ডাঃ ক্রিশ্চিয়ান বার্নারড (Dr. Christiaan Barnard ) ১৯৬৭ সালে দক্ষি্ন আফ্রিকায় প্রথম মানুষ থেকে মানুষের হার্ট ট্রান্সপ্লান্টেশন করেন। এটা হঠাত করে ঘটেনি, এর আগে বেশ কিছুদিন ধরেই আমেরিকাতে এটা নিয়ে গবেষণা এবং টেকনিক্যাল দিকগুলো নিয়ে অনেক কাজ চলছিলো এবং ক্রিশ্চিয়ান বার্নারড ওই টিমেই কাজ করতেন। গবেষনা যখন প্রায় শেষ পর্যায়ে তখন তিনি নিজের দেশে ফিরে আসেন এবং রাতারাতি হার্ট ট্রান্সপ্লান্টেশন করে বিশ্ববিখ্যাত হয়ে যান।
হার্ট ট্রান্সপ্লান্টেশনের প্রাথমিক কাজগুলোতে বিশেষ করে Alexis Carrel, Frank Mann, Norman Shumway, এবং Richard Lower এর অবদান অনস্বীকার্য। একটু সহজ করে হার্ট ট্রান্সপ্লান্টেশন সম্বন্ধে কিছু ধারনা দেওয়া হয়েছে এই লেখাটিতে। আশা করি হার্ট ট্রান্সপ্লানটেশন সম্পর্কে আপনার অনেক কৌতুহল মেটাবে এই লেখাটি।
প্রথমদিকে শিম্পাজির হার্ট মানুষে ট্রান্সপ্লান্ট করার চেষ্টা করা হয়। যথারীতি তা ব্যার্থ হয়। যদিও মানুষের সাথে শিম্পাঞ্জীর জীনের প্রায় ৯৫-৯৭% মিল রয়েছে তা স্বত্বেও প্রচেষ্টাটি ব্যার্থ হয়ে যায়। আজকাল অবশ্য শুকরের ভ্রুণকে মানুষের HLA Gene দ্বারা প্রতিস্থাপিত করে ট্রান্সপ্লান্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে, এবং কিছু সফলতার আভাষও তাতে পাওয়া যাচ্ছে। মনব শরীর থেকে প্রাপ্ত হার্ট, কিডনী, লিভার ইত্যাদি Organe স্বল্পতার কারনেই এসব করা হচ্ছে।
প্রথম হার্ট ট্রান্সপ্লান্টেশনের রোগী মাত্র ১৮ দিন বেঁচে ছিলেন, তার পরের জন ১৯মাস বেঁচে ছিলেন। এখন ট্রান্সপ্লান্টেশনের পর ১বছর বেঁচে থাকেন ৯০% রোগী আর ৫বছর বাঁচেন ৭০% রোগী, এদের ভিতর অনেকেই ১০ বছরের বেশী বেঁচে থাকেন। Donor এবং Recipient এর বাছাইকরণ আরও ভালোভাবে করা, ইনফেকশন নিয়ন্ত্রন করা, বিভিন্ন নতুন ধরনের প্রত্যাখ্যান বিরোধী ঔষধের প্রয়োগ দীর্ঘমেয়াদী ফলাফল দিচ্ছে এবং এ ব্যাপারে উত্তরোত্তর উন্নতি পরিলক্ষিত হচ্ছে।
বাংলাদেশে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশনের সফলতা বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর মতোই কিন্তু লিভার এবং হার্ট ট্রান্সপ্লান্টেশনে এখনও আমরা পিছিয়ে আছি। হার্ট ট্রান্সপ্লাটেশনের বড় বাধা হচ্ছে উপযুক্ত ডোনরের অভাব, হার্ট যেহেতু একটাই তাই এখানে হার্ট ডোনেশনের আগে ডোনরের ব্রেন ডেথ (DBD, Deceased brain death donor) , অথবা কার্ডিয়াক ডেথ (DCD, Deceased circulation death donor) হতে হবে, এ ছাড়াও ট্রান্সপ্লান্ট পরবর্তী বিশাল খরচ আর নিয়মিত Follow up তো রয়েছেই।
