”ভবি আমার বচ্চাটা কিচ্ছুই খাচ্ছে না সারাদিন” বাচ্চারা তাদের চাহিদামত খাওয়ার পরেও অনেক অবিভাবক এমনই অভিযোগ করে থাকেন সবসময়। শিশুর শারীরিক বিকাশের জন্য সারাদিন যতটা মাথাব্যথা থাকে বাবা-মায়ের, ঠিক ততখানি গুরুত্ব শিশুর মানসিক বিকাশ ঘটার জন্য দিচ্ছেন কি?
শারীরিকভাবে শিশু সুস্থ থাকলেই সে মোটামুটি সুস্থ্য, এই ধারনাটাই পোষন করেন অধিকাংশ অবিভাবক। কিন্তু শুধুমাত্র শিশুর শারীরিক সুস্থতাকেই সুস্থতার মাপকাঠি ধরা কখনওই ঠিক হবেনা। শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি শিশুর মানসিক বিকাশ বা জ্ঞানীও বিকাশও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
শিশুর মানসিক বিকাশ বা জ্ঞানীও বিকাশ নিয়ে মনোবিজ্ঞানী জ্যাঁ পিঁয়াজের কালজয়ী মতবাদ Piaget’s theory of cognitive development [১] এখনও পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে সমানভাবে জনপ্রিয়। সুইজারল্যান্ডের মনোবিজ্ঞানী জ্যাঁ পিঁয়াজে গবেষণায় দেখিয়েছেন জন্মের পরে কিভাবে একটি শিশুর বুদ্ধির বিকাশ হয়, কিভাবে তারা প্রকৃতি থেকে জ্ঞান লাভ করে এবং বড়দের জ্ঞানের সাথে সেই জ্ঞানের পার্থক্য কী, আনুষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণে এই জ্ঞানীয় উপাদানগুলোই বা কিভাবে প্রভাব ফেলে।
শিশুর মানসিক বিকাশ কি?
আপনি খেয়াল করলেন যে আপনার শিশুটি খেলনা নিয়ে ঠিক খেলছে না, সবগুলো ছুড়ে ফেলছে ইচ্ছেমত। অথচ আপনি মনে করেছিলেন যে সে খেলনা নিয়ে খেলবে। ফলে অপনি মহা বিরক্ত হয়ে আরো লক্ষ করলেন যে, বাচ্চা হাতের কাছে যা পাচ্ছে তাই জানালা দিয়ে অথবা বারান্দা দিয়ে নিচে বা বাইরে ফেলে দিচ্ছে। আপনি ভেবে পাচ্ছেন না যে, আপনার শিশুটি এতটা দুষ্টু স্বভাবের হলো কিভাবে।
বিষয়টাকে এভাবে ব্যাক্ষা করা যায় যে, বাচ্চারা যা করে তা কখনও নিজে থেকে করে না, সে তার সামনে যা কিছু ঘটতে দেখে তা থেকেই সে শিক্ষা গ্রহণ করে এবং সেটা নিজেও করার চেষ্টা করে। এই যে সে একটু একটু করে শিখছে, অনুকরণ করছে, আপনাকে রেসপন্স করছে এটাই তার মানসিক বিকাশ বা তার জ্ঞানীয় বিকাশের অংশ। এখন শিশুর মানসিকি বিকাশ ভাল হবে না মন্দ হবে তা নির্ভর করবে আপনি তাকে কি পরিবেশ দিচ্ছেন তার উপরে।
শিশুর মানসিক বিকাশের স্তর
শিশুদের কিছু আচরণে আমরা বড়রা মাঝে মাঝে খুবই বিরক্ত হয়ে যায়। যেমন ধরুন, আপনার বাচ্চাকে কোন একটা কাজ না করার জন্য বার বার বোঝাচ্ছেন, অথচ সে কিছুতেই বুঝতে চাচ্ছেনা! বা কোনরকমভাবেই তাকে বোঝানো সম্ভব হচ্ছেনা। আপনার শিশুকে কাজটি না করার জন্য কেন বোঝানো সম্ভব হচ্ছেনা বা শিশুটি কেনো বুঝতে চাচ্ছেনা তা বুঝতে হলে শুনতে হবে মেনাবিজ্ঞানী জ্যাঁ পিঁয়াজের কথা।
