স্টেম সেল থেকে অনেক রকমের সেল বা কোষ পাওয়া সম্ভব। যেমন, একটি ভ্রূণ যখন তৈরি হয় তখন সেল বা কোষগুলো একই রকম থাকে। এরপর আস্তে আস্তে সেলগুলো পরিবর্তীত হয়ে কোনটি রুপ নেয় লিভারের কোষে কোনটি কিডিনি আবার কোনটি মস্তিষ্কের বা চোখের। গবেষকদের মতে স্টেম সেল প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে মানবদেহের নষ্ঠ হয়ে যাওয়া কোষগুলো আবারও সচল করা সম্ভব।
এখন প্রশ্ন করতে পারেন কিভাবে তা সম্ভব?
ধরুন করো টাইপ ওয়ান ডায়বেটিস হলো, সেক্ষেত্রে তার বেটা সেলগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। এ অবস্থায় যদি তার শরীরে স্টেম সেল প্রতিস্থাপন করা হয় এবং এই স্টেম সেলগুলো তার শরীরে বেটা সেল তৈরি করে তাহলে তার ডায়বেটিসও সেরে যাবে! ঠিক একই ভাবে রোগ অথবা দুর্ঘটনায় শরীরের কোন অংশের কোষ নষ্ঠ হয়ে থাকলে সেই কোষগুলোকেও স্টেমসেল প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে সারিয়ে তোলা সম্ভব। একই ভাবে টাক মাথায় আবার নতুন করে চুল গজানোও সম্ভব।
আসুন জেনে নেওয়া যাক চিকিৎসা বিজ্ঞানে বর্তমান সময়ে বিশ্বের বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত বিষয় স্টেম সেল গবেষণা সম্ভবনা এবং বাস্তবতা সম্পর্কে।
স্টেম সেল (Stem cell) কি?
স্টেম সেল (Stem cell) হচ্ছে সেই আদিকোষগুলো যেগুলো তাদের গুনাগুণ অর্জন অথবা পরিত্যাগের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের কোষ তৈরি হয়ে বিভিন্ন কলা (Tissue), অঙ্গপ্রত্যঙ্গ (Organ) এবং তন্ত্র (System) তৈরির মাধ্যমে পুরো শরীরটা (Body) তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ একটা গাছের যেমন কান্ড (Stem) থাকে সেইরকম একটা কান্ড থাকে যার থেকে বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা বের হয়ে পুরো শরীরটা তৈরি করে, আমরা এই কান্ডের কোষগুলোকে স্টেম সেল বলছি।
স্টেম সেলের শ্রেনীবিন্যাস
স্টেম সেলের শ্রেনীবিন্যাস বিভিন্ন ভাবে করা যায়। আমরা এর উৎস হিসাবে দুরকমভাবে ভাগ করতে পারি যেমন:
- ভ্রূণজাত স্টেম সেল (Embryonic stem cell) এবং
- পরিনত বয়সের স্টেম সেল (Adult stem cell)।
ভ্রুণজাত স্টেম সেলের মূল উৎস হচ্ছে ভ্রুণ তৈরি হওয়ার সময় ভিতরের দিকের কোষগুলো (Inner cell mass, ICM)। সাধারণত ল্যাবোরেটরিতে উৎপাদিত ভ্রূণ থেকে এই সকল কোষের জোগান পাওয়া যায়।
Source: https://www.differencebetween.com/difference-between-trophoblast-and-inner-cell-mass/
আবার ভ্রুণজাত স্টেম সেলের কার্যকারিতা অনুযায়ী একে বিভিন্নভাবে ভাগ করা যায়। যেমনঃ
- টোটিপোটেন্সিয়াল সেল (Totipotential stem cell)
এরা হচ্ছে সবথেকে ক্ষমতাধর কোষ, অর্থাৎ এখান থেকে পুরো বাচ্চার শরীর এবং সাথে সাথে প্লাসেন্টা তৈরি হতে পারে। বাচ্চার embryonic এবং extraembryonic দুই ধরনের টিস্যু এখান থেকে তৈরি হয় বলে এইকোষগুলিকে টোটিপোটেনশিয়াল কোষ বলে। - প্লুরিপোটেনশিয়াল সেল (Pleuripotential stem cell)
