আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এগারো-বারো বছর বয়স থেকেই বয়ঃসন্ধিকাল শুরু হয়ে যায়। নারী ও পুরুষ হয়ে ওঠার এই সময়টাতে শারীরিক পরিবর্তনের সাথে সথে মানসিক পরিবর্তনও ঘটে। মানুষের শারীরবৃত্তীয় বিষয়গুলো নিয়ে কৌতুহলের সাথে সাথে তৈরি হয় বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ। তাই এই সময়টা থেকেই ছেলে-মেয়ে সবার জন্যই যৌনস্বাস্থ্য বিষয়ে সঠিক জ্ঞান থাকাটা জরুরী।
বয়ঃসন্ধির অনুভুতি ও বর্তমান প্রেক্ষাপট
খিদে পেলে খেতে চাওয়াটা যেমন স্বাভাবিক আর প্রাকৃতিক, ঠিক তেমনই ছেলেমেয়েরা বড় হলে প্রেম করতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক। প্রেম-ভালবাসা হৃদয়ঘটিত বিষয়গুলো কোন বাধাতেই যেমন আগে কখনও থেমে থাকেনি তেমন এখনও থেমে থকবেনা এটাই স্বাভাবিক। তবে সময়ের বিবর্তনে এবং প্রযুক্তির সহজলভ্যতায় অনুভূতিগুলো ব্যক্ত করা আরো সহজ হয়েছে মাত্র। আগেকার সময় থেকে এখনকার সময়ের প্রেক্ষাপট যেমন ভিন্ন তেমনই চাহিদাগুলোও ভিন্ন।
এখনকার সময়ে প্রেম মানেই হলো এক পর্যায়ে একটা টাচি-ফিলি ব্যাপার, যার চুড়ান্ত পরিনতিতে হতে পারে যৌনমিলন। এবসটিনেন্স (abstinence) বা এই চুড়ান্ত অনুভুতি থেকে বিরত থাকতে সবাই পারে না। বিয়ে পর্যন্ত অপেক্ষা করার ধৈর্যও সবার থাকে না আবার এর প্রয়োজনও সবাই সমান ভাবে অনুভব করে না।
তাহলে উপায়?
উপায় হলো, বয়ঃসন্ধিকালের থেকেই সন্তানকে যৌনস্বাস্থ্য বিষয়ে সঠিক বিষয়গুলো শেখানো। সঠিক যৌনজ্ঞানই পারে এখনকার সময়ে অনেক বিপদ থেকে আমাদের বাচ্চাদের রক্ষা করতে।
যৌনস্বাস্থ্য ভাবনা, সেকাল আর একাল
নিজের অভিজ্ঞতার থেকেই বলি। যখন ছোট ছিলাম, বয়ঃসন্ধিকাল, শরীরে পরিবর্তন আসছে, মনে তার নিত্য দোলা, নারীবিষয়ে অসীম কৌতুহল। তবে কৌতুহল মেটানোর জন্য তখন উপযুক্ত কোন তথ্যভান্ডার সহজলভ্য ছিলো না। আবার যে কাউকে প্রশ্ন করে জানবো, সেই সুযোগও ছিলো না।
পাঠ্য-পুস্তকেও কিছু নেই। হকারের মজমা আর পাকনা টাইপ বন্ধু – এই ছিলো ‘জ্ঞানের’ উৎস। ভয়ংকর সেই সব জ্ঞান। কতটা ভয়ংকর তার দু একটা উদাহরণ দিই – ৮০ ফোঁটা রক্তে একফোঁটা বীর্য সুতরাং সেই বীর্য কোনভাবে নষ্ট হলে অপূরণীয় ক্ষতি, ফলশ্রুতিতে ধ্বজভংগ রোগ, মানে হলো নারীকে সন্তুষ্ট করতে না পারা, কারন পুরুষের চেয়ে নারীর যৌনশক্তি ৮ গুন বেশি ইত্যাদি ইত্যাদি।
অর্থাৎ নারী মানে, যৌনমিলনের ক্ষেত্রে প্রবল একটা প্রতিপক্ষ এবং তাঁকে পরাস্ত করাই পুরুষ জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। আর এর জন্য দরকার ঘন্টার পর ঘন্টা মিলনে সক্ষম একটি বড় লৌহকঠিন পুরুষাংগ! ব্যাস। প্রেম না, পূর্বরাগ না, শৃংগার না, কেবল পুরুষাংগকেন্দ্রিক আসুরিক শক্তি থাকলেই তুমি পুরুষ।
এই ‘জ্ঞান’ নিয়ে বড় হচ্ছিলাম কিন্তু অন্তরে অশান্তি ছিলো। অনেক প্রশ্ন আসতো এই মনে, ভাবতাম প্রেম কোথায় তবে? নারীকে ভালো না বেসে কি সঙ্গম করা যায়? এই যে নারী-পুরুষের জগদ্বিখ্যাত যত সব প্রেম কাহিনী, তবে সেগুলো কি কেবলই শুধু আসুরিক যৌনতা?
