মেটা (Meta) এবং ইউনিভার্স (Universe) শব্দ দুটি থেকে এসেছে মেটাভার্স (Metaverse) শব্দটি। আর এই শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয় ১৯৯২ সালে ‘স্নো ক্র্যাশ’ নামক সায়েন্স ফিকশন উপন্যাসে। উপন্যাসের লেখক নীল স্টিফেনসন তার বৈজ্ঞানিক এই কল্পকাহিনীতে দেখিয়েছেন যে, বিভিন্ন অ্যাভাটার বা ডিজিটাল চরিত্ররা থ্রি-ডাইমেনশনে একে অপরের সাথে দেখা করতে সক্ষম।
তখনকার সময় এটা নিছক কল্পকহিনী হলেও মুলত এখান থেকেই মেটাভার্সের আইডিয়া শুরু হয়েছে। এর পরে মেটাভার্স প্রযুক্তির প্রথম ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায় ভার্চুয়াল রিয়েলিটির গেইম ‘সেকেন্ড লাইফ’ -এ, তবে তা ছিলো কিছুটা সীমিত আকারে।
বর্তমান সময়ে ফেসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম সহ বড় বড় সোশ্যাল মিডিয়া ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে যখন সোশ্যাল ডিলেমা তৈরির অভিযোগ উঠছে ঠিক এরই মধ্যে ফেসবুকের মুল প্রতিষ্ঠান মেটা (Meta) খুব ঘটা করে মেটাভার্স নিয়ে কাজ শুরু করেছে। প্রতিষ্ঠানটির লক্ষ পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যে অনলাইন জগৎটাকে পুরোপুরি বদলে দেওয়া। তো কি আছে এই মেটাভার্সে? আসুন জেনে নেওয়া যাক।
মেটাভার্স কি?
মেটাভার্সকে ধরা হচ্ছে ইন্টারনেট প্রযুক্তির পরের ধাপ। মুলত বাস্তব আর ভার্চুয়াল জগতের মধ্যে একটি সমন্বয় বা সংযোগ ঘটাতে যাচ্ছে এই প্রযুক্তিটি। আপনি ঘরে বসেই সেরে ফেলতে পারবেন অফিসের কাজ সহ যাবতীয় সব দরকারি মিটিং অথবা কেনাকাটা। আপনি নিজে স্ব-শরীরে উপস্থিত না থাকলেও সেখানে থাকবে আপনার ডিজিটাল উপস্থিতি। অর্থাৎ বাস্তব জগতের সম্পূর্ণ বাইরের একটি জগৎ যেখানে আপনার পদচারণা থাকবে ডিজিটলি বা ভার্চুয়াল।
ধরুন আপনি চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন বন্ধুদের সাথে আর কফি খাচ্ছেন রেস্টুরেন্টে বসে। অথবা, বাইক কিংবা গাড়ি নিয়ে লং ড্রাইভে যাচ্ছেন আপনার বন্ধু অথবা বান্ধবিকে নিয়ে, আবার ডেটও করতে পারবেন আপনার পছন্দের মানুষের সাথে, যদি তারও আপনাকে ভাল লেগে যায়। ইচ্ছে হলে শপিংও করতে পারবেন, ভাল লাগা পোশাকগুলো ট্রায়াল দিয়ে দেখবেন আবার ভাল লাগলে সেটা কিনেও নিতে পারবেন।
আর এগুলোর সবই হচ্ছে অনলাইনের দুনিয়াতে, মানে ভার্চুয়ালি এবং আপনি বসে আছেন চার দেয়ালের মধ্যে নিঃশব্দ অন্ধকারে, চোখে লগিয়ে অগুমেন্টেড ভারচুয়াল রিয়েলিটি ডিভাইস। মোট কথা অফিস শেষ করে বা পড়ালেখার ফাকে পাড়ার মোড়ে চুটিয়ে বাস্তব আড্ডা ছেড়ে ভার্চুয়ালি দিনের পর দিন আপনি আর একটা দুনিয়া সাজাবেন সেখানে আড্ডা দেবেন, ঘুরে বেড়াবেন।
মেটাভার্সের ব্যবহার
বর্তমান সময়ে মেটাভার্স নিয়ে আলোচনা শুরু হলেও এর প্রথম ব্যবহার শুরু হয় ২০০৩ সালে ’সেকেন্ড লাইফ’ ভিডিও গেমটির মাধ্যমে। যদিও এখানে মেটাভার্সের ব্যবহার ছিলো কিছুটা সীমিত পরিসরে। এর পরে আরো কিছু এই প্রযুক্তির ভার্চুয়াল রিয়িলিটি গেম বাজারে এসেছে যেগুলোতে মেটাভার্স প্রযুক্তির ব্যবহার রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেঃ
- Decentraland
- Axie Infinity
- The Sandbox
- Yield Guild Games
- Mines of Dalarnia
- Chromia
- Gala.
