১৮৮৬ সালে তামাক গাছের রোগ নিয়ে সর্বপ্রথম কাজ শুরু করেন প্রাণরসায়নবিদ Adolf Mayer (এডলফ মেয়ার) । এর পরে ১৮৯৮ সালে ওলন্দাজ জীবাণুতত্ত্ববিদ Martinus Beijerinck (মারটিনিয়াস বাইজেরিনিক) অনুমান করেন যে, তামাক গাছের রোগের কারন এক ধরনের সংক্রমণশীল জীবন্ত তরল পদার্থ। এবং তিনিই সর্বপ্রথম এই সংক্রমণশীল তরলের নামকরণ করেন ভাইরাস হিসবে।
১৯৩৫ সালে ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ আবিষ্কারের পরে প্রথম ভাইরাসের স্থিরচিত্র ধারণ করেন জার্মান ইঞ্জিনিয়ার Ernst Ruska (আর্নস্ট রুসকা) এবং Max Knoll (ম্যাক্স নোল)। এর ঠিক ২০ বছর পরে ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে Heinz Fraenkel-Conrat (ফ্রয়েংকাল -কনরোট) ও Robley C. Williams (রোবেলি উইলিয়ামস) প্রমাণ করে দেখান যে, নিউক্লিক এসিডই ভাইরাস রোগের বাহক। এবং তারা রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রোটিন হতে ভাইরাসের নিউক্লিক এসিডকে পৃথক করে দেখান।
উদ্ভিদ ও প্রাণী সহ ব্যাকটেরিয়া, সায়ানোব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাকের দেহের সজীব কোষে ভাইরাস সক্রিয় অবস্থায় বেচে থাকতে পারে। আবার নিষ্ক্রিয় অবস্থায় টিকে থাকতে পারে বাতাস, মাটি ও পানিসহ সব জড় মাধ্যমে। আর এই কারনেই বলা হয়, জীব এবং জড় উভয় পরিবেশই ভাইরাসের আবাস।
ভাইরাস কি?
ভাইরাস হচ্ছে একধরনের প্রোটোসেল যা হয় ডিএনএ (DNA- Deoxyribonucleic Acid, Single stranded/ Double stranded) অথবা আর এন এ (RNA- Ribonucleic Acid, Single stranded/ Double stranded) দ্বারা গঠিত। এর চারপাশে ঘিরে থাকে প্রোটিনের একটা আবরনী (Capsid)। কোন কোন ভাইরাসের থাকে লিপিডের (Lipid) একটা পর্দা।
এই আবরণী বা পর্দা ভেদ করে থাকে নানা ধরনের প্রোটিন বা গ্লাইকোপ্রোটিন যা ভাইরাসকে বিভিন্ন কোষের সাথে যুক্ত হতে অথবা কোষাভ্যন্তরে প্রবেশ করতে সহায়তা করে। ভাইরাসের যেহেতু বিপাক (Metabolism) এবং বংশবৃদ্ধি (Growth and Multiplication) ক্ষমতার অভাব রয়েছে, তাই এরা বাধ্যতামূলকভাবে প্যারাসাইট (Obligatory intracellular Parasite)। এরা আক্রান্ত কোষের মেশিনারি (Machinery) ব্যবহার করে বেঁচে থাকে এবং বংশবিস্তার করে।
বাইরের আবহাওয়ায় ভাইরাস বেশিক্ষন টিকে থাকতে পারে না। এই অল্প সময়ের ভিতর যদি কোন কোষকে আক্রান্ত না করতে পারে তবে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। সুতরাং ভাইরাসকে তার নির্ধারিত সময়ের ভিতর শরীরে প্রবেশ করতে না দিলে সমস্ত ভাইরাসগুলি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে, এবং ভাইরাসজনিত রোগটি আর হতে পারে না। ভাইরাসের জীবনচক্র কোষের ভিতরে এবং বাইরে, এভাবেই পুনরাবৃত্ত হতে থাকে। কোষের বাইরে সে অনেকটা মৃত, আবার কোষের অভ্যন্তরে সে জীবিত।