এখান থেকে শুধু ভ্রুণজাত কোষ এবং টিস্যু তৈরি হতে পারে। - মাল্টিপোটেনশিয়াল সেল (Multipotential stem cell)
যেমন রক্তের আদি কোষ (Hemopoetic stem cell)। এখান থেকে শুধু রক্তের কোষই তৈরি হতে পারে, অন্য কোন কোষ নয়। - অলিগোপোটেনশিয়াল সেল (Oligopotential stem cell)
যেমন এখান থেকে মাইলয়েড বা ইরাথ্রয়েড অর্থাৎ হয় শ্বেত রক্ত কনিকা অথবা লোহিত রক্ত কনিকা তৈরি হবে, কোনভাবেই দুই ধরনের রক্ত কনিকা তৈরি হতে পারবে না। - ইউনিপোটেনশিয়াল সেল (Unipotential stem cell)
এখান থেকে শুধু একধরনের কোষ তৈরি হতে পারে। যেমন ডার্মাটোসাইট স্টেম সেল থেকে শুধু ডার্মাটোসাইট (Dermatocyte) অর্থাৎ চামড়ার কোষ তৈরি হবে।
পরিনত বয়ষের কোষগুলোকে সাধারনত তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়। যেমন:
- স্থায়ী কোষ (Permanent cell)
এগুলোকে পুনরায় বিভাজন প্রক্রিয়ায় আনা বর্তমানে চালু প্রকৃয়ায় সম্ভব নয়। - স্থিতিশীল কোষ (Stable cell)
এগুলোকে বিশেষ প্রকৃয়ার মাধ্যমে পুনরায় বিভাজন প্রকৃয়ায় আনা সম্ভব। - পরিবর্তনশীল কোষ (Labile cell)
এই কোষগুলি সবসময় বিভাজিত হতে থাকে এবং এগুলিকে সহজেই পরীক্ষাগারে বিভাজিত করা যায়।
এখন এইসব পুর্নবয়ষ্ক কোষগুলিকেও আবার বিশেষ প্রকৃয়ার মাধ্যমে পুনরায় বিভাজন সক্ষম করে পুনরায় স্টেম সেল তৈরি করা সম্ভব। আসলে প্রত্যেক কোষের মধ্যেই সব ধরনের জেনেটিক তথ্য দেওয়া থাকে এবং এই তথ্যসমূহকে বিশেষ প্রকৃয়ার মাধ্যমে (Using Epigenetic or Genetic influences) পুনরায় রিপ্রোগামিং (Reprogramming) করা সম্ভব।
একটা কোষ টোটিপোটেনশিয়াল থেকে যত ইউনিপোটেনশিয়ালের দিকে যাবে তার কোষ বিভাজন ও বিভিন্ন ধরনের কোষ তৈরির ক্ষমতা তত কমে যাবে। কোষ বিভাজনের সাথে সাথে কোষের বিভিন্ন ধরনের গুণাগুণ চাপা পড়ে যায় এবং বিশেষ ধরনের গুণগুলো প্রাধান্য পেয়ে প্রকাশ পায়, এর ফলে বিশেষায়িত কোষ হিসাবে এগুলো কাজ করে যেতে থাকে।
যত এইরকম বিশেষায়ন (Differentiation, Specialization) ঘটবে তত এই কোষকে স্টেম সেলে পরিনত করা কঠিন হবে। ২০০৬ সালে দুইজন বৈজ্ঞানিক Sheiya Yamanaka এবং Kazatoshi Takahashi পরিনত বয়সের মাল্টিপোটেন্ট স্টেম সেল থেকে প্লিউরিপোটেন্ট সেল বানাতে সক্ষম হলেন।
এরপর থেকে এই ইন্ডিউসড প্লিউরিপোটেন্ট স্টেম সেল (Induced pleuripotent stem cell, iPSC) তৈরি চলে আসছে এবং তা অনেকক্ষেত্রেই স্টেম সেলের উৎস হিসাবে কাজ করছে।
স্টেম সেল কালচার
চিকিৎসাক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য অনেক এই রকম কোষের প্রয়োজন হয় এবং কোষের সংখ্যাবৃদ্ধির জন্য এগুলোকে বিশেষ ধরনের মিডিয়াতে কালচার করা হয়।মিডিয়াতে বিভিন্ন ধরনের গ্রোথ ফ্যাক্টর এবং পুষ্টিকর কেমিক্যাল যেমন-DMEM/F12medicine, Selenium, Sodi-bi-Carb, L- ascorbic acid, Transferrin, Insulin, FGF,TGF-β,BMP ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়।
স্টেম সেলের মান নিয়ন্ত্রন