মনোবিজ্ঞানী জ্যাঁ পিঁয়াজের মতে, জন্মের পর থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত ৪টি ধাপে পর্যায়ক্রমে একটি শিশুর মানসিক বিকাশ বা জ্ঞানীয় বিকাশ ঘটে। একটি ধাপ পুরোপুরি সম্পন্ন করার পরেই শুধুমাত্র আর একটি ধাপে প্রবেশ করা সম্ভব শিশুর ক্ষেত্রে। আর বয়স অনুযায়ী শিশুর মানসিক অবস্থা বা জ্ঞানের পরিধি কেমন থাকে তা বুঝতে হলে প্রতিটি বাবা-মায়ের জন্য এই ধাপগুলো জনাটা খুবই জরুরী।
শিশুর মানসিক বিকাশ বা জ্ঞানীয় বিকাশের ৪টি স্তরঃ
- ইন্দ্ৰীয়-পেশীয় সমন্বয় কাল (Sensorimotor Period)
- প্রাক প্রায়োগিক কাল (Pre-operational Period)
- বাস্তব প্রায়োগিক কাল (Concrete operational Period)
- রীতিবদ্ধ প্রায়োগিক কাল (Formal operational Period)
এখানে জ্যাঁ পিঁয়াজে তার গবেষণায় স্টেজগুলোর সময়কাল উল্লেখ করেছেন তবে তা একেবারেই ধরাবাধা নয়। এই সময়গুলো সম্পূর্ণ নির্ভর করে শিশুর মানসিক বিকাশের উপর। আপনার শিশুর মানসিক বিকাশ যদি খুব ভাল হয় তবে সে একটি স্টেজ খুব কম সময়ের মধ্যে পার হয়ে আর একটিতে প্রবেশ করতেই পারে। আবার মানসিক বিকাশ যদি ধীরে হয় তবে তা দীর্ঘায়িত হবে এটাই স্বাভাবিক। তবে প্রতিটি শিশুই এই ৪টি স্টেজের ভিতর দিয়েই তার মানসিক বিকাশ অর্জন করে।
১. ইন্দ্ৰীয়-পেশীয় সমন্বয় কাল (Sensorimotor Period):
এই স্টেজটির ব্যাপ্তিকাল শিশুর জন্মের পর থেকে ২ বছর বয়স পর্যন্ত। সেন্স অর্থ ইন্দ্রিয় আর মোটর অর্থ মুভমেন্ট মোটকথা এই স্টেজে একটি শিশু তার ইন্দ্রিয় এবং মুভমেন্টের সাহায্যে বস্তু সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে শেখে। যার কারনে এই সময়ে বাচ্চারা অনুকরণ করে, কোন কিছু ছুড়ে ফেলে শব্দ শুনতে পছন্দ করে।
তবে ১ থেকে ৬ মাস বয়স পর্যন্ত বাচ্চার কোন অবজেক্ট পারমানেন্স থাকে না। এসময় বাচ্চারা ভাবে তাদের দেখার বাইরে কেন কিছুরই অস্তিত্ব নেই! অবজেক্ট পারমানেন্স শিশুর মধ্যে ডেভেলপ হওয়া শুরু হয় ১১ থেকে ১২ মাস সময়ের দিকে।
২. প্রাক প্রায়োগিক কাল (Pre-operational Period):
শিশুর ২ থেকে ৭ বছর বয়স পর্যন্ত সময়কে বলা হয়েছে প্রি-অপারেশনাল স্টেজ । এখানে ‘অপারেশনাল’ শব্দটি যৌক্তিক চিন্তাভাবনা অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। এই স্টেজে শিশু যুক্তি বিষয়টি বুঝতে শেখেনা। এই স্তরের একটি শিশুকে আপনি কোনভাবেই যুক্তি দিয়ে বোঝাতে পারবেন না কারন এ সময়ে শিশুর লজিকাল থিংকিং বিষয়টিই গড়ে ওঠে না।
এ সময়টাতে শিশুরা তাদেরকে দিয়ে সবকিছু বিচার করতে চায়, যেমন, মাঝে মাঝে দেখবেন বাচ্চারা বড়দের কাছে এমন কিছু বিষয়ে জিদ ধরেছে, যা শিশুটির জন্য সহজেই করা সম্ভব কিন্তু বড়দের পক্ষে সম্ভব নয়। আর বড়দের পক্ষে যে কাজটি করা সম্ভব নয় তা শিশুকে কোনভাবেই বোঝাতে পারবেন না, এটাকে বলে ইগোসেন্ট্রিজম (Egocentrism)।
