এই যে, আমাদের সামনে ঘটে যাওয়া সবকিছুকে আমরা প্রত্যক্ষ করি, কালোকে কালো দেখি, সবুজকে সবুজ, ফুলের সৈন্দর্য দেখে বিমোহিত হই। অর্থাৎ জগতের যাবতীয় বস্তুর আকার, রং অবস্থান এগুলো সবই দেখি তাদের গঠন অনুযায়ী, কিন্তু কেন! আমরা কি কখনও তা ভেবে দেখেছি? এইরকম কিছু ভাবনা-চিন্তা থেকেই উদ্ভব হয়েছে চেতনার স্বরুপ (Consciousness) ব্যাখ্যা করার প্রচেষ্টা। আজকের এই নিবন্ধটিতে চেতনার স্বরুপ কি- তা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বোঝার এবং বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
চেতনা কি?
চেতনা নিয়ে ধোঁয়াশা এখনও কাটেনি, একদিকে যেমন চলছে বিতর্ক সাথে সাথে সমানভাবে চলছে গবেষণা। একাধারে দার্শনিক থেকে শুরু করে মনস্তত্ত্ববিদ, স্নায়ুবিজ্ঞানী, পদার্থবিজ্ঞানী, চিকিৎসাবিজ্ঞানী, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্ত্বা বিশেষজ্ঞ সহ সকলেই গবেষণা করে চলেছেন চেতনার একটি যুতসই ব্যাক্ষা দাড় করাতে। তবে এখন পর্যন্ত এর যুতসই ব্যাখ্যা খুঁজে পেতে সামর্থ্য হননি কেউই।
যত মত, তত পথ! অর্থাৎ, বিতর্ক থাকলেই সমাধান আসবে, আর এই প্রত্যয়েই সুত্রপাত করছি আলোচনার।
চেতনার যে সাধারণ ব্যাক্ষা রয়েছে, তার কঠিন কঠিন শব্দ, সংজ্ঞা, অস্পষ্ট পরিভাষার ব্যবহার সহ আরো অনেক কিছুই রয়েছে যা স্পষ্টতই ইঙ্গিত করে যে, বিষয়টি সম্পর্কে আমাদের জানার বা বোঝার এখনও অনেক বাকী রয়েছে, আরও অনেকটাই পথ পাড়ি দিতে হবে।
চেতনা কি আমাদের মন? অথবা, নিছক মস্তিষ্কের কাজ? এটা কি একক না সামগ্রিক? চেতনা বিষয়টি কি শুধুই মানুষের, না কি এই পৃথীবির জীবন্ত সব কিছুর? না কি এটা ছড়িয়ে আছে জীব-জড় সবকিছুরই ভিতর? তবে আমরা একটি বিষয় এখানে নিশ্চিত যে, নিম্ন শ্রেনীর প্রানীর তুলনায় উচ্চ শ্রেনীর প্রানীর ভিতর ক্রমশ এক ধরনের উন্নয়ন দেখতে পাই, চেতনার মাত্রিকতার বিচারে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে সাধারনত গ্লাসগো কমা স্কেল (Glasgow Coma Scale) দিয়ে অজ্ঞানের মাত্রা নির্ধারন করা হয়। একটা রোগীর চেতনা ফিরে পাবার সম্ভাবনা কতটুকু তাও নিরূপণ করা হয় এই স্কেল দিয়ে। তবে বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় এর পরিধি আরও বিস্তৃত। আমাদের বহির্জগত, আর অন্তরজগতের সাথে যোগাযোগ, আমাদের শিক্ষা-দীক্ষা, অভিজ্ঞতা, ভাষা, স্মৃতিশক্তি, কল্পনা ইত্যাদি নানাবিধ বিষয় এর অর্ন্তভুক্ত।
এ সম্পর্কিত একটি লেখাঃ রোগের তীব্রতা এবং এর ফলাফল
চেতনার অবস্থান
একথা ঠিক যে, চেতনার অবস্থান মস্তিষ্কে, হৃদপিন্ডে নয়। মস্তিষ্কের ব্রেনস্টেমের স্নায়ুজালিকা (Reticular activating system) থেকে কিছু স্নায়ুশাখা থ্যালামাসের ভিতর দিয়ে মস্তিষ্কের উপরিভাগে (Cerebral cortex) গিয়ে শেষ হয়। ব্রেনস্টেম থেকে আমরা পাই Feeling বা অনুভুতি, এবং তা যখন সেরিব্রাল কর্টেক্স এ পৌঁছয় তখন তৈরী হয় সচেতন অনুভব বা Cognition.
