অনেকেই ধারণা করে থাকেন যে, নারীদের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা কম। তবে কিছু পরিসংখ্যানের তথ্য আমাদের জানাচ্ছে , আদতে এমনটি ভাবার মতন কোন অবকাশ নেই। বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে নারীদেরও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভানা অনেকাংশে পুরুষের তুলনায় বেশিই রয়েছে। সেই বিষয়গুলোই আজকের আলোচনাতে উঠে আসবে।
বেশ কিছু কারনে নারীদের হৃদরোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। যেমন, আর্থসামাজিক বৈষম্য, হরমোন এবং জেনেটিক প্রভাব, হরমোনজনিত জন্ম-নিয়ন্ত্রন। এছাড়া পুরুষের তুলনায় নারীদের দৈহিক গঠনের পার্থক্য থাকার কারণে হার্টের চেম্বারগূলো যেমন ছোট থাকে তেমন হার্টের করোনারী রক্তনালীগুলোও চিকন হয়। যার ফলে হার্টের ভাল্ভগুলোও তুলনামূলকভাবে সরু হয়। আর এই কারনে নারীদের হার্ট ভাল্ভগুলো খুব তাড়াতাড়ি দুর্বল হয়ে বা রোগে আক্রান্ত হয়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনাকে অনেক বেশি বাড়িয়ে তোলে। যুক্ত্ররাস্ট্রে ২০২১ সালে পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে প্রতি ৫ জনে ১জন নারীর মৃত্যু হয় বিভিন্ন ধরনের হার্টের রোগের কারনে।1
হার্টের রোগের প্রত্যেকটা ক্যাটেগরীতেই নারীরা আক্রান্ত হন, এরমধ্যে যেমন রয়েছে ভাল্ভের রোগ, জন্মগত হার্টের রোগ, করোনারী হার্টের রোগ, হার্টের টিউমার, ছন্দপতন জনিত সমস্যা ছাড়ও আরো অনেক কিছু। বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসাক্ষেত্রেও রয়েছে ফলাফলের বিভিন্নতা, তাছাড়া এই চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণের ক্ষেত্রেও নানাধরনের প্রতিকূলতা রয়ে গেছে নারীদের ক্ষেত্রে। আমরা এই প্রবন্ধে পর্যায়ক্রমে এই বিষয়গূলো নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করব।
হার্টের ভাল্ভের সমস্যা
বাতজ্বর জনিত হার্টের সমস্যায় আক্রান্ত হন মেয়েরা সবচেয়ে বেশী। এশিয়া এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে পর্যবেক্ষন এবং পরীক্ষানিরীক্ষা করে এই বিষয়ে প্রমান পাওয়া গিয়েছে। এক্ষেত্রে নারীদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা পুরুষদের তুলনায় প্রায় দুইগুন।2 তুলনামুলকভাবে অপুষ্টি, বসবাসের জন্য খারাপ পরিবেশ, বারবার সন্তানধারণ, চিকিৎসার ব্যাপারে বৈষম্য ইত্যাদি নানাবিধ কারণ সমুহকে চিহ্নিত করা হয়েছে এর জন্য।
শুধু তাই নয়, সরু হয়ে যাওয়া ভাল্ভকে প্রসারিত করার বেলুন ডাইলেটেশন প্রক্রিয়াতেও নারীদের অংশগ্রহন এবং ফলাফল পুরুষদের তুলনায় কম। ভাল্ভ পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও একই ধরনের ফলাফল পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে।3
হার্টের ৪ টি ভাল্ভ অর্থাৎ মাইট্রাল ভাল্ভ, এওর্টিক ভাল্ভ, পালমোনারি এবং ট্রাইকাস্পিড ভাল্ভের ক্ষেত্রে সবসময় এই পার্থক্য দেখা যায়। মেয়েদের শরীরের আকার, ওজন, বডি সারফেস এরিয়া ইত্যাদি কম থাকার কারনে সাধারণত ছোট আকারের ভাল্ভ লাগানোর প্রয়োজন হয়, যার ফলে পুনরায় তাদের ভাল্ভের রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেশী থাকে। এছাড়াও অপারেশন পরবর্তী জটিলতাও রয়েছে নারীদের ক্ষেত্রে তুলনামুলক বেশী।
আরো পড়ুন:
হার্টের করোনারী রোগ