আবার আর একটি বিষয় রয়েছে যার মাধ্যমে একটি শিশু স্থান, কাল, পাত্রের পরিবর্তনগুলো বুঝতে পারে তা হচ্ছে ‘ল অব কনজারভেশন’। এই স্তরে শিশুর মধ্যে ‘ল অব কনজারভেশন’ বিষয়টিও গড়ে ওঠেনা।
৩. বাস্তব প্রায়োগিক কাল (Concrete operational Period)
৭ বছর বয়সকাল থেকে ১১ বছর বয়সকাল পর্যন্ত বাচ্চারা এ স্টেজের অন্তর্ভুক্ত। এ স্টেজে বাচ্চার মধ্যে দু-ধরনের চিন্তাভাবনা শুরু হয়। তারা যা চোখের সামনে দেখে সেগুলো নিয়ে যেমন চিন্তা করে ঠিক তেমনই যা কিছু চোখে দেখা যায়না তা নিয়েও চিন্তা করতে শুরু করে। যেমন, ভালবাসা, রাগ, দুঃখ ইত্যাদি।
অর্থাৎ এই স্টেজে এসে একটি বাচ্চার মধ্যে বস্তুনিষ্ঠ বিষয়ে চিন্তা ভাবনা তৈরি হওয়া শুরু হয়। যার ফলে আস্তে আস্তে শিশুর মধ্যেকার ইগোসেন্ট্রিজম দুর হয়ে যায় এবং ’ল অব কনজারভেশন’ বাড়তে থাকে।
৪. রীতিবদ্ধ প্রায়োগিক কাল (Formal operational Period)
১১ বছরের পরে থেকে কৈশরের সমস্ত সময়জুড়ে রীতিবদ্ধ প্রায়োগিক কাল বা ফরমাল অপারেশনাল স্তর। এই সময়ে একটি শিশু তার শৈশব শেষ করে কৈশোরে পদার্পণ করে এবং বয়স বাড়ার সাথে সাথে কংক্রিট থিংকিংয়ের সাথে যুক্ত হয় অ্যাবস্ট্রাক্ট থিংকিং।
ফলে তার মধ্যে ধীরে ধীরে তৈরি হতে থাকে হাইপোথিসিস (অনুমান/কল্পনা) করার ক্ষমতা, আবেগ, অনুভুতি ও ভাললাগার মত বিষয়গুলো। ক্রমেই একজন প্রাপ্তবয়ষ্ক মানুষের মত তার চিন্তাভাবনাগুলোও পরিণত হতে থাকে।
আরো পড়ুনঃ |
---|
সোশ্যাল ডিলেমা, প্রযুক্তির তৈরি বিলিয়ন ডলারের ফাঁদ! মেন্সট্রুয়াল কাপ; নারীর স্বাধীন, স্বাস্থ্যকর ও সংকোচহীন জীবন! |
মানসিক বিকাশ হচ্ছে কি-না কিভাবে বুঝবেন?
ভুমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে ১ বছর পর্যন্ত একটি শিশু শুধুমাত্র খাওয়া, ঘুম ও মলত্যাগ ছাড়া আর কিছুই করবে না। তাই সাধারণত এর পর থেকেই কিছু কিছু লক্ষন প্রকাশ পায় যার দ্বারা বোঝ সম্ভব তার ঠিকমত মানিসক বিকাশ হচ্ছে কি-না। তাই এই সময় থেকে শিশুকে ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করাটা জরুরী।
কিভাবে বুঝবেন আপনার শিশুর মানসিক বিকাশ ঠিকমত হচ্ছে কি-নাঃ
- শুরুর দিকে আপনার ডাকে বা দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টায় সে রেসপন্স করবে।
- মনে রাখার ক্ষমতা যাচাই করে দেখুন ঠিকমত মনে রাখতে পারছে কিনা।
- খুব অল্প বয়সেই শিশু পড়তে শিখে যাবে।
- শিশুর মধ্যে অনেক কৌতুহল তৈরি হবে, যা মেটানোর জন্য সবসময় প্রশ্ন করতে থাকবে।
- মিউজিক নিয়ে আগ্রহ থাকবে।
- সবসময় কোন কিছু নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার আগ্রহ থাকবে।
- অস্বাভাবিক কিছু আগ্রহ, শখ অথবা বিশেষ কিছু বিষয়ে গভীর জ্ঞান যুক্ত হতে পারে আপনার শিশুর মধ্যে।
- চলমান ঘটনাবলীগুলো সম্পর্কে কিছু ধারণা তৈরি হবে।
- উচ্চমানের রসিকতা বোধ থাকবে বা রসিকতাগুলো সহজে ধরতে পারবে।
- যখন খেলবে তখন খেলার মধ্যে নতুন এবং অতিরিক্ত নিয়মকানুন তৈরি করবে।
শিশুর মানসিক বিকাশের জন্য করনীয়
বাবা এবং মা দুজনেই শিশুর মানসিক বিকাশের জন্য সবথেকে বেশি ভুমিকা রাখতে পারেন। তাদের উপরেই নির্ভর করবে শিশুর মানসিক বিকাশ ঠিক কেমন হবে বা ঠিকমত হবে কি-না। প্রযুক্তি এবং পযুক্তিপন্য এই সময়ে অনেক সহজলভ্য, যার মধ্যে স্মার্টফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ, গেমিং ডিভাইস, অনলাইন গেমের মত পন্যগুলো শিশুদের আকৃষ্ট করে বেশি। আকর্ষণ থেকে আসক্তি তৈরি হলে এগুলোই তাদের মানসিক বিকাশের অন্তরায় হতে পারে।
শিশুর মানসিক বিকাশের জন্য কি কি করা উচিৎঃ
- সুস্থ পারিপার্শ্বিক পরিবেশ শিশুর মানসিক বিকাশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এটা নিশ্চিত করুন।
- আপনার শিশুকে যখন কোন খেলানা দেবেন তখন অবশ্যই লক্ষ রাখুন যে খেলনাটি সৃজনশীল কিনা। খেলনার মাধ্যমে তার মধ্যে যেন জ্ঞানীয় বিকাশ ঘটতে পারে তা লক্ষ রাখুন।
- শিশুর যে কোন নতুন জানা বা শেখার চেষ্টাকে প্রশংসা করুন, কিন্তু কখনওই তার ক্ষমতাকে বড় করে প্রকাশ করবেন না।
- বই পড়ার বিকল্প নাই কিছু, আপনার শিশুকে বই পড়ার অভ্যস করান। প্রয়োজনে তার সমনে নিজে পড়ে পড়ে শোনান তাতে তার বই পড়ার আগ্রহ তৈরি হবে।
- শিশু যা দেখবে, যা মনে রাখবে তাই ছবির মাধ্যমে ফূটিয়ে তুলতে চেষ্টা করবে। আপনার শিশুর হাতে ছবি আঁকার সামগ্রী তুলে দিন।
- কোন ব্যর্থতাকে তার সামনে ভীতিকরভাবে উপস্থাপন করবেন না। ভয় পেলে বা ব্যার্থ হওয়ায় লজ্জা পেলে পরবর্তিতে সে ঐ কাজটি করার জন্য আর আগ্রহ পাবেনা।
- সৃজনশীল যে কোন কিছুই মানসিক বিকাশের জন্য জরুরী তা হতে পারে সংগীতচর্চা, নাচ, বা কোরিওগ্রাফি।
- শিশুকে সবসময় নতুন নতুন ও বিভিন্ন ধরণের বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করুন।
- শিশুর সামান্য প্রতিভাকেও উৎসাহিত করুন এতে তার আরো আগ্রহ বাড়বে।
- শিশুর বুদ্ধিবৃত্তিক যে চাহিদা এবং আবেগ সম্পর্কিত যে সকল চাহিদা যেগুলো পুরনে সহায়তা করুন সবসময়।
- প্রযুক্তিপন্যগুলো একটি নিদৃষ্ট বয়স পর্যন্ত শিশুদের নাগালের বাইরে রাখুন, প্রয়োজনে বাসায় বা শিশুর সামনে এগুলো ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন।
শেষের কথা
আজ আপনার কাছে শিশুর যে আচরণ বিরক্তির কারন হচ্ছে তা কিছুদিন পড়ে আর থাকবে না। তবে তার এই বিরক্তিকর আচরণকে যদি বিরক্তি দিয়েই মোকাবেলা করেন তাহেল শিশুর মানসিক বিকাশ বা জ্ঞানীয় বিকাশ অবশ্যই বাধাগ্রস্থ হবে।
তাই শিশুকে তার জায়গা থেকে দেখুন, তার চিন্তা, ভাললাগা, মন্দলাগাগুলোকে ধৈর্য্যর সাথে তার মত করেই মুল্যায়ন করুন। সময় দিন দেখবেন আপনার শিশু আর সকলের থেকে একটু আলাদাভাবে বিকশিত হচ্ছে।
রেফারেন্সঃ |
---|
[১] Piaget’s theory of cognitive development |