বিভিন্ন রকম টেস্টের মাধ্যমে স্টেম সেলের মান নিয়ন্ত্রন ও কার্যকারিতা নির্ধারন করা হয়। এগুলোর মধ্যে ক্যারিওটাইপিং (Karyotyping), শর্ট ট্যান্ডেম রিপিট এনালাইসিস (Short Tandem Repeat Analysis), ফ্লো সাইটোমেট্রি (Flow Cytometry), কোষের মরফোলজি (Cellular morphology), রেসিডুয়াল ভেক্টর টেস্টিং (Residual Vector Testing (one plasmid/100 cells is acceptable) ইত্যাদি প্রধান।
স্টেম সেল ব্যবহারের বৈধতা নির্ধারণ
স্টেম সেল ব্যবহারের নানান ধরনের বাধা রয়েছে, সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। নৈতিক এবং ধর্মীয় বাধা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের ইমিউনোলজিক্যাল, টিউমার তৈরি হওয়ার ভয়, সফলতা/বিফলতা ইত্যাদি বিষয়গুলো তো রয়েছেই। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর ভাইরাস, জীবানু বা ফাংগাসে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনাগুলো থেকে যায়। তবে বিভিন্ন ধরনের স্ক্রিনিং প্রোগামের মাধ্যমে এইসব সম্ভাবনাকে কমিয়ে আনা হয়।
স্টেম সেল থেরাপি
সাধারণত নাভীরজ্জুর রক্ত থেকে অথবা ভ্রুন থেকে ভ্রুণজাত স্টেম সেল তৈরি করা হয় এবং অস্থিমজ্জা থেকে প্রাপ্তবয়ষ্ক স্টেম সেল তৈরি করা হয়।এরপর সেগুলোকে কালচার করে সরাসরি ইঞ্জেকশন বা স্যালাইনের মাধ্যমে বা ক্যাথেটারের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করানো হয়।
তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে এর কার্যকারিতা লক্ষ্য করা যায়। বিভিন্ন ধরনের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেমন-চক্ষু, হার্ট, চামড়া, হাড়গোড়, মাংশপেশি, লিভার ইত্যাদি তৈরিতে এই স্টেম সেল ব্যবহৃত হচ্ছে। তাছাড়াও বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার বিশেষকরে অস্থিমজ্জার ক্যান্সার নিরাময়ে স্টেম সেল ব্যবহৃত হচ্ছে।
জয়েন্টের ব্যাথায় এর কার্যকারিতা প্লেটলেট রিচ প্লাজমার (Platelet rich plasma, PRP) থেকে বেশী। ডায়াবেটিস রোগীদের প্যানকৃয়াসের কার্যকারিতা ফেরত আনার কাজে, ক্রনিক কিডনি বা লিভার ডিজিসের কার্যকারিতা ফেরত আনার জন্য স্টেম সেল থেরাপি ব্যবহৃত হচ্ছে। দিনে দিনে এর প্রয়োগ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
উপসংহার
অন্য প্রানী থেকে কোষ বা অঙ্গ প্রতিস্থাপন করলে তাকে জেনোট্রান্সপ্লান্টেশন (Xenotransplatation) বলে। শুকরের জাইগোটের (Zygote) HLA জীন পরিবর্তন করে তাকে হিউমানাইজড (Humanized) করে কিডনি, হার্ট ইত্যাদি প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হয়েছে। অন্য মানুষের শরীর যেমন ভ্রুণজাত স্টেম সেল নিলেও সেগুলো শরীরের সাথে মিলে নাও যেতে পারে (Allogenic transplantation)।
কিন্তু নিজের শরীর থেকে স্টেম সেল নিয়ে অথবা পুর্ণ বয়ষ্ক কোষকে স্টেম সেলে (Induced Pleuripotent stem cell, IPSC) পরিবর্তিত করে নিলে এটা রিজেকশনের সম্ভাবনা অত্যন্ত কমে যায় (Autologus transplantation)।
Source: