এবার এমন একটা প্রসঙ্গে আলোচনা করতে বসেছি যা সম্বন্ধে আমার প্রাতিষ্ঠানিক কোন লেখাপড়া, গবেষণা বা অভিজ্ঞতা নেই। কিন্তু বিজ্ঞানের সাথে সংযোগ রক্ষা না করতে পারলে, কুসংস্কার আর কুপমন্ডুকতার অন্তরালে ক্রমশ অচল হতে হতে একসময় হয়তো আমরা এক্সটিংক্ট হয়ে পড়ব, এই ভাবনা থেকেই বিভিন্ন প্রসঙ্গে সময় পেলেই লেখার চেষ্টা করি। গ্রহান্তরে মানুষের বসবাস- সমস্যা এবং সম্ভাবনা! নিয়ে ভাবতে গেলে দুটো আলাদা বিষয় বিবেচনায় আনতে হবে।
- অন্য বাসোপযোগী গ্রহে এলিয়েন জাতীয় প্রানী থাকার সম্ভাবনা
- পৃথিবীর মানুষের পক্ষে অন্য গ্রহে বসবাস করার সম্ভাবনা।
প্রথমটার সন্ধানে এস্ট্রোফিজিসিস্ট এবং এস্ট্রোবায়োলজিস্টরা নিরবিচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। দ্বিতীয়টার ব্যাপারে কাজ শুরু হয়েছে মূলত মহাশুন্যে অভিযান, চন্দ্রে মানুষের পদার্পন, মঙ্গলে মহাশুন্যযান পাঠানো ইত্যাদি থেকে। আমরা এই প্রবন্ধে মূলত মানুষের গ্রহান্তরে উপনিবেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে কথা বলবো।
প্রথম দিকের উচ্ছাস ইতোমধ্যেই কিছুটা কমে এসেছে, তবে উদ্যোগ এখনও বজায় রয়েছে। এখন বুঝতে পারা যাচ্ছে গ্রহান্তরে উপনিবেশ অতটা সহজ হবে না। Mars, অর্থাৎ মঙ্গল গ্রহ কে এক্ষেত্রে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ক্যান্ডিডেট হিসাবে ধরা হয়। মঙ্গল গ্রহে বিভিন্ন ধরনের মনুষ্যবিহীন স্পেসক্রাফট পাঠানো হচ্ছে এর ভূতাত্মিক জরীপ চালানোর জন্য।
কিছুটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে ইতোমধ্যেই। তবে কেউ কেউ প্রতিবাদ করছেন মঙ্গলে উপনিবেশ না গড়ে আমরা সেই টাকা দিয়েই পৃথিবীকে আরও সুন্দরভাবে বসবাসের উপযোগী করে তুলতে পারি। পৃথিবীর যুদ্ধ-বিগ্রহ, অস্ত্র প্রতিযোগিতা, বৈষম্য ইত্যাদি দূর করে ন্যায্যতা আর সমতার ভিত্তিতে এক শান্তিময় পৃথিবী আমরা তৈরি করতে পারি আমরা, কিন্তু সে সম্ভাবনার বাস্তবিকতা আসলে নেই। এখন আমরা মঙ্গলে বসবাস করার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করব।
মার্সের ভুপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট এবং মঙ্গলে স্থায়ীভাবে বসবাসের সমস্যা
মঙ্গলের রয়েছে একটা হালকা বায়ুমন্ডল যাতে অক্সিজেনের (পৃথিবীর তুলনায় ১% এর মত) পরিমান অত্যন্ত কম, তাপমাত্রা অনেক কম, পৃষ্ট দেশে তরল পানি নেই, ক্ষতিকর রেডিয়েশনের মাত্রা অনেক বেশী। তাছাড়া মঙ্গলের ভর পৃথিবীর ভরের প্রায় অর্ধেকের মত, সেই অনুযায়ী মঙ্গলের মহাকর্ষ বল অনেক কম, মানুষের পক্ষে সোজা হয়ে হাটা এখানে অনেক দুরুহ।
সমতল ভুমি কম থাকায় ঘর বাড়ী বানানো কঠিন। মার্সের বায়ুমন্ডল অনেক হালকা হওয়ায় এখানে মহাকাশযানের উঠা-নামা কঠিন, সবচেয়ে কঠিন ব্যাপার হচ্ছে ল্যান্ডিং করা, কারন বিশাল গতিবেগ থেকে ল্যান্ডিং এর জন্য ধীরগতিতে ফিরে আসা এই হালকা বায়ুমন্ডলে বেশ কঠিন।