মেয়েদের এস্ট্রোজেন হরমোন একজাতীয় প্রটেকশন দেয় এই রোগ থেকে। তবে সার্জারী অথবা মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়ার (মেনোপজ) কারনে নারীদের এস্ট্রোজেন হরমন স্বল্পতা তৈরি হয়। ফলে তখন করোনারী হার্ট ডিজিজ পুরুষদের মতই নারীদেও হতে থাকে। আবার হরমোন দিয়ে মেনোপজের চিকিৎসা করলেও করোনারী হার্ট ডিজিসের সম্ভাবনা বাড়ে।
তাছাড়া ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, বিভিন্ন বিপাকজনিত সমস্যা মেয়েদের বেশী থাকায় তারা হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন বেশী। আবার নারীদের মধ্যে ধূমপান বেড়ে যাওয়া, এলকোহল পানের মাত্রা বেড়ে যাওয়া, শারীরিক পরিশ্রম না করার প্রবনতাও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম কারন।
জন্মগত হার্টের ত্রুটি
যত ধরনের জন্মগত হার্টের ত্রুটি রয়েছে সাধারনত মেয়েদের ক্ষেত্রেই সেগুলো বেশী লক্ষ করা যায়। সাম্প্রতিক কালের একটি পরিসংখ্যান ঠিক এই তথ্যটিই প্রমান করেছে।4 এছাড়াও হার্টের কিছু ছোট ছোট রক্তনালীর রোগ বিশেষ করে মাইক্রোভাস্কুলার রোগ মেয়েদের বেশী হয়।
হার্টের আরও যে সকল রোগে নারীরা আক্রান্ত হন
হার্টের বিভিন্ন ধরনের টিউমার, ছন্দের সমস্যা, হার্ট ফেইলিয়র, হার্টের পর্দার রোগ বিশেষ করে পেরিকারডিয়ামের টিবি রোগ মেয়েদের মধ্যে বেশী। অবশ্য মেয়েদের ক্ষেত্রে রোগের লক্ষণসমূহও কিছুটা ভিন্ন হয়।
হৃদরোগে আক্রান্ত নারী রোগীদের বুকে ব্যাথার ধরনও কিছুটা আলাদা, তাছাড়া বুক ধড়ফড় করা, বমি ভাব হওয়া, ক্ষুধামন্দা তৈরি হওয়া, ক্লান্তি অনুভব করা, পেটে ব্যাথা হওয়া ছাড়াও কোন কোন সময় মানসিক রোগীর মত আচরণ হৃদরোগের লক্ষন হিসাবে প্রকাশ পেতে পারে। তাই রোগীর লক্ষণ বা সমস্যাকে অবহেলা না করে গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিৎ।
উপসংহার
উন্নয়নশীল দেশ সমুহে নানাবিধ সামাজিক প্রতিবন্ধকতায় মেয়েদের হার্টের রোগের প্রকৃত পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। তাছাড়া এইসব দেশে লক্ষণ সমূহকে গুরুত্ব না দেওয়া, বা গোপন করা অন্যতম কারন হিসাবে বিভিন্ন পরিসংখ্যানে বের হয়েছে।
অনেক সময় অল্প অল্প লক্ষন প্রকাশ পেলেও তাকে অবহেলা করা হয়, ফলে গর্ভকালীন সময়ে, অথবা বেশি বয়সে গিয়ে যখন রোগটা ধরা পড়ে তখন শুধু চিকিৎসার জটিলতাই বাড়ে। অনেকসময় যথাযথ ফলাফলও পাওয়া যায়না। তাই নারীদের হৃদরোগকে সবসময় গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা উচিৎ।
রেফারেন্স
- Women and Heart Disease -Centers for Disease Control and Prevention (CDC) ↩︎
- Prakash Chand Negi, Arvind Kandoria, Sanjeev Asotra, Neeraj Kumar Ganju, Rajeev Merwaha, Rajesh Sharma, Kunal Mahajan, Shivani Rao, Gender differences in the epidemiology of Rheumatic Fever/Rheumatic heart disease (RF/RHD) patient population of hill state of northern India; 9 years prospective hospital-based, HP-RHD registry ↩︎
- Mutagaywa RK, Wind A-M, Kamuhabwa A, Cramer MJ, Chillo P, Chamuleau S. Rheumatic heart disease anno 2020: Impacts of gender and migration on epidemiology and management. Eur J Clin Invest. 2020;50:e13374. ↩︎
- Engelfriet, P., & Mulder, J. M. (2009). Gender differences in adult congenital heart disease. Netherlands Heart Journal, 17(11), 414-417. ↩︎