আগে ধারণা করা হতো যে, কেবলমাত্র সেরিব্রাল কর্টেক্সেই অনুভুতি বা চেতনার কেন্দ্রবিন্দু থাকে, কিন্তু পরবর্তী গবেষণাই তা ভুল প্রমানিত হয়েছে। মানুষের মস্তিষ্কের সামনের অংশটাই (Prefrontal lobe) রয়েছে মানুষের ব্যক্তিত্ত্ব, স্মৃতিশক্তি, বুদ্ধিমত্তা, ভাষাশিক্ষা, অঙ্কশিক্ষা ইত্যাদির কেন্দ্র।
তবে কোনভাবেই তা চেতনার একমাত্র কেন্দ্র নয়, কারন মানুষের মস্তিষ্কের এই অংশ নষ্ট হয়ে গেলেও এমনকি সেরিব্রাল কর্টেক্স নষ্ট হয়ে গেলেও মানুষের কিছু কিছু চেতনা বর্তমান থাকে।
বিভিন্ন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভুতিগুলো ত্বক, চক্ষু, কর্ন, নাসিকা ও জিহ্বার মাধ্যমে স্নায়ুতন্ত্রে প্রবেশ করে। তার মধ্যে একটা অংশ সরাসরি সেরিব্রাল করটেক্সে এবং অন্যান্য অংশগুলো প্রথমে রেটিকুলার এক্টিভেটিং সিস্টেমে প্রবেশ করে তারপর সেরিব্রাল করটেক্সে শেষ হয়।
সুতরাং চেতন অবস্থা তৈরির জন্য ব্রেন স্টেমের রেটিকুলার এক্টিভেটিং সিস্টেম এবং সেরিব্রাল করটেক্স উভয়েই গুরুত্বপুর্ণ ভুমিকা পালন করে থাকে।
চোখের ক্ষেত্রে একধরনের অস্থায়ী মেমোরি (Visual short term memory) তৈরি হয় যা অনেকটা কম্পিউটারের ক্যাশ মেমোরির (Cache memory) মত কাজ করে। এর পরে সেখান থেকে দীর্ঘ মেয়াদি মেমোরির সৃষ্টি হয়, যা আমরা অনুভব (Perception) করতে পারি।
মানুষের চোখ অনেকটাই সাধারণ ক্যামেরার মত কাজ করে। যেখানে অল্পসময়ের জন্য স্মৃতি ধরে রাখে পরবর্তীতে সচেতনভাবে তা অনুভব করার জন্য।
এখানে সেন্সরী সিগন্যালগুলো বটম আপ (Bottom up) একটা ত্রিমাত্রিক ইমেজ (3-D image) তৈরী করে আর পুর্বের অভিজ্ঞতার আলোকে ব্রেন থেকে আসা টপ ডাউন (Top down) ইমেজের সঙ্গে মিথক্রিয়া করে দৃষ্টিশক্তির সচেতনতা তৈরী করে।
আমাদের শ্রবন পদ্ধতি এবং অন্যান্য সেন্স অরগ্যান গুলোও অনেকটা একইভাবে কাজ করে।
আমরা কোন বস্তু সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ করে মস্তিষ্কের ভিতর একটা মডেল তৈরী করি। প্রয়োজন অনুযায়ী তথ্য যোগ-বিয়েগ করে মডেলটিকে ক্রমাগত আপডেটেড করে রাখি, এবং প্রয়োজনের সময় তাকে ব্যবহার করে থাকি।
এর ফলে কোন সেলিব্রিটিরি মুখমন্ডলের কিছুটা অংশের ছবি দেখে তাকে সহজেই চিনতে পারি। অথবা তার ছবিতে বয়সজনিত পরিবর্তন থাকলেও আমাদের চিনতে কোন সমস্যা হয়না।
আমরা শুধু বহির্জগত সম্বন্ধেই মডেল নির্মাণ করিনা, আমরা নিজেদের সম্বন্ধেও একজাতীয় মডেল নির্মাণ করে রাখি। মানুষের তৈরী এই মডেল এখানেই শেষ হয়ে যায়না, সে তার পরিচিত আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব, পরিবেশ, প্রতিবেশ সবকিছুরই মডেল নির্মাণ করে রাখে। এবং সেই সাথে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সেইসব মডেল কি ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাবে তাও আত্মস্থ করে রাখে।
আমাদের সচেতনতা শুধুমাত্র ডাটা প্রসেসিং এবং কম্পিউটেশন নিয়েই ব্যস্ত থাকেনা। কম্পিউটারের সঙ্গে এর বহুবিধ পার্থক্য রয়েছে। সচেতনতার অবস্থান এর থেকে আরও অনেক বেশী ব্যাপক।
এই লেখকের আরো একটি লেখাঃ প্রাণের উৎস সন্ধানে বিজ্ঞানের যত গবেষণা!
