১৯০৫ সালের কোন এক সুন্দর সকাল। উনিশ বছর বয়েসী রাশিয়ান সাংবাদিক সলোমন শেরেসেভস্কি
প্রতিদিনকার মতন অফিসে পৌছে সম্পাদকের সাথে মিটিংয়ের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। যথাসময়ে
মিটিং শুরু হল। মিটিংয়ে সবাইকে সেদিনের এসাইনমেন্ট বুঝিয়ে দেয়া হচ্ছিল। হঠাৎ সম্পাদক লক্ষ্য করলেন,
অন্য সাংবাদিকদের মত সলোমন কোন নোট নিচ্ছেনা। বিষয়টি অবশ্য তিনি আগেও লক্ষ্য করেছেন এবং
প্রতিবারই বেশ বিরক্ত হয়েছেন। মনে মনে ভাবলেন, সলোমনের এই গা ছাড়া ভাবকে আর কোনভাবেই প্রশ্রয়
দেয়া যাবেনা, আজকেই এর একটা ব্যবস্থা করতে হবে।
মিটিং শেষে সম্পাদক সলোমনের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন- এতক্ষন উনি যা যা বলেছেন, সেই সবগুলো
কথা সলোমনের কাছে জানতে চাইলেন। তিনি চাচ্ছিলেন এই কান্ডজ্ঞানহীন সাংবাদিকটা একটা উচিত শিক্ষা
পাক। কিন্তু ঘটনা ঘটল উলটো। অপদস্ত হওয়ার বদলে সলোমন সবাইকে চমকে দিল! নির্ভুলভাবে
সম্পাদকের প্রতিটি কথা, প্রতিটি বাক্য একের পর এক হুবহু বলে গেল সলোমন!
সলোমনের এই অস্বাভাবিক প্রতিভায় উপস্থিত সবাই বিস্মিত হল তো বটেই, সম্পাদক সাহেবও বিস্মিত হলেন
এবং খানিকটা লজ্জাও পেলেন। অন্যদিকে সলোমন চমৎকৃত হল এটা জানতে পেরে যে, অন্যরা তার মত
মনে রাখতে পারে না।
সেদিনের ঘটনার পর সলোমনের জীবন বদলে যায়। তার সেই সম্পাদকই তাকে নিয়ে যান প্রফেসর ড.
আলেক্সান্ডার লুরিয়ার কাছে। প্রাথমিক পরিচয়পর্ব শেষে লুরিয়া সলমোনের স্মৃতিশক্তির কিছু পরীক্ষা করতে
চান। তিনি কিছু শব্দ/বর্নের সিরিজ নিয়ে সলোমনের সামনে বসেন। এসব সিরিজের কয়েকটি উনি
সলোমনকে পড়তে বলেন আর কয়েকটি নিজেই পড়ে শোনান৷ সলোমনের টাস্ক ছিল, শুধুমাত্র একবার শুনে
সিরিজের শব্দগুলো নির্ভুলভাবে রিপিট করা।
এই ধরনের পরীক্ষা করা হয় মূলত মানুষের শর্টটার্ম মেমরি যাচাই করার জন্য। সলোমনের ক্ষেত্রে লুরিয়া
প্রথমে শুরু করলেন ১০-২০টি শব্দের সেট দিয়ে যেটি বাড়তে বাড়তে একপর্যায়ে ৭০ শব্দের সেট পর্যন্ত চলে
যায়। বলাই বাহুল্য, সলোমন এই সবগুলো সিরিজের পরীক্ষাই অনায়াসে উতরে যায়, এমনকি সিরিজের
শব্দগুলো উল্টোদিক থেকেও রিপিট করে শোনায়!