মনুষ্যবিহিন হালকা স্পেস্ক্রাফটের পক্ষে সম্ভব হলেও মনুষ্যবাহী ভারী মহাকাশযানের পক্ষে তা অসম্ভব। এর জন্যে নানারকম গবেষণা করা হচ্ছে যাতে এই গতিবেগ কমানোর ব্যবস্থা করা যায়। রেডিয়েশন থেকে অভিযাত্রীদের বাচানোর জন্য ন্যানোটেকনোলজী ব্যবহার করে রেডিয়েশন প্রতিরোধী স্পেসসুট তৈরি করা হচ্ছে এবং এগুলি পৃথিবীপৃষ্ঠেই পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে।
আরেকটা সমস্যা হচ্ছে পৃথিবী থেকে মঙ্গলের যোগাযোগ করা। পৃথিবী থেকে মঙ্গলের যোগাযোগ করতে তথ্য আসা যাওয়ার সময় হিসাব করলে গড়ে প্রায় ৪০ ১৪ দিন সুর্য্য পৃথিবী এবং মঙ্গলের মাঝে অবস্থান করে, এসময় ইলেক্ট্রোম্যাগ্নেটিক তরঙ্গ সুর্যের শক্তিশালী তড়িৎচৌম্বকীয় ক্ষেত্র পার হয়ে মঙ্গলে পৌছাতে পারে না, ফলে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকে।
এসব সমস্যা সমাধানের জন্যও ভাবনা চিন্তা করা হচ্ছে, মাঝখানে Relay station বসিয়ে, এবং লেসারের সাহায্যে দ্রুতগতির যোগাযোগের চিন্তা করা হচ্ছে। এগুলো তো গেল মঙ্গলে স্পেস-ক্র্যাফট পাঠানোর সমস্যা নিয়ে, মঙ্গলে স্থায়ীভাবে বসবাস করা তো আরও কঠিন।
Terraforming Mars (মার্স কে পৃথিবীর মত রূপান্তরকরণ)

মার্স কে পৃথিবীর মত রূপান্তরকরণ করতে গেলে বিশাল অংকের টাকা খরচ হবে, এবং বর্তমান প্রযুক্তিতে তা করা আদৌ সম্ভব কিনা এনিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। প্রথমে লাগবে বিশাল বড় এক বা একাধিক প্রতিফলক বা Reflector যাকে মহাশূন্যে স্থাপন করে সুর্যের আলো এবং তাপরশ্মিকে মার্সের দিকে ধাবিত করতে হবে।
বিভিন্ন রকম Oxygen concentrator এর মাধ্যমে অক্সিজেন এর মাত্রা বৃদ্ধি করতে হবে, মার্সের চৌম্বক ক্ষেত্র বাড়িয়ে আবার বায়ুমন্ডলকে ধরে রাখতে হবে। Green House effect পদ্ধতি ব্যবহার করে ইগ্লু টাইপের বাড়ীঘর নির্মান করতে হবে যা আবার রেডিয়েশন ঝুকিও কমিয়ে রাখবে।
অক্সিজেন সিলিন্ডার ব্যবহার করতে না চাইলে মার্সের জলবায়ুকে নিঃশ্বাস উপযোগী এবং বসবাস উপযোগী করে তুলতে হবে। বর্তমান টেকনোলজিতে মার্স কে পৃথিবীর মত করে গড়ে তুলতে হলে কয়েক কুয়াডৃলিয়ন (Quadrillions) ডলার খরচ হবে এবং কয়েক শত বছর থেকে কয়েক হাজার বছর লেগে যাবে। সাথে প্রযুক্তিগত উন্নতি তো অবশ্যই লাগবে।
আমাদের ভবিষ্যত
সভ্যতার লড়াইয়ে আমরা এখন ব্যতিবাস্ত কে কাকে ছাড়িয়ে যাবে এই প্রতিযোগিতায়, আমরা পৃথিবীকে মার্সে পরিনত করার খেলায় মত্ত অথচ এর থেকে অনেক কম খরচে আমরা পৃথিবীকে বসবাস উপযোগী করে রাখতে পারি, প্রয়োজন শুধু লোভ, ঘৃনা, অজ্ঞতা, স্বার্থপরতা, শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই ইত্যাদি ত্যাগ করা, এবং সাম্য, ন্যায্যতা, ও সৌহার্দের ভিত্তিতে সমাজ গড়ে তুলা।
আমরা জানি পরের এই প্রস্তাবনা আদৌ বাস্তবায়িত হবে না, সুতরাং আমরা এগিয়ে যাব আমাদের নিয়তির দিকে, আমাদের অবলুপ্তির দিকে। অন্য কোন প্রজাতি এসে পৃথিবী দখল করা না পর্যন্ত। আবার উল্টোটাও হতে পারে, হয়ত একসময় আমরা বসতি গেড়ে বসবো মঙ্গল বা অন্য কোন গ্রহে।