চেতনা উপলব্ধি এবং বোঝার ভিত্তি
এ পর্যন্ত যে আলোচনা, তাতে আসলে বোঝা সম্ভব নয় যে, চেতনার গঠনগত অবস্থানটি আসলে কি। এটা কি সিম্পল ফিজিক্যাল কম্পিউটেশন্যাল ডাটা প্রসেসিং না অন্য কিছু। কেউ কেউ অবশ্য মনে করেন যে, বিষয়টি ফিজিক্যাল অনু বা পরমানু দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়না, বরং পরমানুর অভ্যন্তরস্থ ইলেক্ট্রনের বিভিন্ন ধরনের বিন্যাস দিয়ে এটাকে ব্যাখ্যা করা যায়।
তবে প্রশ্ন উঠেছে যে, ’সচেতনতা’ পদার্থ বিজ্ঞানের কোন ধারাকে অনুসরণ করে, ক্লাসিক্যাল নিয়ম না কোয়ান্টাম নিয়ম। স্যার রজার পেনরোজ সেই ১৯৯০ সাল থেকেই একটা তত্ত্ব দিয়ে আসছেন। যেটাকে আমরা অরকেস্ট্রেটেড ওবজেক্টিভ রিডাকশন (Orch OR) বলে থাকি।
এই অরকেস্ট্রেটেড ওবজেক্টিভ রিডাকশন (Orch OR) অনুযায়ী স্নায়ুকোষের অভ্যন্তরে থাকা মাইক্রোটিবিউলের ভিতরে কোয়ান্টাম ক্রিয়ার কারণে সচেতনতা সৃষ্টি হয়। বিষয়টি এতটাই জটিল যে, বুঝতে গেলে ফ্র্যাক্টাল, অয়েভ ফাংশন ইত্যাদি বিষয়গুলোও বুঝতে হবে।
মস্তিষ্ককে বুঝতে পারা কতটা সহজ?