বেশীরভাগ ভাইরাস আমাদের উপকার করে থাকে, অল্প কিছু রোগের কারন হয়ে থাকে। বলা হয়ে থাকে, এই মহাবিশ্বে যত গ্রহ- উপগ্রহ, নক্ষত্র আছে, এই পৃথিবীতে তার থেকে অনেকগুন বেশী ভাইরাস রয়েছে। গবেষণায় দেখা যায়, এই গ্রহে ভাইরাসের পরিমান প্রায় ১০ ননিলিয়ন্স ( ১০৩১) এর মত। ভাইরাস না থাকলে কোন কিছুর পচন সম্ভব হতো না, ফলে পৃথিবী ভরে যেত আবর্জনায়।
প্রায় ২০০ মত ভাইরাস আছে যারা মানুষের রোগ সৃষ্টি করতে পারে। রোগ সৃষ্টির জন্য ভাইরাসকে মানুষের কোষকে আক্রমন করতে হলে কোষের ভিতর প্রবেশ করতে হবে। তবে বেশীরভাগ ভাইরাসের এই ক্ষমতা নেই, কারন বিষয়টি ঠিক এমন যে, উপযুক্ত তালায় উপযুক্ত চাবি প্রবেশ না করালে তালা খুলবে না।
যার ফলে এত বহুসংখ্যক ভাইরাস আমাদের চারপাশে থাকা সত্ত্বেও ভাইরাস জনিত রোগের সংখ্যা এত কম। আর এন এ (RNA) ভাইরাসের মিউটেশন করার প্রবনতা বেশী থাকায় তারা যেকোন সময় মানব কোষকে আক্রমন করে বসতে পারে। কোভিড-১৯ রোগের ক্ষেত্রেও ঠিক এরকমটাই হয়েছে।
ভাইরাসের প্রকারভেদ
ভাইরাসকে শ্রেণীবদ্ধ করার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। সাধারনত বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের অসুখ অনুযায়ী এদেরকে শ্রেণীভুক্ত করা হয়, যেমন, হেপাটাইটিস ভাইরাস এ, বি, সি ইত্যাদি। আবার এদের আকার আকৃতি অনুযায়ী ভাগ করা হয়, যেমন করোনা ভাইরাসের বিভিন্ন গোত্র।
আবার আর এন এ (RNA), ডি এন এ (DNA), এক রজ্জু বিশিষ্ট, দ্বি রজ্জু বিশিষ্ট, এনভেলপড অথবা ন্যাকেড ভাইরাস হতে পারে। কিছু কিছু ত্রুটিপুর্ন ভাইরাস রয়েছে যারা অন্য একটি ভাইরাসের অবস্থান ছাড়া বাচতে পারেনা, যেমন ডেল্টা ভাইরাস হেপাটাইটিস বি ভাইরাস ছাড়া বাচতে পারে না।
এখানে ত্রুটিপুর্ন ডেল্টা ভাইরাসকে বেচে থাকার জন্য হেপাটাইটিস ভাইরাসের মেশিনারী ব্যবহার করতে হয়। জীবাণুরও ভাইরাস আছে, যেগুলো শুধুমাত্র জীবানুকেই আক্রমণ করে থাকে, এগুলিকে ব্যাক্টেরিওফেজ (Bacteriophage) বলা হয়।
ভাইরাস কিভাবে মানব শরীরে প্রবেশ করে?
ভাইরাস বেশ কয়েকটি পথে মানব শরীরে প্রবেশ করতে পারে। যেমন, মুখ, চোখ, নাক দিয়ে শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমে। আবার চর্ম বা ইনজেকশনের মাধ্যমেও শরীরে প্রবেশ করতে পারে। রক্ত সঞ্চালন ও অঙ্গ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমেও শরীরে ঢুকতে পারে ভাইরাস।
আর এইসব ভাইরাস শরীরের সংস্পর্শে আসতে পারে বায়ু বা পানিবাহিত হয়ে, খাদ্যদ্রব্যের মাধ্যমে, আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশির থেকে নির্গত ড্রপলেটের মাধ্যমে অথবা নিবিড় শারীরিক সংস্পর্শ যেমন যৌনকর্মের মাধ্যমে।
ভাইরাস কিভাবে রোগ তৈরি করে?