বাস্তব অুনুভুতি পেতে হ্যাপটিক গ্লোভস (Haptic Gloves)
সম্প্রতি ফেসবুকের করপোরেট অরগানাইজেশন মেটা (Meta) ঘোষনা দিয়ে বেশ জোরেসোরেই মেটাভার্স নিয়ে কাজ শুরু করেছে। তবে তা পুরোপুরি বাস্তবতা পেতে হয়তো আরো কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে। ভারর্চুয়াল রিয়েলিটিকে আরো বাস্তবিক করতে মেটা কর্তৃপক্ষ বেশ জোরেশোরে কাজ করে যাচ্ছে।
ত্রিমাত্রিক এই ভার্চুয়াল জগতে মেটাভার্স ব্যবহারকারীরা এমনভাবে তাদের কথোপকথন করতে পারবেন অথবা দৈনন্দিন কাজে অংশ নিতে পারবেন, যেন বাস্তাবিক একে অপরের পাশেই রয়েছেন। তবে শুধুমাত্র কথোপকথন বা দর্শনই নয়, বাস্তবে স্পর্শের অনুভুতি পেতেও প্রতিষ্ঠানটি কাজ করে যাচ্ছে।
মেটাভার্সে এখন পর্যন্ত দেখা কিংবা শোনার বিষয়ে আটকে নেই, পরিকল্পনা চলছে এরই সাথে কিভাবে স্পর্শের অনুভূতি পাওয়া সম্ভব সে বিষয়েও। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ এগিয়েছে অনেকটা। ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটা (META), তারই একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান দ্য রিয়েলিটি ল্যাবসে তৈরি হচ্ছে বিশেষ প্রযুক্তির হাতে পড়া গ্লাভস বা দস্তানা। যে দস্তানা বা গ্লোভস হাতে লগিয়ে মেটাভার্স ব্যবহারকারিরা স্পর্শের অনুভুতি পেতে সক্ষম হবেন।
সম্প্রতি মেটা আনুষ্ঠানিকভাবে তদের দ্যা রিয়েলিটি ল্যাবে তৈরি দস্তানা হ্যাপটিক গ্লোভসের (Haptic Gloves) একটি প্রোটোটাইপও উপস্থাপন করেছে।
কিভাবে যুক্ত হবেন মেটাভার্স প্রযুক্তির সাথে?