পরীক্ষা নিতে নিতে একসময় লুরিয়ার মনে হতে থাকে তার সামনে বসে থাকা এই যুবকের স্মৃতির পরিধি
অসীম! উনিশ বছর বয়েসী সাংবাদিকের এই অস্বাভাবিক ক্ষমতায় মুগ্ধ হয়ে লুরিয়া তার উপর আরো গবেষনা
চালানোর সিদ্ধান্ত নেন এবং পরবর্তী তিরিশ বছর পর্যন্ত তিনি সলোমনের স্মৃতির উপর নানান পরীক্ষা চালান।
সলোমনের এই চমকপ্রদ গল্পের রেশ ধরেই তবে স্মৃতি নিয়ে কিছু কথা হয়ে যাক। আমরা আউটডোরে প্রায়ই
এমন রোগী পাই যার প্রধান কম্পলেইন হচ্ছে তিনি সবকিছু ভুলে যাচ্ছেন। এই ভুলে যাওয়া অসুখ শুধু যে
বয়জ্যেষ্ঠদের তা কিন্ত নয়, অনেক অল্পবয়েসী ছেলেমেয়েও এই সমস্যা নিয়ে ডাক্তারের কাছে আসে।
আসলে এই ভুলে যাওয়া রোগের পেছনের কারন কী? সব ভুলে যাওয়াই কী রোগ? কী করলে আমরাও
সলোমনের মত পার্ফেক্ট মেমরি পেতাম? কিংবা পার্ফেক্ট মেমরি’র প্রয়োজনীয়তা আদৌ আমাদের জীবনে
আছে কিনা?
এসব প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য চলুন আগে স্মৃতি বা মেমরি সম্পর্কে কিছু বেসিক ধারনা নেই।
মেমরি কী?
মস্তিষ্কে যেকোন তথ্য বা ইনফরমেশন সংরক্ষন করে রাখার প্রক্রিয়ার নামই মেমরি। তথ্য সংরক্ষনের এই
কাজটি করে থাকে মূলত হিপ্পোক্যাম্পাস (Hippocampus)। তবে হিপ্পোক্যাম্পাস ছাড়াও এমিগড্যালা (amygdala) এবং প্রি-ফন্ট্রাল কর্টেক্স (Pre frontal cortex) মেমরি সংরক্ষনে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
মেমরির প্রকারভেদঃ
মেমরি প্রধানত তিন রকমের-
- সেনসরি মেমরি,
- শর্ট টার্ম মেমরি এবং
- লং টার্ম মেমরি।
সেনসরি (Sensory Memory)
আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোর মাধ্যমে প্রতিনিয়ত যে স্মৃতি তৈরি হচ্ছে, সেটাই সেনসরি মেমরি। ধরা যাক, আপনি রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় আশেপাশের সবকিছু দেখতে দেখতে যাচ্ছেন। এখন আপনার সেনসরি মেমরি ঠিকঠাক আছে বলেই আপনি চারপাশের সবকিছু একটি কন্টিনিউয়াস দৃশ্য হিসেবে দেখছেন, নয়তো প্রতিবার পলক ফেলার সাথে সাথেই আপনি ভুলে যেতেন আপনি এইমাত্র কী দেখলেন, অর্থাৎ আপনি একটি দৃশ্যকে দৃশ্য আকারে না দেখে কতগুলো ভাংগা ভাংগা অংশ হিসেবে দেখতেন।
ঠিক একই ঘটনা ঘটে কোন কিছু শোনার বেলায়ও। সেনসরি মেমরি আছে বলেই আমরা একটা বাক্যকে
বাক্য আকারেই শুনি এবং বুঝি, নয়তো আমরা কতগুলো বিচ্ছিন্ন শব্দ শুনতাম এবং কিছুই বুঝতাম না।
