মানুষের ক্রমবিকাশের সাথে জড়িয়ে আছে, তার ভাষা, শিল্পকর্ম, স্থাপত্য, বিজ্ঞান এবং চিকিৎসার ইতিহাস। প্রাচীন মেসোপটেমিয়া, মায়া, আজটেক, চৈনিক এবং ভারতীয় সভ্যতায় অসংখ্য নিদর্শন রয়েছে চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রাথমিক যুগের বিকাশ ও পর্যায়ক্রমিক উন্নয়নের। চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন মন্ত্র, যাদুর ব্যবহারের চেয়ে ঔষধ হিসাবে বিভিন্ন প্রানী, উদ্ভিদের নির্যাস ব্যবহার নিঃসন্দেহে এক ধরনের উন্নয়ন যা সময়ের পরিক্রমায় সমৃদ্ধ করেছে ঔষধ উদ্ভাবন ও উৎপাদন প্রক্রিয়া।
যাদের ক্রমাগত প্রচেষ্টার মাধ্যমে চিকিৎসাশাস্ত্র ক্রমান্বয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানে পরিনত হয়েছে, তাদের মধ্যে সুস্রুত (Sushsruta ), হিপোক্রেটিস (Hippocrates), গ্যালেন (Aelius Galenus), ইবনে সিনা (Ibn Sina) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
ড্রাগ (Drug) কি?
ড্রাগ (Drug) বলতে আমরা সেইসব রাসায়নিক পদার্থগুলো বুঝে থাকি যা শরীরে প্রবেশ করলে শারীরবৃত্তিয় (Physiological) প্রক্রিয়া পরিবর্তিত হয়। সেই অর্থে নেশা উৎপাদনকারী পদার্থসমূহও ড্রাগের অন্তর্ভূক্ত। মেডিসিন (Medicine) বলতে আমরা বুঝি সেইসব ড্রাগ যা রোগ নির্ণয় এবং রোগ চিকিৎসার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। খাদ্য (Food) বলতে আমরা পুষ্টিগুণসম্পন্ন গ্রহনযোগ্য এবং পাচনযোগ্য বস্তুগুলিকে বুঝে থাকি।
এখানে সহজেই ধরে নেওয়া যায় যে, এদের পার্থক্যগুলো তত সুস্পষ্ট নয়, একের গুণাগুণ অন্যের ভিতরেও উপস্থিত রয়েছে। পুষ্টিগুণসম্পন্ন অনেক তরল রয়েছে, যেগুলো শিরার মাধ্যমে (Intravenous fluid, Saline) নেওয়া হয়, এগুলোকে খাদ্য হিসাবে না ধরে মেডিসিন হিসাবে অন্তর্ভূক্ত করা হয়।
ড্রাগের উপাদান
মেডিসিন হিসাবে যা গ্রহন করা হয়, তার ভিতর মূল উপাদান (Active pharmaceutical ingredients, API) ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের সহায়তাকারী পদার্থ (Excipients), সংরক্ষক (Preservative), বাফার (Buffer) ইত্যাদি থাকে। ঔষধ কিভাবে প্রয়োগ করা হবে, যেমন মুখে খাওয়া (Oral route), ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে (Parenteral route) , ইনহেলেশনের (Inhalation) মাধ্যমে অথবা চামড়া (Transcutaneous route) বা ঝিল্লির (Transmucosal route) মাধ্যমে প্রবেশ করানোর উপর নির্ভর করে কি ধরনের অতিরিক্ত পদার্থ এর সাথে যোগ করা হবে।
মেডিসিনের সফলতা নির্ভর করে মূলত এর কার্যকরী উপাদানের উপর, সবচাইতে ভালো হয় যদি তা স্বল্প মাত্রায় প্রয়োগের পর নির্দিষ্ট শারীরিক প্রক্রিয়াকে পরিবর্তন করার পর বিপাক প্রক্রিয়ায় পরিবর্তিত হয়ে শরীর থেকে বের হয়ে যায়। সব ড্রাগ প্রথমেই কার্যকরী থাকে না। শারীরবৃত্তিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তা কার্যকরী ঔষধে পরিনত হয়। এইগুলোকে প্রোড্রাগ (Prodrug) বলা হয়। আবার কোন কোন ড্রাগ বিপাক প্রক্রিয়ার ফলে পরিবর্তিত হয়ে একেবারে অকার্যকর হওয়ার পরিবর্তে কিছুটা কার্যকর থাকে। সেক্ষেত্রে ড্রাগ এবং তার বিপাকিত অবশেষ উভয়ই কার্যকর থেকে ড্রাগের ক্রিয়াকে প্রলম্বিত করতে পারে।
যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ড্রাগ শরীরে প্রবেশ করার পর শোষিত (Absorption) হয়ে, শরীরে বিতরণ (Distribution) হয় এবং কাজ সম্পন্ন করার পর বিপাক প্রক্রিয়ার (Metabolism, Biotransformation) মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়ে শরীর থেকে বের (Excretion) হয়ে যায়, সেটাকে ফার্মাকোকাইনেটিক্স (Pharmacokinetics) বলে।
ড্রাগ কিভাবে মানবদেহে কাজ করে
ঔষধ সাধারনত রিসেপ্টরের (Receptor) সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করে, যুক্ত হবার পর বিশেষ ধরনের সিগন্যাল (Signal) বা উদ্দীপনা কোষের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে পরে, বিভিন্ন রকম এনজাইম সিসটেমের তৎপরতা হ্রাস অথবা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়, হরমোনের পরিবর্তন হয়, বিপাক প্রক্রিয়া এবং বিভিন্ন জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়ার গতিপ্রকৃতি পরিবর্তিত হয়। এভাবেই ড্রাগের অভীষ্ঠ লক্ষ্য অর্জিত হয়। এই প্রক্রিয়াকে ফার্মাকোডাইনামিক্স (Pharmacodynamics) বলা হয়।
ঔষধের মূল কাজের (Pharmacological effect) সাথে সাথে কিছু কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও (Side effect) দেখা দিতে পারে, যা অভিপ্রেত বা অনভিপ্রেত দুই ধরনেরই হতে পারে। এছাড়াও মাত্রাতিরিক্ত প্রয়োগের জন্য বিষক্রিয়া (Toxic effect) দেখা দিতে পারে। ড্রাগের যে কোন উপাদানের প্রতি এলার্জী (Allergy) থাকলে বিভিন্ন ধরনের সংবেদনশীল প্রতিক্রিয়া (Hypersensitivity reaction) দেখা দিতে পারে, এটা স্বল্প সময়ে অথবা দীর্ঘসময়ে প্রতিভাত হতে পারে।
অনেক সময় স্বল্প সময়ে ড্রাগের ক্রিয়া নষ্ট (Tachyphylaxis) হয়ে যায়, আবার দীর্ঘসময় ধরে ব্যবহারের কারনে ড্রাগের প্রতি নিষ্ক্রিয়তা (Tolerance) জন্ম নিতে পারে। জেনেটিক গঠনের বিভিন্নতার কারনে, হরমোনের প্রভাবে, পুষ্টির পার্থক্যের কারনে, দেহের ওজন এবং কাঠামোর বিভিন্নতার কারনে, জাতিগত এবং ভৌগলিক বৈশিষ্ঠের কারনে, দেহের জৈব-রাসায়নিক এবং বিপাক প্রক্রিয়ার বিভিন্নতার কারনে ড্রাগের ক্রিয়া, প্রতিক্রিয়া এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।
ঔষধি প্রভাব (Pharmacological effect)/দৈব প্রভাব (Placebo Effect)
প্রাচীনকালে গাছের ছাল, লতাপাতা, প্রাণীর দেহনিসৃত বিভিন্ন পদার্থ থেকে ঔষধ উদ্ভাবন করা হত। হাজার হাজার পদার্থ পরীক্ষা করে হয়ত একটা জিনিষ পাওয়া যেত যার ঔষধি গুন ছিল। আবার অনেক জিনিষ ঔষধ হিসাবে ব্যবহার করা হত যার কোন ঔষধি গুনই ছিলনা। ঔষধি গুন না থাকা স্বত্বেও এগুলো ঔষধ হিসাবে ব্যবহারের কারন ছিল প্রচলিত বিশ্বাস, তাছাড়া ঔষধ হিসাবে এগুলো ব্যবহার করলে বিশ্বাসের কারনে মানুষের শরীরে নিউরো হরমোনাল যে পরিবর্তন আসে (Placebo effect) তাতে অনেক অসুখ সেরে যেত।