আমাদের ব্রেনে থাকা ৮৬ বিলিয়ন নিউরন আর ১০০ ট্রিলিয়ন কানেকশনকে বুঝে ফেলা যেমন কোন সহজ কাজ নয়, তেমনই তার কার্যকারিতা নির্ধারণ করা বা ব্রেনের রেপ্লিকা তৈরী করাও এতটা সহজ নয়।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে যেসব গবেষণা এখন চলছে তা ব্যাসিক ব্রেন ফাংশন নিয়েই চলছে। তবে রোবোটিক্সের গবেষণা ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে। ইনফরমেশন প্রোসেসিং ( Information Processing) পদ্ধতিরও অগ্রগতি হয়েছে অনেক। বোঝা (Perception), স্মৃতি (Memory) ইত্যাদি সম্বন্ধে অনেকখানি অগ্রগতি করতে পেরেছি এবং এইসব পদ্ধতি এখন কম্পিউটারে ব্যবহৃত হচ্ছে।
ব্রেন, মাইন্ড এবং বিহেভিয়ার
চেতনার অস্তিত্ব মস্তিষ্ক বা ব্রেনে, এতে কোন সন্দেহ নাই। অনেকে মনে করেন চেতনা ছড়িয়ে আছে বিশ্বজগত ধরে। এবং আমাদের মস্তিষ্ক এখানে একটা ইন্সট্রুমেন্ট হিসাবে কাজ করে এই সামগ্রিক চেতনার খন্ডিত একটা অংশ নিয়ে কাজ করার জন্য।
বেশীর ভাগ মিস্টিকদের (Mystic) দের এমনটাই ধারণা যে, আমাদের মৃত্যুর সাথে সাথে এই চেতনা আবার সেই সামগ্রিক চেতনার সাথে মিশে যায়। ব্যাপারটা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমানিত না হলেও, এর পক্ষে কিছু কিছু প্রমান হাজির করা হয়।
নিয়ার ডেথ এক্সপেরিয়েন্স (Near death experience) থেকে বেঁচে আসা মানুষেরা এই জাতীয় অভিজ্ঞতার কথা বর্ননা করেছেন অনেকেই। এদের মধ্যে শিক্ষিত লোক এমনকি নিউরোসার্জন, নিউরোসায়েন্টিস্ট পর্যন্ত রয়েছেন।
তারা যে শুধুমাত্র পাবলিসিটির জন্য এমনটা বলছেন, তারও কিন্তু তেমন প্রমান নেই। তাই একটা ধোয়াসার সৃষ্টি হয়েছে ব্রেন বহির্ভুত চেতনার অস্তিত্ত্ব নিয়ে।
তবে বেশীরভাগ বৈজ্ঞানিকেরা মনে করছেন, চেতনা মস্তিষ্কের একটা ফাংশন, ব্রেন হচ্ছে একটা ফিজিক্যাল বিয়িং (Physical being) আর মন (Mind) হচ্ছে এর মানসিক (Mental) অংশ।
ব্রেন তৈরী নিউরোন, রক্তনালী এবং বিভিন্ন রকমের সহায়ক কোষ দিয়ে। একে স্পর্শ করা যায়, ওজন করা যায় এবং এর উপর সার্জারীও করা যায়। অপরদিকে মাইন্ড বা মনকে স্পর্শ করা যায় না, ওজন করা যায়না এবং এর উপর সার্জারীও করা যায়না।
রোগাক্রান্তের ক্ষেত্রেও দুটোই আলাদা আলাদা রোগ দিয়ে আক্রান্ত হয়। ব্রেন আক্রান্ত হয় বিভিন্ন ধরনের নিউরোলজিক্যাল প্রব্লেম দ্বারা, আর মন আক্রান্ত হয় বিভিন্ন ধরনের সাইকোলজিক্যাল প্রব্লেম দ্বারা। ঠিক একই ভাবে দুটোর জন্য চিকিৎসক এবং চিকিৎসা পদ্ধতিও আলাদা।
নিউরোলজিস্ট বা নিউরোসার্জন চিকিৎসা করেন ব্রেনের রোগ নিরাময়ে, আর সাইকিয়াট্রিস্ট চিকিৎসা করেন মনের রোগ নিরাময়ে।
আমরা মন দিয়ে চিন্তাভাবনা করি এবং সিদ্ধান্ত নেই, আর আমাদের আচরণ (Behavior) দিয়ে তা প্রকাশ করি বিভিন্নভাবে। কেউবা ভদ্র বা নম্রতার সঙ্গে আবার কেউবা রূঢ়ভাবে, আবার কেউ তা প্রকাশ করেন কান্নাকাটির মাধ্যমে।
আমরা মনকে সহজে মাপতে পারিনা কিন্তু আচরণকে (Behavior) মাপতে বা বিশ্লেষণ করতে পারি। জেনেটিক, এনভায়রনমেন্টাল আর এপিজেনেটিকের প্রভাব রয়েছে আমাদের ব্রেন, মাইন্ড এবং বিহেভিয়ার এর উপর।
মাইন্ডের স্তর
সিগ্মুন্ড ফ্রয়েডের (Sigmund Freud, 1856 – 1939) বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা মাইন্ডের তিনটি স্তর পাই, যথাঃ