এই সেনসরি মেমরির স্থায়িত্বকাল কিন্তু খুবই কম, বলা হয়ে থাকে এক সেকেন্ডেরও কম। আর ঠিক সেজন্যই
আমরা রাস্তায় যাওয়া আসার সময় যা দেখি বা সারাদিন যতকিছুই শুনি সেগুলোর কিছুই আর বাসায় এসে
মনে থাকেনা।
শর্ট টার্ম (Short term) মেমরি
শর্ট টার্ম মেমরি নাম শুনলেই বোঝা যায় যে মেমরির স্থায়িত্বকাল খুবই কম। বলা হয়ে থাকে যে শর্ট টার মেমরির স্থায়িত্বকাল মাত্র বিশ সেকেন্ড।
উদাহরনস্বরূপ, আপনি কাউকে ফোন করবেন কিন্তু তার নাম্বার আপনার কাছে নেই, আপনার বন্ধুর কাছে
আছে। আপনার বন্ধুর কাছে নাম্বারটা চাওয়ার পর সে তার ফোনবুক দেখে নাম্বারটা বলল, আপনি সেটা
একবার শুনে মুখস্থ করে নিয়ে নাম্বারটা ডায়াল করলেন। এই ঘটনার পরবর্তী ২০ সেকেন্ড পর্যন্ত ধরে নেয়া
যায় নাম্বারটি আপনার মনে থাকবে। এটিই শর্ট টার্ম মেমরি।
লং টার্ম (Long term) মেমরি
যেসব মেমরি আমরা অনেক দিন, অনেক বছর, কোন কোন ক্ষেত্রে আজীবন মনে রাখতে পারি সেটাই লং টার্ম মেমরি।
এনকোডিং
এখন কথা হচ্ছে সেনসরি মেমরির স্থায়িত্বকাল যেমন ১ সেকেন্ডেরও কম বা শর্ট টার্ম মেমরির ক্ষেত্রে মাত্র ২০
সেকেন্ড, এই ১ সেকেন্ড বা ২০ সেকেন্ড পর কী তাহলে আর কোনভাবেই এই স্মৃতিগুলো মনে রাখা সম্ভব নয়?
উত্তর হচ্ছে সম্ভব। আমরা চাইলে যেকোন মেমরিকেই লং টার্ম মেমরিতে রূপান্তরিত করতে পারি। কিভাবে
পারি আসুন তা জেনে নেওয়া যাক।
যেকোন তথ্য মেমরি হিসেবে মস্তিষ্কে জমা করার প্রক্রিয়ার নাম এনকোডিং। এই এনকোডিং দুইরকম, যথা:
- এফোর্টলেস এনকোডিং এবং
- এফোর্টফুল এনকোডিং৷
এফর্টলেস (Effortless) এনকোডিং
আপনাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় আজকে সকালে কী দিয়ে নাস্তা করেছেন, উত্তর দিতে কী আপনাকে খুব বেশি ভাবতে হবে? নিশ্চয়ই না। তবে এই যে নাস্তা খাওয়ার ঘটনা, এটা মনে রাখার জন্য কিন্তু আপনার কনশাস মাইন্ড কোন এফোর্ট দেয়নি অর্থাৎ মনে রাখার জন্য আলাদাভাবে কোন চেষ্টাই করেনি। মনে রাখার এই প্রক্রিয়াকেই বলে এফর্টলেস এনকোডিং।
এফোর্টফুল (Effortful) এনকোডিং
আমরা যখন নতুন কিছু শিখতে চাই, যেমন পড়াশুনা বা অন্যকিছু, তখন আমরা বিশেষভাবে সেই কাজটাতে মনোযোগ বা এফোর্ট দিয়ে থাকি। এটাকেই বলে এফোর্টফুল এনকোডিং।
এই এফোর্টফুল এনকোডিং এর ক্ষেত্রে আমরা কিছু স্ট্র্যাটেজি ফলো করি। যেমন, পড়াশুনার ক্ষেত্রে আমরা
যখন কোন কিছু মনে রাখতে চাই তখন সেটি বারবার পড়ি, অর্থাৎ মুখস্থ করি। এই মুখস্থ করাটা কেউ হয়ত
বুঝে করে, কেউ না বুঝে করে।