মেটাভার্স প্রযুক্তিতে অনলাইনে আপনার নিজের একটি ভার্চুয়াল অবয়ব (যেটাকে বলে অ্যাভার্টার) বা চরিত্র থাকবে যা অনলাইন দুনিয়ায় আপনার প্রতিনিধিত্ব করবে। আপনি সেখানে আপনার নিজে আলাদা একটি আইডেনটিটি নিয়ে ঘুরে ফিরে দৈনন্দিন কাজ করে বেড়াবেন, অন্যান্য চরিত্রের সঙ্গে নানা কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারবেন। অবশ্য অন্যান্য চরিত্র যেগুলো থাকবে তারাও কারো না কারো অ্যাভার্টার বা ডিজিটাল অবয়ব।
উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যে, আপানি এখন গুগল ম্যাপে কক্সবাজারের স্ট্রিট ভিউ দেখতে পারছেন, ভাবষ্যতে মেটাভার্সের কল্যাণে বাড়ি বসে সেখানে থেকে অথবা ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞাতাও নিতে পারবেন। সগারের ঠান্ডা পানিতে পা ডোবানোর অনুভুতিও পাবেন।
মোট কথা ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ব্যবহার করে তৈরি করা একটি ডিজিটাল জগৎ যেটাকে বাস্তব দুনিয়ার সাথে যোগাযোগ ঘটানো হয়েছে, সেখানে আপনি হরহামেশাই প্রবেশ করতে পারবেন। তবে সেক্ষেত্রে আপনাকে ব্যবহার করতে হবে অগুমেন্টেড ভারচুয়াল রিয়েলিটি ডিভাইস/হেডসেট ও হাতে লাগাতে হবে বিশেষ প্রযুক্তির তৈরি হ্যাপটিক গ্লোভস।
মেটাভার্স আশির্বাদ না অভিশাপ?
যদিও বর্তমান সময়ে অনলাইন অ্যাডভান্স প্রযুক্তি হিসাবে মেটাভার্সকেই ধরা হচ্ছে, তার পরেও এই প্রযুক্তি মানুষের জন্য কতটা উপকার বা ক্ষতির করন হবে তা বুঝতে আরো অপেক্ষা করতে হবে আমাদের। ন্যানো টেকনোলজি ও মেশিন লর্নিং মানুষের সুক্ষ কাজগুলোকে আরো সহজ ও নিশ্চিত করছে। জটিল জটিল রোগের চিকিৎসায় গবেষকরা সফলতা খুজে পাচ্ছেন প্রযুক্তির সহায়তায়।
এইতো কিছুদিন আগে যখন কোভিড ছিলোনা তখন ঘরে বসে অফিস করার কথা আমরা ধারণাও করতে পারতাম না, কিন্তু এখন অফিস করা সহ মিটিং, কনফারেন্স সবই হচেছ ঘরে বসেই। তবে মেটাভার্স আরো এগিয়ে, এখানে আপনি ভার্চুয়ালি হলেও সকলের সাথে বসে কাজ করার অথবা মিটিং করার অনুভুতি পাবেন।
তবে এই প্রযুক্তির সাথে ঝুঁকিও আছে অনেক। যেহেতু অনেক কিছুরই খোল-নালচে সহ পাল্টে যাবে, তাই একটা প্রজন্ম বিরাট একটা ধাক্কা খাবে নিশ্চিত। প্রফেশনাল মুভি ক্যামেরা থেকে এখন হাতের মুঠোতে মোবাইলের সাথে ক্যামেরা চলে এসেছে এটা যেমন একটা পরিবর্তন, তেমনি এই মেটাভার্সও পাল্টে দেবে পৃথিবীর মানুষের জীবনযাত্রা। সেখানে অভ্যস্ত হতে এটকু সময়তো লাগবেই।
অ্যাডভান্স টেকনলোজি মানুষের জীবনধারণকে যেমন আরো সহজ করছে পাশাপাশি একটি বিপুল পরিমান কর্মক্ষেত্রও চলে যাচ্ছে টেকনোলটজির দখলে। ফলে মানুষ দিনে দিনে আরো বেশি নির্ভর হয়ে পড়ছে প্রযুক্তির উপর। শুধুমাত্র বোতাম টিপে কাজ করার অভ্যাস একদিন হয়তো তৈরি করবে মানসিক বৈকাল্য আর স্থুলতা।
মেটাভার্স ও এর আসক্তি দিনে দিনে মানুষকে আরো একাকী করে দিতে পারে। বিষয়টা ঠিক এমন যে, বন্ধু, আড্ডা, ব্যস্ততা সহ সককিছুই থাকবে তবে তা ভার্চুয়ালী! আর আাপনি এবং আপনার শরীরটা থাকবে চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি এবং স্থবির। তার পরেও ভবিষ্যৎ প্রযুক্তিকে আমরা কখনওই ফেলে দিতে পারবো না, তাকে আমাদের গ্রহণ করতেই হবে, আর এটাই সময়ের দাবী।