অডিটরি হ্যালুসিনেশন (Auditory Hallucination) শব্দটির বাংলা অর্থ হচ্ছে, ‘অমূলপ্রত্যক্ষ’ বা ’অলীক কিছুর অস্তিতে বিশ্বাস’! সহজ করে বলতে গেলে, এমন কিছুতে বিস্বাস স্থাপন করা, যা আদৌ বাস্তবসম্মত নয় বা যার কোন বাস্তব অস্তিতই নেই। ব্যবহারিক অর্থে শব্দটির সাথে সমার্থ করা যায় ’জ্বীনের আছর’ বা ’অতিপ্রাকৃত শক্তি’ বা ‘গায়েবী আওয়াজ পাওয়া’ বিষয়গুলোর সাথে যা আমাদের দেশে প্রত্যন্ত অঞ্চল বা গ্রামে গঞ্জে এখনও অনেক প্রচলিত।
যারা বিষয়গুলো বোঝেন তারা মানসিক ডাক্তারের শরনাপন্ন হন আর বাকিরা ভরসা রাখেন ঝাড়ফুঁক আর তন্ত্রমন্ত্রের উপর। আসুন কিছু বাস্তব অভিজ্ঞাতার আলোকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা যাক।
অরো পড়তে পারেন.. |
---|
স্কোপোলামিন (ডেভিলস ব্রিদ); বর্তমান সময়ের সবথেকে ভয়ংকর ড্রাগ! সারোগেসি; সন্তান উৎপাদনে মাতৃত্ব ভাড়া ও এর প্রেক্ষাপট! |
অডিটরি হ্যালুসিনেশন
উইকিলিকস এর প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান এ্যাসাঞ্জ গত কিছুদিন ধরে একটি গায়েবী আওয়াজ শুনছেন। শুধুমাত্র আশেপাশে যখন কেউ থাকেনা, তখনই তিনি এই গায়েবী আওয়াজ শুনতে পান। এবং শুধুমাত্র জুলিয়ান ই এই কন্ঠটা শুনতে পান। জুলিয়ানের আশেপাশে যদি কেউ থেকেও থাকেন, তারা কিছুই শুনতে পাননা, কিংবা কোনো রেকর্ডারে রেকর্ডও করা যায়না এই কন্ঠটা।
কে যে কথা বলছে, সেটা দেখা যায়না, শুধুমাত্র কন্ঠটা শোনা যায়। শরীর নেই, মাথা নেই, ঠোট নেই, শুধুমাত্র একটি ভয়েস। কোন অবয়ব ছাড়া সেই ভয়েসটাই বিভিন্ন সময়ে সময়ে তার সাথে কথা বলে।
জুলিয়ান এ্যাসাঞ্জকে এই অদৃশ্য অশরীরি কন্ঠটা যা বলে, তার সারমর্ম হচ্ছে, “তুমি মরে গেছো। তোমার আর অস্তিত্ত্ব নেই। তোমার দেহ ধূলিকনায় পরিনত হয়ে গেছে। আমরা শীঘ্রই এসে তোমাকে নিয়ে যাব।” (you are dust, you are dead, we are coming to get you)
যারা এই বিষয়গুলোর বৈজ্ঞানিক ব্যাক্ষা জানেন না তাদের কাছে মনে হতেই পারে এটা ভূত-প্রেত বা জ্বীনের আছড়। তবে আদতে এটা একটি নিরাময়যোগ্য মানসিক রোগ। সাইকোলজির পরিভাষায়, এই রোগটিকে বলে অডিটরি হ্যালুসিনেশন (Auditory Hallucination)। এই রোগের প্রভাবে আক্রান্ত ব্যাক্তি নিজে আজব আজব সব শব্দ শুনেছেন বলে মনে করতে থাকেন, যা শুধুমাত্র তারই কল্পনা প্রসূত। আসলে এক্ষেত্রে রোগী বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে, কেউ তার সাথে কথা বলছেন এবং ফলো করছেন।
অডিটরি হ্যালুসিনেশন কেনো হয়?