দেখা গেছে, মুখস্থ করার ক্ষেত্রে যারা বুঝে মুখস্থ করে তাদের এনকোডিং যারা না বুঝে পড়ে তাদের চেয়ে ভাল হয়। এই বুঝে মুখস্থ করাকে বলে ইলাবোরেটিভ রিহার্সেল (Elaborative rehearsal)।
তারমানে দাড়াল এই যে, আমরা যদি আমাদের কোন সেনসরি বা শর্ট টার্ম মেমরিকে লং টার্ম মেমরিতে
রূপান্তরিত করতে চাই, সেক্ষেত্রে ইলাবোরেটিভ রিহার্সেল হতে পারে একটি ভাল স্ট্র্যাটেজি। যে তথ্যটি
আপনি মনে রাখতে চান, প্রথমেঅ তাড়াহুড়া না করে সেটির পিছনে যথেষ্ট সময় দিন, তার মূলভাব আয়ত্ত্ব
করুন। তবেই আর মনে রাখতে কষ্ট হবেনা।
ইলাবোরেটিভ রিহার্সেলের মত স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর আরো একটি স্ট্র্যাটেজি হল ইমেজারি এনকোডিং
(Imagery encoding)। অর্থাৎ ছবি আকারে কোন কিছু মনে রাখা।
ধরুন আমি আপনাকে ৫ টি জিনিসের নাম মুখস্থ করতে বললাম- বিছানা, টেবিল, ওয়ারড্রব, একুরিয়াম,
টিভি। এই ৫ টি জিনিসের প্রত্যেকটিই যেহেতু একে অন্যের চেয়ে আলাদা, সেহেতু এগুলো মুখস্থ করতে
আপনার একটু হলেও সময় লাগবে।
কিন্তু আপনি যদি এই পাচটি জিনিসকে নিয়ে একটি দৃশ্য কল্পনা করেন এভাবে যে, একটা রুম..রুমে রয়েছে
একটি বিছানা, বিছানার একপাশে একটি ওয়ারড্রব যার উপরে একটা টিভি আর অন্যপাশে একটি টেবিল
যার উপরে একটা একুরিয়াম।
এবার কী জিনিসের নামগুলো মনে রাখা আপনার জন্য সহজ হল না? আপনাকে যদি এখন ঐ পাচটি
জিনিসের নাম জিজ্ঞেস করা হয়, আপনি সেই দৃশ্যটি কল্পনা করে অনায়াসেই বলে ফেলতে পারবেন
নামগুলো।
এবার একটু সলোমনের গল্পে ফিরে যাওয়া যাক। সলোমনের অসাধারন স্মৃতিশক্তির পিছনে আরেকটি
অসাধারন ক্ষমতা লুকিয়ে ছিল। সেটি হল, তিনি যখনই কোন কিছু শুনতেন বা পড়তেন, সাথে সাথে সেই
জিনিসটার একটা ইমেজ দেখতে পেতেন চোখের সামনে। এবং এই ইমেজকে কাজে লাগিয়েই তিনি
পরবর্তীতে সবকিছু খুব সহজেই মনে করতে পারতেন। যেমন, উনি যখন শুনতেন ‘সবুজ’, চোখের সামনে
দেখতে পেতেন সবুজ টবে লাগানো ফুলগাছ, কিংবা ‘লাল’ শুনলে দেখতেন লাল শার্ট পড়া একজন লোক।
আবার যে ছবিগুলো উনি দেখতেন সেগুলো সবসময় যে শব্দের সামঞ্জস্যপূর্ন হত এমনো না। যেমন,
সলোমনের সামনে যখন কেউ বলত 7, তার চোখের সামনে ভেসে উঠত একজন গোফওয়ালা লোক; কেউ
যখন বলত 8, তখন তিনি দেখতেন একজন গাট্টাগোট্টা মহিলা, আবার 87 শুনলে দেখতে পেতেন পাশাপাশি
দাঁড়ানো একজন মোটা মহিলা ও একজন গোফে তা দেয়া পুরুষ! কী অদ্ভুত, তাইনা?