- সচেতন (Conscious)– সজ্ঞান অবস্থায় আমরা যেসব চিন্তা এবং কর্ম তৎপরতা করে থাকি। যেমন, আমরা যে ফুলের সৌন্দর্য দেখি অথবা ফুলের গন্ধ পাই তা আমাদের সচেতন অবস্থা।
- অবচেতন (Subconscious)– এটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলতে থাকে। আমরা এই অবস্থাটিকে বুঝতে পারিনা, কিন্তু এটাকে সচেতন অবস্থার ভিতর ফেরত আনতে পারি। আমাদের নিঃশ্বাস-প্রঃশাস, আমাদের হৃদপিণ্ডের কর্ম তৎপরতা ইত্যাদি সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, অবচেতন অবস্থায়। কিন্তু যখন এটাকে সচেতন অবস্থায় আনা হয় তখন অস্বস্তি শুরু হয়ে যায়।
- অচেতন (Unconscious)– আমাদের পুরানো ঘটনা, স্মৃতি ইত্যাদি এর অন্তর্ভুক্ত। আমরা অনেক কসরত করে পুরানো স্মৃতিকে আবার স্মরনে আনতে পারি।
দৈত্ববাদ (Dualism) / অদৈত্ববাদ (Non-dualism)
পরস্পর বিপরীতমুখী ঘটনাদ্বয়কে যখন আমরা দুইটি ঘটনা হিসাবেই দেখি তখন তাকে আমরা দৈত্ববাদ বলি। আর যখন বিপরীতমুখী ধারনার মধ্যেও একটা ঐক্য সুত্র খুঁজে পাওয়া যায় তখন তাকে আমরা অদৈত্ববাদ বলে থাকি।
ওয়েস্টার্ন এবং ভারতীয় দুই দর্শনেই দৈত্ববাদ এবং অদৈত্ববাদ রয়েছে। এরফলে মাইন্ড/ বডি, আত্মা/ শরীর ইত্যাদির ভিতর পার্থক্য বা সাযুজ্য কল্পিত হয়েছে। তাই চেতন অবস্থা একটা সামগ্রিক চেতনার অংশ হিসাবে কোন কোন দর্শনে কল্পিত হয়েছে।
অদ (ID), ইগো (Ego), সুপার ইগো (Super Ego)
ফ্রয়েডের সাইকো এনালাইসিস তত্ত্ব অনুযায়ী মানুষের ব্যক্তিত্ব তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত। অদ, ইগো এবং সুপার ইগো। অদ পুরোটাই অচেতন, ইগো সচেতন এবং সুপার ইগোর অসচেতন অবস্থা রয়েছে।
অদ হচ্ছে একদম মজ্জাগত প্রাথমিক কামেচ্ছা (Libido) বা আগ্রাসন (Aggression) যা ভাল মন্দ হিসাব করেনা, এর প্রাথমিক উদ্দেশ্য হচ্ছে মজা পাওয়া বা মজা করা। বয়স বাড়ার সাথে সাথে শিক্ষা-দীক্ষা বিচার-বুদ্ধির উন্নয়নের সাথে সাথে তাকে নিয়ন্ত্রণ করে ইগো।
ফ্রয়েড এখানে তুলনা করেছেন ঘোড়ার সাথে ঘোড়সওয়ারের। এখানে ঘোড়া হচ্ছে অদ আর ঘোড়সওয়ার হচ্ছে ইগো। ইগো বিচার বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়, অদ কে বাস্তবতার নিরিখে তৃপ্তি দেয়। সুপার ইগো আমাদের বিবেক এবং নৈতিকতা নিয়ে অসচেতন অবস্থায় কাজ করে।
বস্তুবাদ (Materialism)/ভাব বাদ (Idealism)
বস্তুবাদীদের মতে বস্তু থেকে চিন্তার উৎপত্তি হয়, আর ভাববাদীদের মতে আগে চিন্তা পরে বস্তু। তবে দীর্ঘকাল ধরেই এ বিতর্ক চলে আসছে। এখন পর্যন্ত এক মতবাদ আর এক মতবাদকে সম্পুর্নভাবে পরাস্থ করতে পারে নাই।
তবে, আমরা এতুকু বুঝতে পারছি প্রাথমিক ধারনাসমুহ আগে বস্তু থেকেই শুরু হয়। পরবর্তিতে ধারণাসমুহ বিভিন্ন সেন্সরী ইম্পালস (Sensory Impulse) থেকে অস্থায়ী মেমোরি হয়ে মস্তিষ্ক থেকে আসা পুরানো অভিজ্ঞতার আলোকে সচেতনতার স্তরে উন্নীত হয়।
এখানে সেন্সরী ইম্পালসগুলো বস্তু থেকে আসছে আর প্রজেকশন আসছে মস্তিষ্ক থেকে। এখানে প্রজেকশন বিষয়টি পুর্ব অভিজ্ঞতার ফসল, যা বস্তুগত।
এখন আমরা যেসব বিমুর্ত (Abstract) বিষয়ে চিন্তা করি, যেমন ভালবাসা, দুঃখ, ঈশ্বর-চিন্তা তা কি বস্তুগত?