কোনো নেশাজাতীয় দ্রব্য (Drug) বা পানীয় গ্রহণ করলে অথবা কোন কারনে ব্রেইন উত্তেজিত হলে অডিটরি হ্যালুসিনেশন হতে পারে। নিয়মিত প্রর্যাপ্ত ঘুম বা বিশ্রাম না হলে অথবা দীর্ঘদিন ধরে মানসিক চাপের মধ্যে থাকলেও এই রোগিটি হতে পারে, আবার অন্য কোনো মানসিক রোগ বা কোন ওষুধের সাইড ইফেক্ট হিসেবেও অডিটরি হ্যালুসিনেশন হতে পারে।
উদাহরণ হিসাবে জুলিয়ান এ্যাসাঞ্জের ঘটনাটিই যথেষ্ট। জুলিয়ান এ্যাসাঞ্জকে দীর্ঘদিন জেলখানায় আটকে রাখা হয়েছে এবং তাকে আরো কঠোর শাস্তি হিসাবে ফাসি দেওয়ারও প্লান চলছে। বিপদের মধ্যে বিপদ হিসাবে এদিকে আবার জেলের ভিতরে শুরু হয়েছে COVID 19 সংক্রমণ। অভিজ্ঞদের মতে, চারিদিকের এতসব মানসিক চাপের কারনেই জুলিয়ান এ্যাসাঞ্জের অডিটরি হ্যালুসিনেশন হচ্ছে।
অডিটরি হ্যালুসিনেশনের ইতিহাস
বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে এমন অনেক লোককেই পাওয়া যারা দাবি করেন যে, তারা গায়েবী আওয়াজ শোনেন। অনেকে এদেরকে পাগল ভাবেন আবার অনেকে এদেরকে সাধু-সন্যাসী ভেবে ভক্তি করেন। তবে এদেরকে সঠিক মানসিক চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ্য করে তোলা সম্ভব। শুধু বর্তমান যুগে নয়, অতীতেও অনেক বিখ্যাত মানুষের যে অডিটরি হ্যালুসিনেশন ছিলো তার প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমনঃ
অডিটরি হ্যালুসিনেশন ঘটনা- ১
সক্রেটিস কে এক অদৃশ্য কন্ঠস্বর জীবনের বিভিন্ন সময়ে সময়ে এসে উপদেশ দিত। এথেন্সের আদালত যখন সক্রেটিস কে হেমলক বিষ পান করার আদেশ দিয়েছিল। সক্রেটিস এর শিষ্যরা তখন গুরুকে উপদেশ দিয়েছিল পালিয়ে যেতে, কিন্তু সক্রেটিস তার ইনার ভয়েসের কথা শুনেন এবং পালিয়ে যেতে রাজি হননি, অতঃপর তিনি হেমলক পান করে মৃত্যূবরণ করেন।
অডিটরি হ্যালুসিনেশন ঘটনা- ২
চিত্র শিল্পী ভ্যানগগ গায়েবী আওয়াজ শুনতেন তার জীবনভর। গায়েবী আওয়াজ শুনেই তিনি একদিন তার একটা কান কেটে ফেললেন এবং সেই কাটা কান সুন্দর করে প্যাকিং করে তার গার্লফ্রেন্ড এর বাসায় কুরিয়ার করে পাঠিয়েও দিলেন।
অডিটরি হ্যালুসিনেশন ঘটনা- ৩
২০১৫ সালে নিউইয়র্কে এক ট্যাক্সি ড্রাইভার পাওয়া যায়, যে হঠাৎ করে ব্যস্ত রাস্তায় লোকজনের উপর ট্যাক্সি তুলে দেয়। পুলিশ তাকে এ্যারেস্ট করলে সে জানায়, একটা গায়েবী আওয়াজ তাকে এই কাজ করার আদেশ দিয়েছে।
অডিটরি হ্যালুসিনেশন ঘটনা- ৪
দেশের একটা খবর দেই। ২০১৬ সালে ফরিদপুরে তাসলিমা বেগম রাত ৩ টায় তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার পরে গায়েবী আওয়াজ শুনতে পান। এই আওয়াজে তাকে আদেশ দেওয়া হয়, তার শিশু বাচ্চা দুটোকে খুন করতে হবে। গায়েবী আদেশ শুনে মা তাসলিমা তখন তার ঘুমন্ত দুই শিশু সন্তান তকী এবং তাসমি কে গলা টিপে হত্যা করেন। [১]
অডিটরি হ্যালুসিনেশন কতটা বিপজ্জনক?
এই ধরনের হ্যালুসিনেশন রোগী খুবই বিপজ্জনক। গায়েবী আওয়াজ শুনে অনেক বিপজ্জনক কাজ করতে পারেন তারা খুব সহজে। ঠিক কতটা বিপজ্জনক তার কিছু উদাহরণ উপরে পড়েছেন। আশেপাশের অপরিচিত মানুষ তো দুরের কথা, কাছের মানুষ এমনকি নিজের বউ বাচ্চাকেও খুন করতে পারের এই ধরনের আক্রান্ত ব্যাক্তিরা। এমনকি নিজেও হয়ে উঠতে পারেন আত্মহত্যা প্রবণ।
এই প্রসঙ্গে আবারও ফিরে যাচ্ছি জুলিয়ান এ্যাসাঞ্জ প্রসঙ্গে, কারন তিনিও (জুলিয়ান এ্যাসাঞ্জ) আত্মহত্যা প্রবণতার ঝুঁকির মধ্যে আছেন। কিছুদিন আগে জেলখানার অভ্যন্তরে তার বিছানা থেকে একটি ছুরি উদ্ধার করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে তিনি লুকিয়ে আত্মহত্যার উদ্দেশ্যেই ওই ছুরিটা যোগাড় করে নিজের কাছে রেখেছিলেন। [২]
শেষ কথা
গায়েবী আওয়াজ/অডিটরি হ্যালুসিনেশন এবং অন্যান্য মানসিক রোগ সম্পর্কে সচেতনতা দরকার। এটা অলৌকিক কিছু নয় আবার এটা পাগলামিও নয়। যদিও একটু সময় লাগে তার পরেও উপযুক্ত চিকিৎসায় এই রোগ ভাল হয়ে রোগী স্বাভাবিক জীবনে ফেরে আসেন। আর অবহেলায় এই রোগের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাবে রোগীর প্রানহানী পর্যন্ত ঘটতে পারে।
এধরনের রোগী সহ যে কোন মনসিক রোগের জন্য প্রথমে সচেতন হতে হবে পরিবারকে। আপনার পরিবারে মানসিকভাবে অসুস্থ্ সদস্যটির জন্য যতটা দ্রুত সম্ভব যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন। এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত চিকিৎসা গ্রহণ করতে সাহায্য করুন।
সকলের প্রতি অনুরোধ আপনার আশেপাশে এইরকম লক্ষন-উপসর্গ নিয়ে যারা চলাফেরা করছেন তাদের জ্বীন-ভুতের আছর বা গায়েবী শক্তি মনে না করে দ্রুত তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। বা তাঁর পরিবারকে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিন। আপনার এই সচেতনতা ও প্রচেষ্ঠা হয়তো অন্য কাউকে ফরিদপুরের তাসলিমা বেগমের মতন মর্মান্তিক ঘটনার শিকার হতে রক্ষা করবে।