আকাশ জুড়ে ছুটে আসছে সারি সারি মিসাইল কিন্তু কোনটিই টার্গেটে আঘাত করতে পারছে না। রাতের বেলা ইসরায়েলের আকাশে হামাসের ছোড়া ঝাকে ঝাকে রকেটগুলো আলোর ঝলকানিতে আতশবাজির মত আকাশেই ধ্বংশ হয়ে যাচ্ছে একের পরে এক। এ যেন এক ম্যাজিক বলয় যা রক্ষা করে চলেছে ইসরায়েলকে রকেট হামলা থেকে। তবে বাস্তবে এটা ম্যজিক নয় এটা ইসরাইলের তৈরি প্রযুক্তি নির্ভর আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আয়রন ডোম এর কারসাজি।
আয়রন ডোম কি?
ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্প আয়রন ডোম (Iron Dome) এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম একটি ব্য়য়বহুল সয়ংক্রিয় আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এটি মুলত স্বল্প দুরত্বের রকেট, ক্ষেপনাস্ত্র ও আর্টিলারি শেল হামলা মোকাবেলা করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। এটি রাফায়েল অ্যাডভান্সড ডিফেন্স সিস্টেম নামেও পরিচিত।
যে কোন আবহাওয়ায় রাত্র অথবা দিনে যে কোন সময় ৪ থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে সবধরনের ক্ষেপনাস্ত্র, রকেট ও আর্টিলারি শেল হামলা প্রতিহত প্রতিহত করা সহ অনুমোদনহীন যে কোন বিমান ধংস করতে সক্ষম এই আয়রন ডোম অ্যাডভান্সড ডিফেন্স সিস্টেমটি।
তবে ইসরায়েল আশা করছে ভবিষ্যতে আয়রন ডোমের ইণ্টারসেপ্টিং রেঞ্জ ৭৫ কিলোমিটার (৪৫ মাইল) থেকে ২৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব। এছাড়াও এই প্রযুক্তিকে আরো ভারসেটাইল করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের, যার ফলে আয়রন ডোমের মাধ্যমে একসাথে দু’দিক থেকে আসা যে কোন হামলাই প্রতিহত করা সম্ভব হবে।
আয়রন ডোম তৈরির পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন
২০০৬ সালে দ্বিতীয় লেবানন যুদ্ধে হিজবুল্লাহ প্রায় ৪ হাজারের ও বেশি কাত্যুশা রকেট হামলা চালায় উত্তর ইসরায়েলের তৃতীয় বৃহত্তম শহর “হাফিয়া” সহ আশপাশের এলাকায়। এর ফলে ৪৪ ইসরায়েলি মারা যান এবং প্রায় আড়াই লখের বেশি ইসরায়েলি নাগরিক বাসস্থান ছাড়া হন।
অন্যদিকে দক্ষিন ইসরায়েলও আক্রান্ত হয় হামাসের ছোড়া রকেট দ্বারা। হামাস ২০০০ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজারেরও বেশি রকেট ও মর্টার আক্রমন করছে ইসরায়েলের উপর। সাধারণ হিসাব অনুযায়ী হামাসের আক্রমনের সীমানার মধ্যে রয়েছে ইসরায়েলের ১০ হাজারেরও বেশি জনগোষ্ঠী। ফলে এই সংগঠনগুলোর রকেট হামলা থেকে রক্ষা পেতেই মুলত ইসরায়েল সিন্ধান্ত নেয় প্রযুক্তির সাহায্যে একটি সয়ংক্রিয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা উদ্ভবনের।
আয়রন ডোম প্রথম ডিজাইন করা হয় ২০০৫ সালে, এটার ডিজাইন ও উৎপাদন দুটোই যৌথভাবে করেছে Rafael Advanced Defense Systems এবং Israel Aerospace Industries কর্তৃপক্ষ। আর আয়রন ডোম ব্যাটল ম্যানেজমেন্ট কন্ট্রোল সিষ্টেমস (BMC) এর জন্য কোর প্রোগ্রামিং করেছে mPrest Systems. নামে আরেকটি ইসরায়েলি কোম্পানি।
আয়রন ডোম তৈরির অর্থায়ন ও খরচ
আয়রন ডোম প্রকপ্লটিতে অর্থায়ন করছে যৌথভাবে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র। তবে প্রথম দিকের দুইটি আয়রন ডোম ব্যাটারি তৈরি হয়েছে সম্পূর্ন ইসরায়েলের একক অর্থায়নে। এবং যুক্তরাষ্ট্র অর্থ ও ইন্টারসেপ্টর মিসাইল দিয়ে সহায়তা করেছে পরের ব্যাটারি গুলোতে।
আয়রন ডোম একটি অত্যন্ত ব্যয়-বহুল প্রকল্প। প্রতি আয়রন ডোম ব্যাটারির জন্য দেশটিকে খরচ করতে হয় প্রায় ৫০ মিলিয়ন ইউএস ডলার যা বাংলাদেশী টাকার হিসাবে প্রায় চারশ কোটি টাকার মত এবং প্রতিটি মিসাইলের জন্য খরচ হয় ৯০ হাজার ইউএস ডলার যা বাংলাদেশী টাকার হিসাবে প্রায় ৭২ লক্ষ টাকা।