তবে যাই দেখতেন না কেন, সলোমনের ক্ষেত্রে ছবি দেখার এই বিষয়টি ঘটত স্পন্টেনিয়াস। অর্থাৎ সাধারন
মানুষের ক্ষেত্রে ইমেজারি এনকোডিং টা যেখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এফোর্টফুল, সলোমনের ক্ষেত্রে সেটি
ছিল সবসময়ই এফোর্টলেস!
তবে সবসময় ইমেজারি এনকোডিং এর ব্যবহার ছাড়া ধারালো স্মৃতির অধিকারী হওয়া যায়না এমন কোন
ব্যাপার নেই। ইতিহাসে সলোমনের পরেও আরো অনেক অসাধারন স্মৃতিসম্পন্ন ব্যক্তি এসেছেন যাদের এই
দুর্দান্ত স্মৃতিশক্তির পেছনে কোন ব্যাখ্যা নেই। সম্ভবত তারা জন্মগতভাবেই এই অতিপ্রাকৃত গুনটি নিয়ে
এসেছেন।
স্মৃতির বিস্মৃতি
স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর স্ট্র্যাটেজি জানতে হলে স্মৃতির বিস্মৃতি অর্থাৎ ভুলে যাওয়া সম্পর্কেও জানা প্রয়োজন।
কেননা যেই ভুলগুলোর কারনে আমরা ভুলে যাই, সেই ভুলগুলো শোধরানো গেলেই মনে রাখার ক্ষমতা
বাড়বে৷
সাইকোলজিস্টদের মতে, ভুলে যাওয়ার ৪টি প্রধান কারন রয়েছে-
- এনকোডিং ফেইলুর ( Encoding failure)
- ডিকেই থিওরী (Decay theory)
- ইন্টারফেয়ারেন্স থিওরী ( Interferance theory)
- রিট্রেইভাল ফেইলুর (Retrieval failure)
এনকোডিং ফেইলুর (Encoding failure)
এনকোডিং অর্থাৎ কোন মস্তিষ্কে কোন তথ্য জমা করার সময়
যদি কোন ব্যাঘাত ঘটে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এই ঘটনা প্রতিদিনই ঘটে। উদাহরনস্বরূপ, আমরা হয়ত
অনেক সময় কোন বিষয় পড়ছি, কিন্তু কিছুসময় পর সেই পড়া আর মনে করতে পারছিনা। এর কারন হয়তো
এই যে যখন আমরা পড়ছিলাম, সেই সময়ে পূর্ন মনোযোগ সহকারে পড়িনি যার ফলে আমাদের মস্তিষ্কে
মেমরি এনকোড/স্টোরই হয়নি। আর যে মেমরি স্টোর হয়নি সেটা মনে করতে পারার প্রশ্নই আসেনা।
ডিকেই থিওরী (Decay theory)
সময়ের সাথে সাথে মস্তিষ্কে সংরক্ষিত স্মৃতির ক্ষয় হতে থাকে, একেই
বলে ডিকেই থিওরী। যেমন সময় বা বয়সের সাথে সাথে আমরা অনেক স্মৃতিই ভুলে যাই। এটি একটি
স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
ইন্টারফেয়ারেন্স থিওরী (Interference theory)
ইন্টারফেয়ারেন্স থিওরী হল, যখন একটি স্মৃতি, আরেকটি স্মৃতিকে মনে করতে বাধা দেয়।
বিষয়টি বেশ মজার। ধরুন, সকালবেলা আপনার বন্ধু জানাল আজ সন্ধ্যায় সে রমনা রেস্তোরাঁতে আপনাকে
নিয়ে খেতে যাবে। এরপর দুপুরে আপনি বাসা থেকে বের হলেন কোন একটি কাজে, পথে চোখে পড়ল