ভাইরাস আক্রান্ত কোষের বিপাক প্রক্রিয়া, এনজাইম প্রক্রিয়া, জেনেটিক প্রক্রিয়া কে ব্যবহার করে থাকে তার বংশবৃদ্ধির জন্য ফলে আক্রান্ত কোষটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আক্রান্ত কোষের এন্টিজেনিক গুনাগুণে পরিবর্তন ঘটে যার ফলে এরা শরীরের রোগ প্রতিরোধী সিস্টেম দ্বারা আক্রান্ত হয়, এবং আক্রান্ত কোষগুলি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
এন্টিজেনিক পরিবর্তনের ফলে, অথবা এন্টিজেনিক সাদৃশ্যতা (Antigenic Mimicry) থাকার ফলে আক্রান্ত কোষগুলির মধ্যে নানা ধরনের স্ব-আক্রমন্যতা (Autoimmunity) তৈরি হয় অথবা টিউমার বা ক্যান্সার তৈরি করতে দেখা যায়।
কোন কোন সময় ভাইরাল ইনফেকশন আর রোগ প্রতিরোধকারী সিস্টেমের ভিতরকার অন্ত্যক্রিয়ার ফলে প্রচুর পরিমানে সাইটোকাইন, কেমোকাইন ইত্যাদি নির্গত হতে থাকে। এতে হিতে বিপরীত হয়ে যায়, কোষ, অঙ্গ প্রত্যঙ্গ, সিস্টেম ভেঙ্গে পড়ে এবং শরীর ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।
সার্স করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে ঠিক এমনটাই ঘটছে। এছাড়া দেহে রক্তনালীর প্রদাহ সৃষ্টি হওয়ার ফলে রক্ত জমাট বাঁধতে পারে। শুধু তাই নয়, এই জমাট বাঁধা রক্ত লাংস, হার্ট বা শরীরের অন্য কোন রক্তনালীতে ছুটে গিয়ে তৈরি করতে পারে ব্লক। ফলে হতে পারে পালমোনারী এম্বোলিজম, হার্ট এটাক, ডিভিটি ইত্যাদি।
ভাইরাসজনিত যত ক্ষতিকর রোগ
বিশ্বে সময়ে সময়ে যে সকল মাহামরীগুলো দেখা দিয়েছে তার বেশিরভাগই ভাইরাসজনিত সংক্রমন। নিচে জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও প্রাণঘাতী কিছু ভাইরাস ও এর থেকে সৃষ্ট রোগ সম্পর্কে কিছু তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
মারবার্গ ভাইরাস (Marburg virus)
১৯৬৭ সালে জার্মানীর একটি ল্যাবরেটরিতে কর্মীদের ভিতর ছড়িয়ে পড়ে মারবার্গ নামের এই ভাইরাসটি। উগান্ডা থেকে নিয়ে আসা বানর থেকে প্রথমে আক্রান্ত হয় ল্যাবের কর্মীরা। এই রোগের লক্ষন ছিলো হেমোরেজিক ফিভার ও শক। প্রথমে মৃত্যুহার ২৫% থাকলেও পরবর্তীতে ১৯৯৮-২০০০ সালে কংগো তে এবং ২০০৫ সালে এঙ্গোলায় এই মৃত্যুহার বেড়ে ৮০% এর মত দাঁড়ায়।
ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস (Influenza Virus)
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী প্রত্যেক আক্রমনে কম করে হলেও প্রায় ৫লক্ষ লোক ইনফ্লুয়েঞ্জায় বিশ্বব্যাপী মারা যায়। ইনফ্লুয়েঞ্জার মিউটেশন এত বেশি যে, এই রোগের ক্ষেত্রে প্রতিরোধক ভ্যাক্সিন ততটা কার্যকর নয়।