এখানে বস্তুবাদীরা বিষয়টিকে একভাবে ব্যাখ্যা করবেন, আর ভাববাদীরা ব্যাখ্যা করবেন আরেকভাবে। তবে সবার যুক্তিই একরকম প্রায় অকাট্য। এই প্রায়টাই আমাদেরকে প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করতে দেয় না।
কোয়ান্টাম ফিজিক্সের উদ্ভবের পর বস্তুর সংজ্ঞা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বস্তু আলটিমেটলি কি? এটা কনা (Particle) না ওয়েভ বা তরঙ্গ (Wave) না উভয়ই?
আবার ডার্ক মেটার (Dark Matter) রয়েছে যার ভিতর দিয়ে সহজেই আলো পাস করে যায়, যার অস্তিত্ব অনুভব করা যায় শুধুমাত্র গ্রাভিতেশনাল ইফেক্টের মাধ্যমে। বস্তু আর এনার্জী আবার পরষ্পরে রুপান্তরিত হতে পারে। তাহলে বস্তু কি?
কার্ল মার্ক্সের (Karl Marx) সংজ্ঞা অনুযায়ী মেটার এর ব্যাখ্যা আরও ব্যাপক। মেটার বলতে বুঝায় বিশ্বপ্রকৃতি, মহাবিশ্ব, সচেতনতা, স্পেস-টাইম, এনার্জী ইত্যাদি যাবতীয় পদার্থ এবং শক্তি, এর অন্তক্রিয়া, ব্যাখ্যা এবং জ্ঞান। সমস্ত একজিস্টেন্স (Existence) একেবারে। সুতরাং এটা সবকিছুই ব্যাখ্যা করছে।
ভাব বাদ প্রমানের চাইতে (Objectivity) মনকেই বেশী প্রাধান্য দেয় (Subjective)। এটা বাস্তবতাকে একজাতীয় ইল্যুশন (Illusion) মনে করে। এখানে মনই প্রধান, সে আইডিয়ার (Idea) জন্ম দেয়। আমরা একজিস্টেন্স আর রিয়ালিটিকে দেখি সেই মন বা চিন্তন এর নিরিখে।
মানুষের সচেতনতা ব্যাখ্যায় হয়ত একটা কম্প্রোমাইজের দরকার হবে, যেমনটা দেখেছি আমরা সচেতনতা ব্যাখায় সেন্সরি ইম্পালস আর ব্রেনের প্রজেকশনের ক্ষেত্রে।
উপসংহার
আমি এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নই, যার ফলে হয়তো লেখাটি খাপছাড়া, অসম্পুর্ন ও একপেশে মনে হতে পারে। মুলত এই প্রসঙ্গটির অবতারনা করা হয়েছে চিন্তার এই জগতকে তুলে ধরার জন্য। যাতে মানুষ যুক্তি দিয়ে ভাবতে শেখে, প্রশ্ন করতে শেখে, বিশ্লেষন করতে শেখে।