তার অর্থ একটি আয়রন ডোম ব্যাটারির মোতায়েনের পিছে ইসরায়েল সরকারের মোট খরচ দাড়ায় ৫ কোটি ইউএস ডলাররের উপরে যা বাংলাদেশী টাকার হিসাবে দাড়ায় প্রায় ৪৩৫ কোটি টাকা মাত্র।
আয়রন ডোমের গঠন ও বৈশিষ্ঠ
৩ মিটার (৯.৮ ফুট) দৈর্ঘ্য ও ১৬০ মিমি ডায়ামিটারের প্রতিটি আয়রন ডোম এর ওজন ২০০ পাউন্ড বা ৯০ কেজি। ডেটোনেশন মেকানিজম হিসাবে এখানে ব্যবহার করা হয়েছে Proximity Fuze. আর আয়রন ডোম নিক্ষেপণ প্ল্যাটফর্মে রয়েছে তিনটা মিসাইল লাঞ্চার যার যার প্রত্যেকটা ২০টা করে মোট ৬০টি তামির ইন্টারসেপ্টার বহন করে।
আক্রমন সনাক্ত করা থেকে শুরু করে সেটা নিষ্ক্রিয় করা পর্যন্ত আয়রন ডোম এর প্রতিটি ব্যাটারি তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে কাজ করে, যথাঃ
- রাডার ডিটেকশন ইউনিট: ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা সংস্থা এবং ইসরায়েল এরোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজেরে সহযোগী সংস্থা এল্টা (Elta) এবং ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স (IDF) কর্তৃক নির্মিতি রাডার সিস্টেম ব্যবহৃত হয়েছে আয়রন ডোম এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমে।
- ব্যাটল ম্যানেজমেন্ট ও কন্ট্রোল ইউনিট (BMC): ব্যাটল ম্যানেজমেন্ট ও কন্ট্রোল ইউনিটটি ডেভলপ করেছে ইস্রায়েলেরই মালিকানাধীন একটি সফ্টওয়্যার কম্পানি যার নাম এমপ্রেস্ট সিস্টেম।
- মিসাইল ফায়ারিং ইউনিট: তামির ইন্টারসেপ্টর ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের জন্য এই অংশটিতে রয়েছে বৈদ্যুতিক-অপটিক সেন্সর এবং উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন স্টিয়ারিং ফিনস।
রাডার সিস্টেম প্রথমে আঘাত হানতে আসা রকেটে, মিসাইল অথাবা শেলের গতিপথ ট্র্যাক করে প্রাপ্ত সমস্ত ডাটা ব্যাটল ম্যানেজমেন্ট কন্ট্রোল সিস্টেমে পাঠায়। সিস্টেমের মাধ্যমে রকেট গুলোর গতিপথ বিশ্লেষন করে সম্ভাব্য আঘাত করার পয়েন্ট গুলোতে কোন স্থাপনা আছে কিনা তা দেখা হয়।
রকেটের গতিপথে যদি কোন স্থাপনা না থাকে তবে সেগুলোকে ইন্টারসেপ্ট না করে ছেড়ে দেওয়া হয়। আর যদি কোন স্থাপনা থাকে তবে রকেট গুলোকে ইন্টারসেপ্ট বা ধ্বংস করার জন্য আকাশে একটি পয়েন্ট নির্ধারণ করে সুবিধাজনক স্থানে থাকা আয়রন ডোমকে ফায়ারিংয়ের জন্য নির্দেশ পাঠিয়ে দেয়।
আয়রন ডোম প্রযুক্তি প্রতি মুহুর্তেই রকেট গুলো ট্র্যাকিং করা সহ মিসাইল খরচেরও হিসাব রাখে। হামলা যদি খুব বেশি হয় এবং আয়রন ডোমের মিসাইল রিফিল করার যন্য পর্যাপ্ত সময় না পাওয়া যায় তবে আয়রন ডোম সিস্টেম গুরুত্ব বিবেচনায় ইন্টারসেপ্ট প্রায়োরিটি চেন্জ করতে পারে। যাতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রক্ষা করা সম্ভব হয়।
এই পুরো প্রক্রিয়াটি ঘটে মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে। তবে এই স্বল্প সময়ের মধ্যেও আয়রন ডোম সিস্টেম শত্রু পক্ষের রকেট লাঞ্চার ডিটেক্ট করে ডাটা ইসরায়েলের মিলিটারি সেন্ট্রাল সিস্টেমে পাঠিয়ে দেয়, যা এয়ার স্ট্রাইকের জন্য কাজে লাগে।
সাধারন ব্যাটরির সাথে আয়রন ডোমের পার্থক্য
একটি সাধারন এয়ার ডিফেন্স মিসাইল ব্যাটরিতে রাডার ইউনিট, মিসাইল কন্ট্রোর ইউনিট এবং আলাদা আলাদা লঞ্চার একই সাথে সংযুক্ত থাকে।
পক্ষান্তরে আয়রন ডোম তৈরি করা হয়েছে আলাদা আলাদা ইউনিটের সমন্বয়ে। প্রতিটি লঞ্চারের ২০টি ইন্টারসেপ্টরকে দুর থেকে নিরাপদ ওয়ারলেস কানেকশনের মাধ্যমে অপারেট করা হয়। এবং একটি আয়রন ডোম ব্যাটারি ১৫০ বর্গ কিলোমিটার আরবান এলাকা প্রতিরক্ষা করতে পারে।
কতটুকু কার্যকারী এই আয়রন ডোম?