২৪,০০ বছর আগে গ্রিক বিজ্ঞানী হিপোক্রেটিস প্রথম ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগের লক্ষণগুলো চিহ্নিত করেন। এর পরে বিশ্বব্যাপি ইনফ্লুয়েঞ্জার কারনে অনেক মহামারী ঘটেছে। তবে সবথেকে ভয়ঙ্কর ছিলো ”স্প্যানিশ ফ্লু”।
ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস (Type A, H1N1) এর আক্রমনে ১৯১৮ থেকে ১৯১৯ সালের মধ্যে মারা যায় প্রায় ৫ কোটির উপরে মানুষ। এর পরে ১৯৫৭ থেকে ১৯৫৮ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস (Type A H2N2) এর আক্রমনে মারা যায় ১৫ লক্ষের উপরে মানুষ, যেটাকে নাম দেওয়া হয় “এশীয় ফ্লু”।
ইবোলা ভাইরাস (Ebola virus)
ইবোলা ভাইরাস সংক্রমণের লক্ষনগুলি প্রকাশ পায় আক্রান্ত হওয়ার ২ থেকে ৩ সপ্তাহ পরে। জ্বর, গলা ব্যথা, মাংশপেশীর ব্যথা, মাথা ধরার সাথে যুক্ত হয় বমি এবং ডাইরিয়া। আস্তে আস্তে লিভার ও কিডনীর কর্মক্ষমতা কমে যাওয়াতে শুরু হয় রক্তপাতজনিত সমস্যা ফলে মৃত্যুও হতে পারে।
১৯৭৬ সালে ইবোলা ভাইরাস প্রথম চিহ্নিত হয় সুদান ও কঙ্গোতে এবং এখনও পর্যন্ত প্রতি বছর ১০০০ এর বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। তবে এই ভাইরাসের সংক্রমন মহামারী আকার ধারণ করে সাহারা ও আফ্রিকার ট্রপিক্যাল অঞ্চলগুলোতে। ইবোলা ভাইরাস আক্রমনে মৃত্যুর হার অনেক বেশি যা, ৫০% থেকে ৯০%-এর মধ্যে।
রেবিজ ভাইরাস (Rabies Virus)
রেবিজ একপ্রকার নিউরোট্রপিক ভাইরাস যা মানুষ ও প্রাণী দেহে জলাতঙ্ক রোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী। এই ভাইরাসটি প্রাণী ও মানুষের মুখের লালারসের মাধ্যমে ছড়ায়। রেবিজ ভাইরাসের টিকা আবিষ্কার হয়েছে ১৯২০ সালে। কুকুর, বিড়াল ইত্যাদির কামড়ালে আক্রান্ত ব্যাক্তিকে যদি রোগের স্ফুটনকালের মধ্যে টিকা না দেওয়া হয় তবে মৃত্যুর সম্ভাবনা প্রায় ১০০%।
এইচআইভি ভাইরাস (HIV- Human immunodeficiency virus)
এই ভাইরাসটি মহামারী তৈরি না করলেও মানবদেহে প্রবেশ করার পর আস্তে আস্তে Helper T-cell (CD4) নষ্ট করে দেয়। রোগী ভাইরাসের স্ফুটনকাল (Incubation period) পার হওয়ার পর HIV পজিটিভ হয় এবং ৮-১০ বছরের মাথায় পুর্নাংগ AIDS রোগ দেখা দেয়।
AIDS এর ফলে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়, ফলে বিভিন্ন ধরনের সেকেন্ডারি ইনফেকশনও গুরুত্বর হয়ে ওঠে অথবা ক্যান্সারে আক্রান্ত মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হয়।
আফ্রিকায় এইচ আই ভি ভাইরাস এর মারাত্মক রুপ দেখতে পাওয়া যায়। যেখানে পুর্নবয়ষ্ক প্রতি ২৫ জনের মধ্যে ১ জন এইচ আই ভি পজিটিভ। এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী ১৯৮০ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৪ কোটি লোক এই ভাইরাসের আক্রমনে মৃত্যুবরন করেছে।