‘স্পাইসি রমনা’ নামে একটি রেস্টুরেন্ট।
তারপর সন্ধ্যায় যখন আপনি বন্ধুর সাথে দেখা করতে যাওয়ার জন্য রেডি হওয়া শুরু করলেন, কিছুতেই আর সেই ‘রমনা রেস্তোরাঁ’ নামটি মনে আসছে না, বারবার মাথায় আসছে ‘স্পাইসি রমনা’। যদিও আপনি জানেন আপনি যেখানে যেতে চাচ্ছেন সেই রেস্টুরেন্টের নাম স্পাইসি রমনা না! এখানে প্রায় কাছাকাছি দুটি স্মৃতির দ্বিতীয়টি প্রথমটিকে মনে করতে বাধা দিচ্ছে। এটাই ইন্টারফেয়ারেন্স।
রিট্রেইভাল ফেইলুর (Retrieval failure)
আমরা ছোটবেলায় পরিমাপের একক মুখস্থ করেছিলাম কিভাবে মনে আছে? “কিলাইয়া (kilo) হাকাইয়া (hecto) ডাকাত (deca) মারিলে (meter) দেশের (deci) শান্তি (মিলিবে)। ” মনে রাখার জন্য আমরা এখানে যে পদ্ধতি ব্যবহার করেছি সেটিকে বলে ‘mnemonic’। আর এই mnemonic ব্যবহার করেছি বলেই কিন্তু আজ এতবছর পরেও আমাদের ছোটবেলার সেই পড়া মনে আছে!
এমনিভাবে আমরা যদি কোন তথ্য মনে রাখার জন্য কোন বিশেষ পদ্ধতি বা cue ব্যবহার করি, পরবর্তীতে খুব
সহজেই আমরা সেই cue ব্যবহার করে তথ্যটি মনে করতে পারি। cue ব্যবহার না করে যখন আমরা অনেক
বড়বড় তথ্য, উপাত্ত মনে রাখতে যাই তখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরবর্তীতে আর সেগুলো মনে করতে পারিনা
বা মনে করতে কষ্ট হয়। এটাই রিট্রেইভাল ফেইলুর।
অর্থাৎ, তথ্যগুলো আপনার মাথায় ঢুকিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু এখন সেগুলো আর খুজে পাচ্ছেন না; ঠিক যেমন
অগোছালো বুক শেলফ থেকে আমরা আমাদের প্রয়োজনীয় বইটা কাজের সময় আর খুজে পাই না!
এই থিওরীগুলো ছাড়াও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ঘুম। সারাদিন ধরে যেসব তথ্য আমরা বিক্ষিপ্তভাবে
মস্তিষ্কে জমা করতে থাকি, ঘুমের সময় আমাদের মস্তিষ্ক সেসব তথ্যকে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে। সেজন্য,
গবেষনায় দেখা গেছে যে নতুন নতুন তথ্য মাথায় ইনপুট নেবার পর যদি একটা ভাল ঘুম দেয়া যায়, তাহলে
তথ্যগুলো একেবারে নিরেটভাবে স্মৃতিতে জমা হয়।
তাই আপনাদের কারো যদি সারারাত পড়াশুনা করে একদমই না ঘুমিয়ে পরদিন পরীক্ষা দিতে যাওয়ার অভ্যাস থাকে, দয়া করে অভ্যাসটা বদলান। হয়ত এই অভ্যাস নিয়েই আপনি সারাজীবন পরীক্ষায় প্রথম হয়ে এসেছেন কিন্তু কে জানে, অভ্যাসটা বদলাতে পারলে হয়ত আপনার পারফরম্যান্স আরো ভাল হবে! একবার চেষ্টা করেই দেখুন না!
