মাঙ্কিপক্স (Monkeypox) একটি ভাইরাল জুনোসিস (viral zoonosis), জুনোসিস সে সমস্ত ভাইরাসকে বলা হয় যেগুলো প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ও সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন (CDC) জানাচ্ছে, অতীতে গুটিবসন্ত রোগীদের মধ্যে ঠিক যে লক্ষনগুলো দেখা যেতো মাঙ্কিপক্স ভাইরাস সংক্রমনের ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনই লক্ষণ দেখা যায়। তবে চিকিৎসাগতভাবে এই ভাইরাসটি তুলনামুলকভাবে কম ক্ষতিকর।
গুটিবসন্ত নির্মূল হয়ে যাওয়ার পরে যখন এর টিকা বন্ধ করা হয় তখন থেকেই মাঙ্কিপক্স ভাইরাসের প্রাদুর্ভার রয়ে গেছে কিছু দেশে। এই ভাইরাসটি মুলত মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকায় বেশি দেখা যায়, তবে গ্রীষ্মমন্ডলীয় রেইনফরেস্টের কাছাকাছি যে সকল শহরাঞ্চল রয়েছে সেখানেও এর প্রাদুর্ভাব দিনে দিনে বৃদ্ধি ঘটছে।
মাঙ্কিপক্স ভাইরাস কি?
মাঙ্কিপক্স একটি এনভেলপড ডাবল-স্ট্র্যান্ডেড ডিএনএ ভাইরাস এবং এটি পক্সভিরিডে পরিবারের অর্থোপক্সভাইরাসের অন্তর্গত। এই ভাইরাসের রয়েছে দুটি স্বতন্ত্র জেনেটিক ক্লেড। একটি মধ্যে আফ্রিকান (কঙ্গো বেসিন) ক্লেড এবং অপরটি পশ্চিম আফ্রিকান ক্লেড। তবে কঙ্গো বেসিন ক্লেড থেকে গুরুতর রোগ সৃষ্টির প্রমান রয়েছে এবং এটির সংক্রমিত করার ক্ষমতাও বেশি বলে ধারণা করা হয়। আর ক্যামেরুন একমাত্র দেশ যেখানে এই ভাইরাসের দুটি ক্লেডই পাওয়া গেছে।
এ পর্যন্ত মাঙ্কিপক্স ভাইরাস সংক্রমণের জন্য যেসকল প্রাণীকে সংবেদনশীল হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে তার মধ্যে উল্লেযোগ্য কাঠবিড়ালি, গাম্বিয়ান পাউচড ইঁদুর, ডর্মিস, নন হিউম্যান প্রাইমেট (বানর, হনুমান বা গরিলা শ্রেনী)।
মাঙ্কিপক্স ভাইরাস সংক্রমণের ইতিহাস
১৯৭০ সালে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কঙ্গোতে ৯ বছর বয়সী একটি ছেলের শরীরে প্রথম মাঙ্কিপক্সের জীবাণু শনাক্ত করা হয়েছিল। ১৯৭০ সাল থেকে আফ্রিকান মোট ১১টি দেশে মাঙ্কিপক্স সংক্রমন ঘটেছে যার মধ্যে রয়েছে: ক্যামেরুন, বেনিন, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, গ্যাবন, কোট ডি’আইভরি, নাইজেরিয়া, লাইবেরিয়া, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, দক্ষিণ সুদান এবং সিয়েরা লিওন।