এই যে শেক্সপিয়ার বলছেন “If I should think of love, I’d think of you” অথবা “it is the east, and Juliet is the sun” এখানে তবে সেই জ্ঞান থেকে জানা পুরুষাঙ্গ কোথায়? বা আসুরিক শক্তি কোথায়?
যৌনস্বাস্থ্য বিষয়ে কিভাবে জানাবেন সন্তানকে
সবকিছু এগিয়েছে, ফেলে আসা সময়ের সাথে এখন পার্থক্য অনেক। প্রচুর বিজ্ঞানসম্মত তথ্যের প্রবাহ আছে এখন, যা থেকে যৌনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়গুলো সঠিকভাবে জানা সম্ভব। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এসবের অপব্যবহারও হচ্ছে প্রচুর। তাই এই বিষয়ে আমার কিছু পরামর্শ রেখে যেতে চাই সকলের জন্য।
বাবা-মা’দের উদ্দেশ্যেঃ
নিজে আগে ভালকরে জানুন এবং বাচ্চাদের যতটা স্পষ্ট করে সম্ভব ততটা স্পষ্ট করে জানান। মেয়েশিশুরা সহজেই মায়ের সাথে শারীরিক ব্যাপারে ঘনিষ্ঠ হতে পারে তবে সমস্যা হলো ছেলেশিশুদের ক্ষেত্রে। ছেলেদের কাছে বাবারা যেমন কিছুটা দূরের তেমনই মায়েদের কাছে রয়েছে সংকোচ। এক্ষেত্রে বাবা-মা দুজনে আলোচনা করে সমাধান বের করুন কিভাবে জানাবেন।
একটি বিষয় অবশ্যই মনে রাখবেন যে, আপনি না বললেও আপনার সন্তান কিন্তু বিষয়গুলো অবশ্যই জানবে, সে ক্ষেত্রে জানাটা যে সবসময় সঠিক হবে তা নাও হতে পারে। তাই জানবেই যখন, তখন আপনার কাছ থেকে ঠিকটাই জানুক।
সরাসরি মুখে বলতে না পারেন বই পড়ে তাদের জানার সুযোগ করে দিন। বাজারে বেশ কিছু বই আছে সেগুলো কিনে দিন। যেমন বিদ্যুৎ মিত্রের ‘যৌনজ্ঞান’, আবুল হাসানাতের ‘যৌনবিজ্ঞান’, বাৎস্যায়নের ‘কামসূত্র’।
ছেলে-মেয়েদের উদ্দেশ্যেঃ
- বেশি বেশি বই পড়ুন (চটি নয়)। সিনেমা দেখে শেখার চেষ্টার চেয়ে বই পড়ে শেখা সবসময়ের জন্যই ভালো। এতে কল্পনাশক্তির বিকাশ ঘটে। বড় হলে দেখবেন, যৌনতায় কল্পনার ভূমিকাই সবথেকে বেশি।
- জানার জন্য ইন্টারনেটের সাহায্য নিতে পারেন তবে খেয়াল রাখবেন তা যেন পর্নগ্রাফির আসক্তিতে রূপ না নেয়। মনে রাখবেন পর্নগ্রাফি সত্যিকার প্রেমময় কোন যৌনতা নয়, এটা প্রচুর মিথ্যার সমষ্টি।
- যৌন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের আকার বা গঠন নিয়ে কখনও কোন অহেতুক হীনম্মন্যতা বা অহংকার থাকলে তা অবশ্যই দূর করে ফেলুন। পরিপূর্ণ ও সুখী যৌনজীবনে জন্য এসবের ভূমিকা খুবই সামান্য।
- যৌনতা পাপ নয়, এটা জীবনের অনিবার্য একটি আনন্দের উৎস। একে সম্মান করুন এবং উপভোগ করুন। সকল প্রাণীর মধ্যেই যৌনতা আছে তবে মানুষই একমাত্র প্রাণী যারা যৌনতাকে প্রোক্রিয়েশন থেকে রিক্রিয়েশনে রূপ দিতে পেরেছে। অর্থাৎ একমাত্র মানুষই ‘হ্যাভিং সেক্স’ কে ‘মেকিং লাভ’ -এ রুপান্তর করতে পেরেছে।
- লাস্ট বাট নট দি লিস্ট, কখনোই নিজেদের শারীরিক ঘনিষ্ঠতার ভিডিও চিত্র বা ছবি মোবাইলে বা অন্য কোন মাধ্যমে ধারণ করবেন না। মোবাইল ছিনতাই হতে পারে বা হারিয়ে যেতে পারে বা নষ্ঠ হলে সার্ভিসিংয়েও দিতে হতে পারে। অথবা আজকের প্রেমিক কালকের ব্লাকমেইলারও হয়ে যেতে পারে।