ভুলে যাওয়া কী অসুস্থতার লক্ষন?
ভুলে যাওয়া কোন অসুস্থতার লক্ষন নাকি স্বাভাবিক সেটি জানতে হলে আগে আমাদের জানতে হবে কোন
কোন অসুখে মানুষ ভুলে যেতে পারে। যেসব মানসিক রোগে বেশ সচরাচর ভুলে যাওয়ার লক্ষন দেখা যায় তাদের মধ্যে প্রধান গুরুত্বপূর্ণ তিনটি রোগের নাম-
- ডিমেনশিয়া,
- ডিপ্রেশন এবং
- এংক্সাইটি।
এদের মধ্যে ডিমেনশিয়া রোগটির নাম আজকালকার মানুষের কাছে খুব পরিচিত। কেউ ভুলে যাওয়ার কথা
বললেই আমাদের মাথায় প্রথমেই আসে, ডিমেনশিয়া নয়ত? কিন্তু আমরা এটা জানিনা যে ডিমেনশিয়া সকল
বয়সের রোগ নয়। সাধারনত ষাটোর্ধ্ব মানুষের ক্ষেত্রে ডিমেনশিয়া রোগটি হয়ে থাকে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে
অল্পবয়েসেও রোগটি শুরু হতে পারে তবে সেটির হার খুব কম।
এই রোগে প্রধানত মস্তিষ্কের কিছু গঠনগত পরিবর্তন এবং নিউরোট্রান্সমিটারের তারতম্য হয়ে থাকে যার ফলে
রোগী দৈনন্দিন জীবনের অনেক কিছুই ভুলে যেতে থাকেন।
ডিমেনশিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত অন্য কোনদিন লিখব৷
অন্যদিকে, ডিপ্রেশন এবং এংক্সাইটি এই দুই রোগেই রোগীরা কোন কাজে মনোযোগ দিতে পারেন না।
ডিপ্রেশনের রোগী মনোযোগ দিতে পারেন না তার ডিপ্রেশনের কারনে, আর এংক্সাইটির রোগী মনোযোগ
দিতে পারেন না তার অস্থিরতার জন্য। আর মনোযোগ দিতে না পারলে কী হয় সেটা আমরা ইতোমধ্যেই জানি-
এনকোডিং ফেইলুর।
প্রধানত এই তিনটি অসুখ ব্যতীত দৈনন্দিন জীবনে ভুলে যাওয়ার ঘটনা ঘটা স্বাভাবিক ব্যাপার। শুধু
স্বাভাবিকই নয়, এই ‘ভুলে যাওয়া’ গুনটি আমাদের মানসিক সুস্থতার জন্যও প্রয়োজন। কেন প্রয়োজন সেটি
জানার জন্য শেষ বারের মত আবারো ফিরে যাই সলোমনের গল্পে।
সলোমনের শেষ অধ্যায়
একবার সলোমন একটি আইস্ক্রিম পার্লারে যান। সেখানে গিয়ে তিনি আইস্ক্রিম পার্লারের মহিলাকে জিজ্ঞেস
করলেন, ‘এখানে কী কী আইস্ক্রিম আছে?’ মহিলা উত্তর দিলেন, “ফ্রুট আইস্ক্রিম”। ‘ফ্রুট আইস্ক্রিম’-কথাটি
বলামাত্রই সলোমন দেখতে পেলেন মহিলার মুখ দিয়ে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের মত বিশাল আকারের
কয়লার স্তুপ, পোড়া ছাই বেরিয়ে আসছে। সহ্য করতে না পেরে তৎক্ষনাৎ সেখান থেকে ছুটে বের হয়ে যায়
সলোমন।
ভয়াবহ এই দৃশ্যটি ছিল সলোমনের স্পন্টেনিয়াস ইমেজারি এনকোডিং, যেটা কিনা ধীরে ধীরে সলোমনের