কার্ডিয়াক ডেথের ক্ষেত্রে মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই হার্টকে কার্ডিওপ্লেজিয়া দিয়ে বন্ধ করে ফেলা হয় এবং ঠান্ডা স্যালাইনে ডুবিয়ে তাকে গ্রহীতার কাছে নেওয়া হয়। ছোট বাইপাস মেশিন ব্যবহার করে এই হার্টকে বিটিং অবস্থায়ও (Reanimation) ট্রান্সফার করা যায়।রিএনিমেটেড হার্টের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত ভালো ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে এবং এখানে হার্টকে ঠান্ডা করার পরিবর্তে উষ্ণ এবং বিটিং অবস্থায় রাখা হয়।
গ্রহীতা যদি অপারেশনের পুর্বেই কৃত্রিম হার্ট , বিভিন্ন ধরনের এসিস্ট ডিভাইস (MCS, Mechanical Circulatory Support) নিয়ে থাকেন সেখানেও দীর্ঘ মেয়াদী বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কমে যায়। এদের ক্ষেত্রে অনেক সময় এসব এসিস্ট ডিভাইস (LVAD, RVAD, BVAD) অথবা কৃত্রিম হার্ট (TAH, Total artificial heart), ট্রান্সপ্লান্টেশনের মধ্যে সেতুবন্ধন (Bridge to Transplantation) না হয়ে ফাইনাল চিকিৎসা (Destination Therapy) হয়ে কাজ করে।

দুইটি পদ্ধতিতে দাতার হার্ট গ্রহীতার হার্টের সঙ্গে জোড়া লাগানো হয়।
- Biatrial approach- এখানে দাতার হার্টের দুটো এট্রিয়ামকে গ্রহীতার রেখে দেওয়া দুটো এট্রিয়ামের পিছনের অংশের সাথে যোগ করা হয়।
- Bicaval approach- এখানে গ্রহীতার সুপেরিরিয়র এবং ইনফেরিয়র ভেনা কাভার সাথে দাতার ঐ দুইটি শিরা যোগ করা হয়।এখানে বাম এট্রিয়ামের পিছনের অংশ বাম দিকের এট্রিয়ামের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
উভয় ক্ষেত্রেই দাতা এবং গ্রহীতার এওরটা এবং পালমোনারী ট্রাংক কে সংযুক্ত করা হয়।
দাতা হিসাবে কাদের হার্ট গ্রহণযোগ্য?
প্রথম কথা হচ্ছে দাতার হার্ট গ্রহনযোগ্য মাত্রায় সুস্থ থাকতে হবে, এছাড়াও সংক্রামক রোগ যেমন হেপাটাইটিস বি, সি, এইস আই ভি ইনফেকশন, ক্যান্সারের সংক্রমন ইত্যাদি ডোনরকে অনুপযুক্ত করে দেয়। হেপাটাইটিস বি এর ক্ষেত্রে গ্রহীতারও যদি এই রোগ থাকে তবে ট্রান্সপ্লান্ট করা যেতে পারে। যারা শিরার পথে নেশাজাতিয় ড্রাগ গ্রহন করে থাকেন তাদের হার্ট সাধারণত নেওয়া হয়না।
ব্লাড গ্রুপ এক হলে সবচেয়ে ভাল হয় তবে এক না হলেও ট্রান্সপ্লান্ট করা সম্ভব। দাতার শরীরে যদি ১০% এর বেশী গ্রহীতা প্রতিরোধী এন্টিবডি (Pannel reacting Antibody) থাকে অথবা ক্রস ম্যাচিং এর সময় অতিরিক্ত এন্টিবডির প্রমান পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে দাতা হিসাবে ঐ গ্রহীতার জন্য সে অনুপযুক্ত হয়ে যায়, অন্য গ্রহীতার ক্ষেত্রে এই হার্ট আবার ব্যবহার করা যেতে পারে।
দাতার অভাবে এখানে HLA mismatch এর গুরুত্ত্ব কম দেওয়া হয়। প্রতিরোধ বিরোধী ঔষধ (Immunosupressant drug) দিয়েই এখানে রিজেকশন (Rejection) ঠেকানো হয়। দৈহিক ওজনের মিল থাকতে হবে তবে মিল না থাকলে গ্রহিতার শরীরের অন্য কোথাও হার্টকে লাগানো যেতে পারে। তাই হার্ট ট্রান্সপ্লান্টেশন সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে।
