিকে পরীক্ষা পাশের জন্য থিসিস, ডিজারটেশন অথবা জার্নালে প্রকাশের জন্য সমকক্ষ ব্যক্তিদের দিয়ে পর্যালোচনা (Peer review) করার পর প্রকাশ করা
বিজ্ঞানে গবেষণা পদ্ধতির ধরণ
বিজ্ঞানে মোটাদাগে তিন ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, এদের আবার অনেক ভাগ-বিভাগ রয়েছে যা এই নিবন্ধের বিষয়বস্তু নয়। তবে এই ধরণগুলো কখনও ছদ্মবিজ্ঞানর জন্য প্রায়োজন পড়ে না।
- পর্যবেক্ষনমূলক (Observational Study)
- পরীক্ষণমুলক (Experimental Study)
- অংকশাস্ত্রীয় (Mathematical design)
হাইপোথিসিস (Hypothesis)
বিজ্ঞানের সুত্র আবিষ্কারের প্রথম ধাপ হচ্ছে হাইপোথিসিস বা সিদ্ধ অনুমান নির্ভর প্রকল্প। এগুলোর পিছনে বৈজ্ঞানিক যুক্তি আছে কিন্তু এখনও প্রমানিত সত্য নয়। অনেক ধরনের হাইপোথিসিস আছে যেমন রসায়নে এভোগাড্রোর হাইপোথিসিস (Avogadro’s Hypothesis), বিভিন্ন গবেষণা প্রকল্পের হাইপোথিসিস ইত্যাদি।
থিওরী ( Theory )
থিওরী হচ্ছে এমন একটা সিদ্ধান্ত যার স্বপক্ষে জোরালো প্রমান রয়েছে কিন্তু এখনও সর্ব্জন স্বীকৃত হয় নাই। যেমন আপেক্ষিকতার তত্ত্ব (Theory of Relativity), ডারউইনের বিবর্তনবাদ (Theory of Evolution), কোয়ান্টাম তত্ত্ব (Quantum Theory) ইত্যাদি।
ল (Law)
ল বা সূত্র হচ্ছে এমন বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত যা বার বার প্রমানিত হয়েছে এবং যা সত্য বলে সর্বজনগ্রাহ্য হয়েছে। যেমন নিউটনের গতি সূত্র (Newton’s Laws of Motion), পড়ন্ত বস্তুর সূত্র (Laws of Falling bodies), মহাকর্ষীয় সুত্র (Laws of Gravitation) ইত্যাদি।
ছদ্মবিজ্ঞানের অপকারী দিক এবং ভবিষ্যৎ
বিশ্ব প্রায় পোলিও মুক্ত হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু কিছু কিছু পশ্চাদপর দেশে হোয়াক্স ছড়িয়ে দেওয়া হলো এই ভ্যাক্সিনের ভিতর AIDS এর জীবাণু রয়েছে। স্থানীয় লোকজন ভ্যাক্সিন প্রদানকারীদের ঢূকতে বাঁধা দিল, কিছু জায়গাতে তাদের ধরে ধরে হত্যা করা হলো। ফলে বিশ্ব এখনও পলিওমুক্ত হতে পারলো না।
আস্তে আস্তে এই তমসা হয়তো কেটে যাবে, মানুষ যুক্তি-বিচার বুদ্ধি-সাক্ষ্য প্রমানের উপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নিতে শিখবে, এটাই প্রত্যাশা। বিজ্ঞান ছাড়া আর্ট বা কমার্স এখন আর কল্পনাও করা যায় না, প্রকৃত বিজ্ঞান শিক্ষাই আমাদেরকে মুক্ত করতে পারে অপবিজ্ঞানের হাত থেকে।