১৯৮১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের Center of Disease Control and Prevention (CDC) প্রথম এই রোগটি শনাক্ত করতে সক্ষম হয় এবং ১৯৮৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের বিজ্ঞানীরা এই রোগের ভাইরাস শনাক্ত করতে সক্ষম হয়।
গুটি বসন্ত (Small pox Virus)
গুটিবসন্ত বা ইংরেজিতে বলা হয় Smallpox, এই ভাইরাসজনিত ছোয়াচে রোগটি শুধুমাত্র মানুষের দেহে সংক্রমন ঘটায়। ভ্যারিওলা মেজর বা ভ্যারিওলা মাইনর এই দুটির মধ্যে যে কোন একটি ভাইরাসের আক্রমনেই হতে পারে গুটিবসন্ত।
তবে ১৯৭৭ সালের পরে এই রোগটির আর কোন সংক্রমন ঘটেনি, ফলে ১৯৮০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) গুটিবসন্ত নির্মূল হয়ে যাওয়ার ঘোষনা দেয়। তবে নির্মুল হওয়ার আগ পর্যন্ত এই রোগে মারা গেছে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ কোটি মানুষ।
ডেঙ্গু জ্বর (Dengue Fever)
ডেঙ্গু বা ডেঙ্গি জ্বর মশা বাহিত ভাইরাসজনিত রোগ যা এডিস মাশার কামড়ে সংক্রমন ঘটে। ভাইরাস সংক্রমিত হলে শরীরে তিন থেকে পনেরো দিনের মধ্যে জ্বরের উপসর্গ দেখা দেয়। যখন ডেঙ্গু ভাইরাস বহনকারী এডিস মশা কাউকে কামড়ায়, তখন মশার লালার মাধ্যমে ডেঙ্গু ভাইরাস মানুষের শরীরের প্রবেশ করে।
প্রতি বছর প্রায় ৫-১০ কোটি লোক ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়। এই রোগে মানুষের মৃত্যু হার গড়ে ২.৫%। তবে এই রোগ ঠেকানোর জন্য রয়েছে ভ্যাক্সিন।
রোটা ভাইরাস (Rota virus)
রোটা ভাইরাস খুবই সংক্রামক একটি ভাইরাস যা মুলত ডায়রিয়ার প্রধান কারণ। ভ্যাকসিন আবিষ্কারের আগে পর্যন্ত বেশিরভাগ শিশুরা ৫ বছর বয়সের মধ্যে কম করে হলেও একবার এই ভাইরাসে সংক্রামিত হতো। রোটা ভাইরাস সংক্রমনের ফলে প্রতি বছর ডায়রিয়া ও পানিশূণ্যতায় প্রায় ৫-৬ লাখ শিশু মারা যায়।
করোনা ভাইরাস (MERS-CoV/SARS CoV-2)
মিডল ইস্ট রেসপিরাটরী সিন্ড্রোম (মার্স করোনাভাইরাস বা MERS-CoV)-রিলেটেড করোনাভাইরাস বাদুড় থেকে প্রথমে সংক্রমণ ঘটে উটের শরীরে তারপর ছড়িয়ে মানুষের শরীরে সৌদি আরব সহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। এই সংক্রমণের ঘটনাটি খুব বেশিদিন আগের নয়, ২০১২ সালের।
সিভিয়ার একিউট রেস্পিরেটরি সিনড্রোম (SARS CoV-2) নামের করোনাভাইরাস সংক্রমনে ২০০৩ সালে আক্রান্ত হয়েছিলেন ৮ হাজারেরও বেশি মানুষ এবং মোট ১৭টি দেশে মৃত্যুর সংখ্যা দাড়িয়েছিলো ৭৭৪ জনে যার বেশির ভাগ পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়।