- Orthotopic heart transplantation- এখানে গ্রহীতার হার্ট কেটে সরানোর পর সেখানে দাতার হার্ট লাগানো হয়। কোন জিনিষেরই অপচয় করা হয়না। সেই গ্রহীতার হার্টের বিভিন্ন অংশ কেটে কেটে আবার অন্য গ্রহীতার ভাল্ভ, রক্তনালী ইত্যাদি হিসাবে ( Domino technique) ব্যবহার করা যায়।
- Heterotopic heart transplantation- এখানে হার্ট রেখে দিয়েই তার পাশাপাশি দাতার হার্ট ট্রান্সপ্লান্টেশন করা হয়। বুকের পাশে, কোন সময় পেটের অভ্যন্তরে উপরিভাগে এই ট্রান্সপ্লান্টেশন করা হয়। এতে গ্রহীতার হার্টের পাশাপাশি দাতার হার্ট টাও কাজ করতে থাকে। সাইজ মিসম্যাচ হলে সাধারণত এইরকম করা হয়।
গ্রহীতার উপযুক্ততা
যাদের হার্টের কার্যকারিতা একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে গেছে, অন্য কোন উপায়েই তার সুরাহা করা যাচ্ছেনা, জন্মগত মারাত্মক ত্রুটি, মারাত্মক ধরনের করোনারী রক্তনালীর রোগ যা বাইপাস বা অন্যান্য চিকিৎসায় সারানো সম্ভব নয়, ফন্টান অপারেশন (Fontan operation) ব্যর্থ হলে হার্ট ট্রান্সপ্লান্টেশন করা হয়।
তবে যাদের বয়স ৭০ এর বেশি, যাদের মারাত্মক ধরনের হার্টের ডান দিকের প্রেসার বেশী (Irreversible PVR> 5 Wood unit, PASP >60 mm of Hg), যাদের মারাত্মক ধরনের কিডনি, লিভারের রোগ রয়েছে, ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়েছে এমন রোগী, যাদের কিছুতেই নেশা জাতীয় দ্রব্য থেকে নিবৃত করা যাচ্ছেনা, মানসিকভাবে যারা পর্যুদস্ত তাদের সাধারণত ট্রান্সপ্লান্ট করা হয়না। যাদের হার্টের দান দিকের প্রেসার অনেক বেশী তাদের একইসাথে হার্ট এবং লাংস ট্রান্সপ্লান্ট করা হয়।
হার্ট ট্রান্সপ্লান্টেশনের চ্যালেঞ্জ
সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে উপযুক্ত ডোনর পাওয়া। ট্রান্সপোরটেশনের সমস্যা হেলিকপ্টার ব্যবহার করে কমানো যায়। ন্যাশনাল ডাটা বেইজ থাকলে ম্যাচিং এর সুবিধা পাওয়া যায়। এক্সট্রা করপোরিয়াল সারকুলেশন ব্যবহার করে ইসকেমিক টাইম (Warm and Cold ischemic time) কমানো যায়।
জনসচেতনতা বাড়িয়ে, কুসংস্কারতা দূর করে মানুষকে উদবুদ্ধ করে ট্রান্সপ্লান্টেশনের পক্ষে জনমত তৈরি করা যায়। সার্জিক্যাল টেকনিকের মধ্যে Biatrial technique এবং Bicaval technique রয়েছে। দুটোরই উপযোগিতা রয়েছে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে। এছাড়াও ডোনর হার্টের ত্রুটি-বিচ্যুতি যেমন ভাল্ভের ত্রুটি অপারেশন টেবিলেই সারিয়ে নেওয়া যায়। সামনের দিনের Humanized Xenotransplantation হয়তো ডোনরের স্বল্পতার সংকট কমিয়ে আনতে পারে।