১৯৯৬ থেকে ৯৭ সালে, কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে মাঙ্কিপক্স সংক্রমণ রিপোর্ট করা হয়েছিল, সেখানে সংক্রমণের হার ছিলো স্বাভাবিকের থেকে বেশি তবে মৃত্যুর অনুপাত ছিলো কম। এর পর ২০১৭ সাল থেকে এই ভাইরাসের সংক্রমণ অব্যাহত রয়েছে যার মধ্যে নাইজেরিয়াতে ৫০০ টিরও বেশি সন্ধেহজনক ঘটনা পাওযা যায়, যার মধ্যে ২০০ জনেরও বেশি মানুষের শরীরে নিশ্চিত সংক্রমণ সনাক্ত করা হয়। এসময় এই ভাইরাসে আক্রান্তের মধ্যে মৃত্যুর হার ছিলো প্রায় ৩% এরও বেশি।
সম্পর্কিত প্রবন্ধঃ ভাইরাস! বিভিন্ন সময় মানব সভ্যতাকে থমকে দিয়েছে যে পরজীবী |
মাঙ্কিপক্স ভাইরাসের বাহক
মাঙ্কিপক্সের হোস্ট বা এই ভাইরাসের প্রধান বাহক সম্পর্কে এখনও নিশ্চিত কোন তথ্য গবেষকরা জানতে সক্ষম হননি। তবে ধারণা করা হয় আফ্রিকান ইঁদুর এই ভাইরাস সংক্রমণের ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করে। তবে মাঙ্কিপক্স সৃষ্টিকারী ভাইরাসটি এর আগে মাত্র দুবার কোনো বণ্য প্রাণীর শরীর থেকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।
যার মধ্যে প্রথমটি ছিলো ১৯৮৫ সালে কঙ্গোর নিরক্ষীয় অঞ্চলে একটি অসুস্থ আফ্রিকান ইঁদুর (রপ কাঠবিড়ালি) এবং দ্বিতীয়টি ছিলো ২০১২ সালে কোট ডি’আইভারের তাই ন্যাশনাল পার্কে একটি মৃত শিশু ম্যাঙ্গাবে।
যেসকল মাধ্যমে মাঙ্কিপক্স ভাইরাস সংক্রমণ ঘটে
বিশ্বজুড়ে কোভিড ১৯ সংক্রমণের ঢেও যেতে না যেতেই আমাদের ভয় দেখাতে শুরু করেছে মাঙ্কিপক্স ভাইরাস সংক্রমণ। বাংলাদেশে এখনও পর্যন্ত এই ভাইরাসের সংক্রমণ পাওয়া যায়নি তবে সতর্কতা নেওয়া শুরু হয়েছে ইতোমাধ্যে। ভয় নয় বরং সচেতনতা ও সতর্কতা জরুরী এ রোগের সংক্রমণ থেকে দুরে থাকতে। আর তাই জনা প্রয়োজন রোগটি কিভাবে ছড়াতে পারে। আসুন জেনে নেওয়া যাক কিভাবে এই ভাইরাসটির সংক্রমণ ঘটে থাকে।
সংস্পর্শের মাধ্যমে সংক্রমনঃ
মাঙ্কিপক্স ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত কোন মানুষ, প্রাণী বা উপাদানের সংস্পর্শ থেকে এই ভাইরাস ছড়াতে পারে।
শ্বাসযন্ত্রের মাধ্যমে সংক্রমণঃ
ভাইরাসটি ভেঙ্গে যাওয়া অংশ বা ত্বক যা দৃশ্যমান নাও হতে পারে, তা চোখ, নাক বা মুখ দিয়ে বা শ্বাসযন্ত্রের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে সংক্রমণ ঘটাতে পারে।
পশু-থেকে-মানুষে সংক্রমণ (জুনোটিক)
সংক্রমিত পশুর কামড় বা আচঁড় থেকে অথবা সংক্রমিত পশুর শরীরের ক্ষতস্থান থেকে নির্গত ফ্লুইড থেকেও মানুষের শরীরে সংক্রমণ ঘটতে পারে। এছাড়া সংক্রমিত পশুর মাংস সঠিক তাপমাত্রায় ফুটিয়ে না খেলেও সংক্রমণ হওয়া সম্ভব।
মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ
প্রাথমিকভাবে গবেষকরা ধারণা করছেন মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ ঘটে ড্রপলেটের মাধ্যমে, তবে ড্রপলেট বাতাসে মাত্র কয়েক ফুটের বেশি যেতে পারেনা তাই অধিকসময় সংক্রমিত ব্যক্তির সাথে মুখোমুখি যোগাযোগ প্রয়োজন হয়। এছাড়া সংক্রমিত মানুষের শরীরের ক্ষত বা তরল উপাদানের সাথে সরাসরি সংস্পর্শ এবং ক্ষত উপাদানের সাথে পরোক্ষ সংস্পর্শ যেমন দূষিত পোশাক বা বিছানার মাধ্যমেও সংক্রমণ ঘটতে পারে।
মাঙ্কিপক্স ভাইরাস সংক্রমণের উপসর্গ
মাঙ্কিপক্স সংক্রমণের ইনকিউবেশন পিরিয়ড (সংক্রমণ থেকে উপসর্গ প্রকাশ সময়কাল) সাধারণত ৬ থেকে ১৩ দিন, তবে তা ৫ দিন থেকে ২১ দিন পর্যন্তও হতে পারে।
আক্রমণ শুরু থেকে ৫ দিনের মধ্যে তীব্র মাথাব্যথা, জ্বর, লিম্ফ নোড ফুলে যাওয়া, পিঠে ব্যথা, পেশীতে ব্যথা এবং দুর্বলতা প্রকাশ পাবে। লিম্ফ্যাডেনোপ্যাথি বা লিম্ফ নোড ফুলো যাওয়া উপসর্গটি মাঙ্কিপক্সের একটি সাতন্ত্র উপসর্গ যা হাম বা গুটিবসন্ত থেকে মাঙ্কিপক্সকে আলাদা করেছে।
সাধারণত জ্বর হওয়ার ১ থেকে ৩ দিনের মধ্যে ত্বকের ফুসকুড়ি ওঠা শুরু হয়। ফুসকুড়িগুলো শরীরে অন্যান্য অংশের তুলনায় মুখ এবং হাতের দিকে বেশি দৃশ্যমান। ফুসকুড়িগুলো হতে পারে সমতল ক্ষত আকারে (ম্যাকুলস), কিছুটা উচু ও শক্ত আকারে (প্যাপিউলস), স্বচ্ছ তরলে ভর্তি ক্ষত আকারে (ভেসিকল), হলুদ তরলে ভরা ক্ষত আকারে (পুস্টুলস) এবং ক্রাস্ট যা শুকানোর পরে পড়ে যায়।
মাঙ্কিপক্স রোগের লক্ষনগুলি সাধারণত ২ থেকে ৪ সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হয়ে থাকে। এবং বড়দের তুলনায় শিশুরা এই রোগের ভাইরাস দ্বারা বেশি সংক্রমিত হয়।
মাঙ্কিপক্স সংক্রমণ পরবর্তি যে সকল জটিলতা বা সেকেন্ডারি ইনফেকশন রয়েছে তার মধ্যে উল্লেযোগ্য, ব্রঙ্কোপনিউমোনিয়া, সেপসিস, এনসেফালাইটিস এবং কর্নিয়ার সংক্রমণে দৃষ্টিশক্তি হারানো।
শেষ কথা
মাঙ্কিপক্স রোগটি মূলত গুটিবসন্ত বা চিকেনপক্স গোত্রভুক্ত একটি রোগ, তবে গুটিবসন্তের চেয়ে কম মারাত্মক। আর এইসব রোগের বেশিরভাগই সুষম খাবারদাবার গ্রহণ ও পরিমিত বিশ্রামে মেডিকেশন ছাড়াই দুই থেকে এক সপ্তাহের ভিতরেই ঠিক হয়ে যায়।
তার পরেও অবহেলায় এই রোগটি ছড়িয়ে পড়তে পারে মহামারি আকারে। তাই এই রোগটি মহামরী আকারে ছড়ানোর আগেই প্রয়োজন সচেতনতা। আতঙ্কিত না হয়ে রোগটি সম্পর্কে জানুন নিজে সচেতন হয়ে অন্যকে সচেতন করুন। সকলে নিজ নিজ পরিবার পরিজন নিয়ে ভাল ও সুস্থ্য থাকুন।
রেফারেন্সঃ |
---|
https://www.cdc.gov/poxvirus/monkeypox https://www.who.int/news-room/fact-sheets/detail/monkeypox |