অনেক অসুখই যা সময় গেলে এমনিতেই সেরে যায়, ঔষধ ব্যবহার করা হোক বা না হোক, প্রচলিত নিয়ম অনুসারে অনেক ঔষধই এক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। বৈজ্ঞানিকভাবে বিশ্লেষণ না করার কারনে এভাবেই অনেক অপ্রয়োজনীয় ঔষধ ব্যবহৃত হয়ে আসছিল।
শারীরবৃত্তীয় বিভিন্ন আবিষ্কারের ফলে ক্রমশ পরিষ্কার হয়েছে ঔষধ কিভাবে কাজ করে, কোথায় কাজ করে, কিভাবে শরীরে ঢুকে, কিভাবে ঔষধের বিপাক ক্রিয়া সম্পন্ন হয় আবার কিভাবে কাজ শেষে আবার শরীর থেকে বের হয়ে যায় ইত্যাদি। আবিষ্কার হয়েছে বিভিন্ন ধরনের রিসেপ্টর (Receptor), যার গায়ে আটকিয়ে থেকে ঔষধ কাজ করে। রিসেপ্টরের চেহারা সময়ে সময়ে যতই পরিষ্কার হয়েছে ঔষধ উদ্ভাবন ততই সহজ এবং সফল হতে শুরু করেছে।
রিসেপ্টার (Receptor) কি
একটা আয়নার উপর হাতের পাঁচটা আঙ্গুল ফাঁক করে স্পর্শ করলে দেখা যাবে বৃদ্ধাঙ্গুলির সাথে বৃদ্ধাঙ্গুলি এবং অন্য আঙ্গুল্গুলির সঙ্গে একই ধরনের আঙ্গুল্গুলি লেগে রয়েছে। এখানে রিসেপ্টর আঙ্গুলের প্রতিবিম্ব আর ঔষধ হচ্ছে আঙ্গুল্গুলি। ঔষধ আর রিসেপ্টরের সাথে যত মিল থাকবে তত সুন্দরভাবে তারা খাপে খাপে মিলবে, তত ভাল কাজ পাওয়া যাবে, আর অন্য জায়গায় আটকে থাকার ফলে সৃস্ট পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম হবে।
ঔষধ উদ্ভাবন পদ্ধতি
১। র্যন্ডম পদ্ধতি (Random approach)
প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন প্রানী বা উদ্ভিদজাত নির্যাস ব্যবহার করে চিকিৎসা চলে আসছে। এইসব নির্যাসকে পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করে এর সক্রিয় উপাদানকে আলাদা করা হয়। এই সক্রিয় উপাদানসমূহকে পৃথক করার পর এগুলোকে অপরিবর্তিত রেখে, অথবা আনবিক গঠনের পরিবর্তন বা পরিবর্ধন এনে ড্রাগ হিসাবে ব্যবহার করা হয়। প্রাথমিকভাবে এগুলো প্রাকৃতিক উৎস থেকে সংগৃহীত হলেও পরবর্তীতে এগুলোকে গবেষনাগারে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় অথবা বায়োলজিক্যাল মাধ্যমে বিপুল পরিমানে উৎপাদন করা হয়।
২। পরিকল্পিত পদ্ধতি (Designed approach)
মানুষের জীন (Gene) এর মানচিত্র এখন সম্পন্ন হয়েছে। বিভিন্ন জৈবরাসায়নিক প্রক্রিয়ার অন্তর্গত জীনের গঠন, এর কোড (Code), মেসেঞ্জার আর এন এ র কোডন ( m-RNA Codon), ট্রান্সফার আর এন এর এন্টি-কোডন (t-RNA anticodon), ট্রান্সক্রিপশন (Transcription), ট্রান্স শ্লেষন (Translation) পদ্ধতিতে পলিপেপটাইড (Polypeptide) উৎপাদন সম্বন্ধে অবহিত হওয়ার কারনে এখন ঔষধ উদ্ভাবন তুলনামূলকভাবে সহজ হয়ে গেছে।
ত্রুটিপুর্ণ প্রোটিন বা পলিপেপটাইড সারিয়ে তোলার জন্য যেমন জীন থেরাপি রয়েছে, ত্রুটিপুর্ণ প্রোটিনের কাজকে পরিবর্তিত করার জন্য আবার বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক অনু তৈরী করা যায়, যেগুলো ড্রাগ হিসাবে কার্যকরী ভুমিকা রাখতে পারে। রিসেপ্টরের অনুর গঠনকে বিশ্লেষণ করে পাল্টা ধরনের অনু তৈরী করা যায়, যা রিসেপ্টরের কাজকে উজ্জীবিত অথবা প্রতিহত করতে পারে। আন্দাজে অসংখ্য ড্রাগ নিয়ে পরীক্ষা না করে এখন পরিকল্পিতভাবে অনু তৈরী করে সেগুলিকে নিয়ে পরীক্ষা করে এর কার্যকারিতা নির্ণয় করা হয়। এই পদ্ধতিকে বিপরীত ঔষধবিদ্যা বা Reverse Pharmacology বলা হয়।
৩। বিকল্প ব্যবহার (Repurposing approach)
অনেক সময় কোন একটা রোগের জন্য ব্যবহৃত একটি ঔষধ অন্য একটি রোগের জন্য ব্যবহৃত হয়। দ্রুত সমাধানের জন্য এরকম করা হয়। কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে অনেক ধরনের ঔষধ এইভাবে ব্যবহারের চেষ্টা করা হয়েছে।
ঔষধের কার্যকারিতার পরীক্ষা (Drug trial)
বর্তমান ঔষধ শিল্প অনেক এগিয়েছে কারন ঔষধ উদ্ভাবন করতে এখন আর আন্দাজে হাজার হাজার জিনিষ পরীক্ষা করা লাগে না, রিসেপ্টরের আকৃতির উপর নির্ভর করে একটা অনু (Molecule) তৈরি করা হয় তারপর সেই অনুর নানারকম পরিবর্ধন, পরিবর্তন করে প্রয়োজনীয় ঔষধটি নির্বাচন করা হয়।
একটা নতুন ঔষধকে সবসময় পূর্বের ঔষধের তুলনায় অধিক কার্যকরী হতে হবে এমন কোন কথা নেই, অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী ঔষধও দেখা যায় ক্ষেত্রবিশেষে লিভার বা কিডনি রোগীর উপর বেশী কার্যকর হতে পারে, এক্ষেত্রে রোগীর এই বিশেষ অবস্থার জন্য অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী ঔষধও কার্যকর ভুমিকা রাখতে পারে।
উদ্ভাবিত প্রতিটি ঔষধের কার্যকারিতা, মাত্রা নির্ধারণ, বিষক্রিয়া, ফার্মাকোকাইনেটিক এবং ফার্মাকোডাইনামিক পরীক্ষা, গর্ভাবস্থার উপর প্রভাব, জেনেটিক অথবা জন্মগত ত্রুটি করে কিনা, টিউমার সৃষ্টি করে কিনা ইত্যাদি নানাবিধ বিষয় বিভিন্ন ধাপে পরীক্ষার মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়। প্রথমে গবেষনাগারে ইঁদুর, খরগোশ, বানর জাতীয় প্রাণীর উপর পরীক্ষা করা হয়, তারপর ধাপে ধাপে স্বেচ্ছাসেবক মানুষ এবং রোগীর উপর পরীক্ষা করা হয়। ঔষধ উদ্ভাবন প্রক্রিয়ায় পরীক্ষার ধাপগুলি সম্বন্ধে নিম্নে সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হলো।
প্রি-ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা (Preclinical trial, Phase -0 trial)
প্রথম পর্যায়ে ঔষধের গুনাগুন পরীক্ষাগারে অথবা অন্য প্রাণীর উপর প্রথমে পরীক্ষা করা হয়। এটাকে আমরা মানবদেহে প্রয়োগের পূর্বের পরীক্ষা বলে থাকি। এই পরীক্ষার সময়ও অনেক বিধিনিষেধ মেনে চলতে হয়, পরীক্ষণ পদ্ধতিতে কোন ত্রুটি থাকা চলবে না, অকারণ প্রান সংহার করা চলবে না।
প্রাক-পরীক্ষণে নিরাপদ মনে হলে যথাযথ কতৃপক্ষের নিকট আবেদন করতে হয় মানবদেহের উপর পরীক্ষার জন্য। মানবদেহের উপর চারটি পর্যায়ে এই পরীক্ষা সম্পাদন করা হয়। এখানে আইন কানুন আরও কড়া। খারাপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে যেকোনো পর্যায় থেকে একটা ঔষধ বাদ পড়ে যেতে পারে, এমনকি একটি প্রতিষ্ঠিত ঔষধও পরবর্তীতে কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারনে নিষিদ্ধ হয়ে যেতে পারে।
১ম পর্যায়ের পরীক্ষা (Phase- l Trial)
২০ থেকে ১০০ জন সুস্থ অথবা অসুস্থ মানুষের উপর কয়েকমাস ধরে এই পরীক্ষা করা হয়। উদ্দেশ্য ঔষধের মাত্রা নির্ধারণ এবং নিরাপদ ব্যবহারের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া। শতকরা ৩০ ভাগ ঔষধই এই পর্যায় থেকে বাদ পড়ে যায়।
২য় পর্যায় (Phase- ll Trial)
এ পর্যায়ে নিরধারণ করা হয় ঔষধের কার্যকারিতা এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। কয়েকশ রোগীর উপর প্রায় বছর দুই ধরে এই পরীক্ষা চালানো হয়। এ পর্যায়েও আরও ৩০% ঔষধ বাদ পড়ে যায়।
৩য় পর্যায় (Phase- lll Trial)
কয়েক হাজার রোগীর উপর ৩-৪ বছর ধরে পরীক্ষা চলতে থাকে ঔষধের সত্যিকার কার্যক্ষমতা আছে কি নাই তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য, তাছাড়া নতুন দীর্ঘমেয়াদী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ধরা পড়ে কিনা সেটা যাচাইয়ের জন্য। এপর্যায়েও আরও ১০% ঔষধ বাদ পড়ে যায়। এরপর যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে ঔষধ বাজারজাত করা হয়।
৪র্থ পর্যায় (Phase ।V –Post Marketing Trial)
বাজারজাত করার পর বেশ কয়েক হাজার রোগীর উপর বিভিন্ন সেন্টারে পরীক্ষা করে ৩য় পর্যায়ের ফলাফল সম্বন্ধে আরও নিশ্চিত হতে হয় এবং কোন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ধরা পড়লে বাজার থেকে ঔষধ তুলে নেওয়া হয়।
মান নিয়ন্ত্রণ (Quality control)
ঔষধের কার্যকারিতা নির্ভর করে অনেকগুলো ফ্যাক্টরের উপর- একদিকে যেমন রয়েছে রোগীর জেনেটিক, এপিজেনেটিক, গাঠনিক, জাতিগত, ভৌগলিক , জৈবরাসায়নিক বৈচিত্র অন্যদিকে রয়েছে ঔষধের কাঁচা মালের গুণাগুণ, প্রস্তুত প্রক্রিয়া, প্যাকেটজাতকরন, সংরক্ষন, বাজারজাতকরণ ইত্যাদি নানাবিধ প্রক্রিয়া।
রোগ নির্ণয় সঠিক না হলে, তার চিকিৎসাও যথাযথ হবেনা। সঠিক ঔষধ সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ যেমন গুরুত্ত্বপুর্ণ তেমনি সঠিক রোগের সঠিক ঔষধ প্রয়োগ করাটাও অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ।
মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা
প্রত্যেক ধাপে সঠিক মান নিয়ন্ত্রণ বজায় না রাখতে পারলে ঔষধের সঠিক কার্যকারিতা পাওয়া যাবে না। ঔষধের কাঁচা মালের পরিমান, এর গুণাবলী, মান নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষণ পদ্ধতিসমূহ, বৈশ্বিক বা স্থানীয় বিভিন্ন সংস্থা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
এদের মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যা (WHO), আমেরিকান সোসাইটি ফর টেস্টিং এন্ড মেটেরিয়াল (ASTM), আই এস ও (ISO- International standardization organization), আইইউপিএসি (IUPAC- International union of pure and applied chemistry) উল্লেখযোগ্য।
মান নিয়ন্ত্রণে ফার্মাকোপিয়ার ভুমিকা
বিভিন্ন ফার্মাকোপিয়া ঔষধ সম্বন্ধে বিজ্ঞানসম্মত তথ্য প্রদান করে। এতে কাঁচা মালের রাসায়নিক ফর্মুলা, গুনাগুণ, পরীক্ষণ পদ্ধতি, অনুমোদিত সহযোগী পদার্থের (Excipients) পরিমান, আদ্রতার মাত্রা, সংরক্ষণ পদ্ধতি, জীবানুমুক্ত রাখার পদ্ধতি, ইত্যাদি নানাবিধ তথ্য লিপিবদ্ধ থাকে।
ঔষধ সম্বন্ধে বিভিন্ন মনোগ্রাফ রচনা করা হয়, এগুলিতে লিপিবদ্ধ থাকে রসায়নিক ফর্মূলা ছাড়াও ঔষধের কার্যক্রম, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, মাত্রাতিরিক্ত ডোজ, কিডনী বা লিভারের অসুখে ঔষধের ডোজ, কোন কোন ক্ষেত্রে এই ঔষধ ব্যবহার করা যাবেনা তার তালিকা, ঔষধের বিষক্রিয়া হলে তার প্রতিকারক ইত্যাদি নানাবিধ বিষয়।এছাড়াও এতে থাকে নির্ভেজাল ঔষধটি শনাক্ত করার পদ্ধতি এবং স্বীকৃত পরীক্ষণ পদ্ধতি যার মাধ্যমে উপাদানের গুণগত এবং পরিমাণগত মাত্রা নির্ধারণ করা যায়।
কাঁচা মালের (API- Active pharmaceutical ingredient) সঠিক মান নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রথমে যেটি প্রয়োজন সেটি হলো প্রথমে আদর্শ (Standard) মাত্রা নির্ধারণ করা। তারপর এর সাথে ব্যবহার্য আনুষঙ্গিক পদার্থসমুহের নাম এবং পরিমান, উৎপাদন পদ্ধতি, বিভিন্ন ভৌত গুনাগুণ (Physical properties) যেমন গলনাংক (Melting Temperature), স্ফুটানাংক (Boiling Temperature), বর্ণ, গন্ধ ইত্যাদি।
রাসায়নিক ফর্মুলা, গাঠনিক ফর্মুলা, আনবিক ওজন ইত্যাদি নানাবিধ তথ্য এতে বর্নিত থাকে যাতে সঠিক উপাদানটিকে শনাক্ত করতে কোন অসুবিধা না হয়। ঔষধ উৎপাদনের সময় জিএমপি র (Good manufacturing practices) শর্তসমূহ মেনে চলতে হয়।
উৎপাদনের পর বিভিন্ন প্রকার ভৌত-রাসায়নিক পরীক্ষণ, জীবাণুদূষণ প্রতিরোধকরন, শরীরের জন্য ক্ষতিকর পদার্থের অনুপস্থিতি নিশ্চিতকরণ ইত্যাদি নানাবিধ মাননিয়ন্ত্রণ পরীক্ষার পর ঔষধটি বিভিন্ন ব্যাচ নম্বর অনুযায়ী বাজারজাতকরণ করা হয়। এতে তৈরীর সময়, ব্যবহার শেষ হবার সময়, পরিবহন এবং সংরক্ষণ সম্বন্ধীয় নির্দেশনা দেওয়া থাকে।
ডোজ প্রস্তুতকরণের নির্দেশনা ছাড়াও, প্যাকেটের মধ্যে লিফলেটের মাধ্যমে সাধারণ নির্দেশনা দেওয়া থাকে। স্মরণ রাখতে হবে এই নির্দেশনা কোন অবস্থাস্তেই চিকিৎসকের বিকল্প নয়। বাজারজাত করনের পরই দ্বায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। বিভিন্ন ব্যাচের ঔষধ নিয়ে বিভিন্ন সময় জরীপ (Post-marketing surveillance) চলতে থাকে কারন, যদি কোন অনাকাংখিত বিরূপ প্রতিক্রিয়া ধরা পড়ে যায় তখন যেন দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
ঔষধের মান নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন সংস্থা মনোগ্রাফ প্রকাশ করে থাকে যেমনঃ
- বিপি (BP- British pharmacopoeia)
- ইউ এস পি (USP- United states pharmacopoeia)
- আই পি (IP- International Pharmacopoeia) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
দেশীয় কিছু ফার্মাকোপিয়াও স্থানীয় ভাবে ঔষধ উৎপাদন করে, তবে এগুলো মূলত হার্বাল, আয়ুর্বেদীয়, ইউনানী ঔষধের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
ক্যাটাগরি নির্ধারণ
কোন ঔষধের ক্যান্সার উৎপাদক পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া, ভ্রূন নষ্টকারী প্রতিক্রিয়া, মারাত্মক পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া থাকলে সে বিষয়ে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। এভাবেই প্রেগন্যান্সি ক্যাটেগরি অনুযায়ী ঔষধগুলোকে শ্রেনীবদ্ধ করা হয়।
- A Category – গর্ভাবস্থার প্রথম ৩ মাস বা ততপরবর্তীতে ভ্রূণের উপর ক্ষতিকারক কোন প্রভাবের জোরালো প্রমান (মানব দেহের উপর পরীক্ষিত) নেই।
- B Category -মানবদেহের উপর পরীক্ষিত প্রমান নেই, কিন্তু প্রাণীদেহের উপর পরীক্ষা করে ভ্রূণ-বিধ্বংসী কোন প্রমান পাওয়া যায়নি।
- C Category – প্রানীদেহে ভ্রূণ- ধ্বংসকারী প্রভাব পাওয়া গেলেও মানবদেহে পাওয়া যায়নি। বিশেষ প্রয়োজনে গর্ভাবস্থায় এসব ঔষধ নিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
- D Category – বাজারজাতকরণের পর বিভিন্ন জরিপে মানব ভ্রূণের উপর ক্ষতিকর প্রভাবের কিছু প্রমান রয়েছে।
- X Category- মানব ভ্রূণের উপর ক্ষতিকর প্রভাব মোটামুটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমানিত। গর্ভাবস্থায় এসব ঔষধের ব্যবহার নিষিদ্ধ।
মান নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহৃত পরীক্ষাসমুহ
একটা ট্যাবলেট খাওয়ার পর তাকে সঠিক সময়ে সঠিক স্থানে, পাকস্থলী বা ক্ষুদ্রান্ত্রে (PH অনুযায়ী অম্লত্ব বা ক্ষারকত্ব নির্ভর করে) গলে (Dissolution) যেতে হবে। সেখান থেকে শোষন (Absorption) প্রক্রিয়ায় রক্তের সঙ্গে মিশে শরীরের বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে (Distribution) নির্দিষ্ট অঙ্গ প্রত্যঙ্গে কাজ করবে। এর পরে (Action) বিপাক (Biotransformation) প্রক্রিয়ায় পরিবর্তিত হয়ে বর্জ্য হিসাবে রেচন প্রক্রিয়ায় (Excretion) শরীর থেকে বের হয়ে যাবে।
এই প্রক্রিয়ার যে কোন স্থানে ত্রুটি বা বিকৃতি দেখা দিলেই কাঙ্খিত উদ্দেশ্য সফল না হয়ে বিরূপ প্রভাব পড়বে। শিরা, মাংসপেশি কিম্বা চামড়ার নীচে প্রয়োগের ক্ষেত্রেও প্রায় একই ধরনের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়।
মানবদেহের জৈবরাসায়নিক প্রক্রিয়া ছাড়াও ঔষধের গুণগত মান এক্ষেত্রে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে থাকে। তাই মান নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন ধরনের ভৌত পরীক্ষা (যেমন গলনের পরীক্ষা) ছাড়াও অত্যন্ত সংবেদনশীল (Sensitive) এবং সুনির্দিষ্ট (Specific) পরীক্ষণ যন্ত্রাদি ব্যবহার করা হয়। এগুলোর মধ্যে Thin layer Chromatography, High performance liquid chromatography (HPLC), Ultraviolet spectophotometric technique উল্লেখযোগ্য।
এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের জীবাণু পরীক্ষা (Microbiological test), Heavy metal দুষনের পরীক্ষা করা হয় যাতে সঠিক উপাদানের ও সঠিক মানের নিরাপদ ঔষধ পাওয়া যায়। এক্ষত্রে চিকিৎসকের চাইতে ঔষধ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থ্যার দায়িত্ব এবং কর্তব্য অনেক বেশী।
পরিশেষ
ঔষধ উদ্ভাবন ও উৎপাদন অন্যান্য যে কোন বিষয় থেকে সম্পূর্ন আলাদা ও স্পর্শকাতর। এর সাথে শুধুমাত্র মুনাফা ও কর্মসংস্থানের বিষয়টিয় জড়িত নয়, এর সাথে জড়িয়ে আছে মানুষের স্বাস্থ্য এবং সমৃদ্ধি। সবার দায়িত্বশীল আচরণ, কর্তব্যনিষ্ঠা, পরার্থবাদীতাই পারে নিরাপদ ও কার্যকর ঔষধ উদ্ভাবন, উৎপাদন, মান নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যবহার নিশ্চিত করতে।
চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ে আরো কিছু লেখাঃ |
---|
একবিংশ শতাব্দীর চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং… রোগ নির্ণয়ে মেডিকেল ইমেজিং |