জীবনকে বিষিয়ে তুলছিল। সলোমন কখনো কোনো প্যারাগ্রাফের মূল বক্তব্য বা সামারি বুঝে উঠতে পারতেন
না কারন প্যারাগ্রাফের প্রতিটা শব্দ তার মস্তিষ্কে আলাদা আলাদা ইমেজ তৈরি করত, যেগুলো সম্মিলিতভাবে
বাধা দিত প্যারাগ্রাফের মোদ্দাকথা বুঝতে।
অন্যদিকে, কোন কিছুই ভুলতে না পারার কারনে সলোমনের কর্মজীবনও একসময় ব্যহত হতে থাকে। যখনই
তিনি মনোযোগ দিয়ে কোন কাজ করতে যেতেন, একের পর এক অপ্রয়োজনীয় স্মৃতি মাথায় আসতে থাকত
ফলে যেকোন কাজ শেষ করতে অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি সময় লাগত তার।
কোনকিছুই ভুলতে না পারার এই যন্ত্রনায় পাগলপ্রায় হয়ে একবার সলোমনের মাথায় এক অদ্ভুত চিন্তা আসে।
তিনি ভাবেন মস্তিষ্কের কিছু অপ্রয়োজনীয় স্মৃতি কাগজে লিখে ফেললে হয়ত সেগুলো ভুলে যাওয়া সম্ভব!
সেই চিন্তা থেকে কাগজ কলম নিয়েও বসেন। কিন্তু যখন দেখলেন এই পদ্ধতিতে আসলে কিছুই হচ্ছেনা,
রাগে-দুঃখে সব কাগজ আগুনে পুড়িয়ে কাদতে থাকেন সলোমন।
জীবনের এক পর্যায়ে এসে সলোমন তার চাকরি বদল করতে বাধ্য হন। চাকরি হিসেবে বেছে নেন স্টেজ
পার্ফরম্যান্স যেখানে তিনি তার এক্সট্রাঅর্ডিনারি মেমরির খেলা দেখাতেন। প্রথম প্রথম সব ভালোই চলছিল।
কিন্তু কয়দিন যেতে না যেতেই এখানেও সমস্যায় পড়েন। নিত্যনতুন মেমরী জমা হতে হতে একসময় মেমরি
ইন্টারফেয়ারেন্স শুরু হয়, বিশেষ করে একদিনে যখন তিন চারটা স্টেজ পারফরম্যান্স থাকত। আস্তে আস্তে
সলোমনের পারফরমেন্স খারাপ হতে থাকে।
শেষ জীবনটা সলোমনের খুব একটা ভাল কাটেনি। নিত্যনতুন স্মৃতির ভারে ভারাক্রান্ত সলোমন প্রতিনিয়ত
প্রার্থনা করত ভুলে যাওয়ার, ভুলে যেতে পারার। যে গুন আয়ত্ত্ব করার জন্য আমরা সবাই কমবেশি উদগ্রীব,
সলোমনের কাছে সেই গুনটিই হয়েছিল অভিশাপ।
আসলেই একবার ভাবুন তো, জীবনের সবকিছুই যদি আমাদের মনে থাকত, আমরা কী ভাল থাকতাম?
প্রিয়জন হারানোর বেদনা, ভগ্ন হৃদয়ের যাতনা কিংবা নিত্যনতুন ব্যর্থতা এগুলোর কোনটিই কী আমরা মনে
রাখতে চাই?
তাই কখনো যদি মনে করেন আপনি ডিপ্রেশন বা এংক্সাইটির কারনে ভুলে যাচ্ছেন কিংবা আপনার বাসার
বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিটির ডিমেনশিয়ার লক্ষন দেখা যাচ্ছে তখন চিকিৎসকের শরনাপন্ন হন৷ কিন্তু এসবের বাইরে
ভুলে যেতে পারাটা কোন ব্যর্থতা নয় বরং এটি একটি আশীর্বাদ।