আয়রন ডোম একটিভ রাডার সিস্টেম আর তামির ইন্টারসেপ্টর। খুব সহজেই ধরে ফেলে শত্রুর পক্ষের ছোড়া রকেট এবং নিমেষেই গুড়িয়ে দেয় সেগুলো। এটাই এখন সবথেকে বড় রক্ষাকবচ যা হামাসের ছোড়া রকেট থেকে প্রতিনিয়ত রক্ষা করছে ইসরায়েলকে। ২৭শে মার্চ ২০১১ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে আয়রন ডোম ব্যবহার শুরু হয়।
সময়টা ২০১২ সালের মার্চ মাস, ফিলিস্তিনের গাজা ভুখন্ড থেকে ৩০০ এর বেশি রকেট ছোড়া হয় ইসরাইলের ভুখন্ড লক্ষ করে। যার মধ্যে ১৭৭ টি রকেট ইসরাইলে ভুখন্ডে আঘাত হানতে সক্ষম হয় এবং বাকি ৫৬টি রকেট আয়রন ডোম ৭১টি এটেমপ্টে জনবহুল এলাকায় আঘাত হানার আগে আকাশেই প্রতিরোধ করে।
এর পরে নভেম্বর, ২০১২, অপারেশন পিলার অফ ডিফেন্স এ আয়রন ডোম মোট ৪২১ টি রকেট ইন্টারশেপসন করেছে। তেল আবিবে বেশ কয়েক দফা রকেট হামলা হওয়ার পরে এখানে পঞ্চম ব্যাটারিটি দ্রুত মোতায়েন করা হয়।
অপারেশন পিলার অফ ডিফেন্সে ইসরাইল চমৎকার সাপোর্ট পায় আয়রন ডোম থেকে। এই সময়ে আয়রন ডোমের সাকসেস রেট ছিলো ৮৫%।
আয়রন ডোম ব্যবহারকারী দেশ
২০০৬ সালে যখন লেবাননের সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধ চলছে ঠিক সেই সময়টায় ইসরায়েল এই আয়রন ডোম তৈরির কথা ঘোষণা করে। ঠিক তার ৬ বছর পর ২০১১ সালে প্রথম গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধে আয়রন ডোম প্রযুক্তিটি ব্যবহার করা শুরু করে ইসরাইল।
বর্তমানে আয়রন ডোম ব্যবহারকারী দেশের মধ্যে রয়েছে ইসরায়েল ও সিঙ্গাপুর। তবে বিশ্বের অনেক দেশই এখন এই প্রযুক্তি পেতে আগ্রহ প্রকাশ করে ইসরায়েলের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করছে। বিশ্বের কোন সিস্টেমই শতভাগ নিঁখুত নয়, কিছু ভুল ত্রুটি থাকবেই যা সময়ের সাথে সাথে আপগ্রেডেশনের মাধ্যমে সংশোধন হয়। তাই মাঝে মধ্যে কিছু রকেট ইসরায়েলের মাটিতে লক্ষবস্তুতে গিয়ে আঘাত করে।
তবে বিশ্বে এখন পর্যন্ত ইসরায়েলের তৈরি আয়রন ডোম সেরা একটি এন্টি এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম। যা বর্তমানে ইসরায়েলের রক্ষা কবচ হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। বিজ্ঞজনদের মতে বর্তমানে যে কোন ড্রোন সিস্টেমের বিরুদ্ধেও সমানভাবে অত্যন্ত কার্যকর ইসরয়েলের তৈরি আয়রন ডোম একটিভ রাডার সিস্টেম প্রযুক্তি।
আরো পড়ুনঃ |
---|
ডিপফেক ভিডিও! কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার তৈরি অভিশপ্ত প্রযুক্তি প্রাণের উৎস সন্ধানে বিজ্ঞানের যত গবেষণা! |