মার্সের মৃত্যুহার বর্তমান কোভিড-১৯ ভাইরাসের তুলনায় অনেক বেশী ছিল। যেখানে কোভিড-১৯ ইনফেকশনে মৃতুহার ২.৫-৩%, সেখানে মার্স করোনা ভাইরাস ইনফেকশনে মৃত্যুহার ছিল ৩০-৪০%।
করোনা ভাইরাস (COVID 19) মিউটেশনের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত চেহারা পাল্টিয়ে বিভিন্নরকম ভ্যারিয়ান্টের জন্ম দিচ্ছে, যা আরও বেশী সংক্রামক ও ভয়ঙ্কর করে তুলছে এই ভাইরাসটিকে। এখন অপেক্ষা করার পালা কবে এই ভাইরাসটি আরও মিউটেশন হয়ে অবশেষে অসংক্রামক হয়ে উঠবে।
অবস্থাদৃষ্টে যা প্রতিয়মান তা হচ্ছে, করোনাভাইরাস সংক্রমণের ফলে সৃষ্ট ইমিউনিটি, ভ্যাক্সিনেশনের ফলে সৃষ্ট ইমিউনিটি এবং মিউটেশনের ফলে ভাইরাসের অসংক্রমনতাই এই রোগ থেকে বাচার একমাত্র উপায়। তবে লকডাউন দিয়ে চেষ্টা করা হচ্ছে ভাইরাসের ইনফেকশন চেইনটাকে ভেঙ্গে দেওয়ার।
মার্স ভাইরাস ছিল স্বল্প সময়ের জন্য। ভাক্সিন আবিষ্কারের পূর্বেই বিভিন্নরকম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ফলে এই রোগের প্রাদুর্ভাব শেষ হয়ে যায়। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের ভ্যাক্সিন রয়েছে করোনা ভাইরাসের (COVID 19) বিরুদ্ধে যা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে প্রতিরোধ সৃষ্টি করতে ব্যবহৃত হচ্ছে। সাথে সাথে ব্যক্তিগত সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য বিধিনিষেধ দিয়ে একটা সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে করোনা ভাইরাসকে নির্মূল করার।
করোনা ভাইরাস (COVID 19) সম্পর্কিত লেখা |
---|
করোনা- আপাতঃ সারসংক্ষেপ COVID 19 থেকে সুরক্ষায় ব্যবহৃত যত ভ্যাকসিন |
জীবানুযুদ্ধে ভাইরাস
প্রাচীনকাল থেকেই জীবানু অস্ত্র বিভিন্নভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। যেমন, শত্রু শিবিরে মৃতদেহ ফেলে রেখে আসা, জীবানুযুক্ত কম্বল উপহার হিসাবে পাঠানো, রোগের জীবানু অথবা টক্সিন দিয়ে পানি, খাদ্যদ্রব্য দুষিত করে শত্রু শিবিরে ঢোকানর ব্যবস্থা করা। এই সবই যুদ্ধের কৌশল হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে এবং এখনও যে হচ্ছেনা তা নিশ্চিত করে বলা যায়না।
রাসায়নিক এবং জীবানু অস্ত্র ব্যবহারের বিপক্ষে নানান ধরনের আন্তর্জাতিক আইন-কানুন, বিধি-নিষেধ রয়েছে। অথচ মুখে মানবতা, মানবাধিকার, ব্যক্তিস্বাধীনতা ইত্যাদির কথা বললেও বিশ্বের মোড়ল দেশগুলোই এ ব্যাপারে অগ্রগামী। গুটি বসন্ত, এন্ত্রাক্স, কলেরার জীবানু নিয়ে গোপনে সবাই গবেষণারত। বায়োটেররিজম (Bioterrorism) এখন একটা বাস্তবতা।
যতদিন মানুষ ব্যক্তির উপরে সামগ্রিকতাকে স্থান না দেবে। ডমিনেশনের চিন্তা বাদ না দেবে। বিভিন্ন প্রকার বৈষম্য এবং শোষণ দূর না করবে, ততদিন এর থেকে মুক্তি নেই।