প্রাণের উৎস একটি অমিমাংসিত রহস্য। এ রহস্যের সমাধান এখনও সম্ভব হয়নি, তবে বিজ্ঞানের গবেষণা কখনও থেমে নেই। সময়ের সাথে সাথে গবেষণায় যোগ হচ্ছে যেমন নতুন নতুন মাত্রা আর ঠিক তেমনই সেই সাথে দেখা দিচ্ছে আরো নতুন জটিলতা। যার সমাধানে হিমশিম খেতে হচ্ছে বৈজ্ঞানিকদের।
আমরা যদি সৃষ্টির পর্যায়ক্রম করি তাহলে প্রথমে বিগ ব্যাং, তারপর পরমানু-অনুর সৃষ্টি এর পরে গালাক্সি-নক্ষত্র-গ্রহ-উপগ্রহের সৃষ্টি। আর এখন পর্যন্ত জানামতে পৃথিবীই একমাত্র গ্রহ যেখানে প্রানের উদ্ভব এবং বিকাশ ঘটেছে। প্রানের উদ্ভব এবং বিকাশ সম্পর্কিত সবকিছুই এক একটি রহস্য, যেগুলোকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে বর্তমানকালের জীববিজ্ঞান এবং অন্যান্য সহযোগী বিজ্ঞানসমূহ।
প্রাণের উৎস সম্পর্কিত যত থিওরী
প্রাণের উৎস সন্ধান করতে এ পর্যন্ত যেসব থিওরী সামানে এসেছে, সেগুলোকে মোটামুটি চার ভাগে ভাগ করা যায়। যা নিম্নরুপঃ
- Special creation- প্রাণের উৎপত্তির ধর্মীয় এবং মিথোলজিক্যাল থিওরী।
- Extraterrestrial life- পৃথিবীর বাইরে থেকে আসা উল্কাপিন্ড হতে অথবা কসমিক ডাস্ট থেকে ভেসে আসা মাক্রোমলিকিউল থেকে প্রানের উৎপত্তি ।
- Spontaneous Generation- পচনের ফলে উদ্ভূত পদার্থ থেকে প্রানের উৎপত্তি।
- Abiogenesis/ Biogenesis- অজৈব পদার্থ থেকে জটিল রাসায়নিক পদার্থ তৈরি, তারপর প্রানের উৎপত্তি এবং বিবর্তন।
Francisco Redi ১৬৬৮ সালে, Lazzaro Spallanzani ১৭৬৭ সালে এবং লুই পাস্তুর (Louis Pasteur) ১৮৬৪ সালে তর্কাতীতভাবে বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে প্রমান করে দেখিয়েছেন যে পচনশীল জিনিষ থেকে আসলে প্রানের জন্ম হয়না। এ গবেষনার আগে পর্যন্ত ধারনা করা হতো পচা মাংস থেকে জন্মায় ম্যাগট (Maggot) আর ধুলোবালি থেকে জন্মায় ফ্লী (Flea)।
এরিস্টটলের (Aristotle) ধারনা ছিল, জীবিত বস্তুসমূহ তৈরি হয়েছে অজৈব পদার্থ থেকে (Abiogenesis), কিন্তু লুই পাস্তুর (Louis Pasteur) ১৮৬৪ সালে গবেষণাগারে প্রমান করে দেখালেন যে, জীবন্ত পদার্থ থেকেই জীবন্ত পদার্থ তৈরি হয় (Biogenesis)। তবে লুই পাস্তুরের গবেষণার ফলে সমস্যা যে কমলো তা নয়, বরং সমস্যা আরো বাড়লো। কারন, ‘জীবনের উৎস কি’ এ প্রশ্নটি এখনও অমীমাংসিতই রয়ে গেছে।
প্রাণের সংজ্ঞাঃ
নানারূপ ধর্মীয়, মিথোলজিক্যাল ব্যাখ্যা রয়েছে প্রাণের উৎস সম্বন্ধে। সংগত কারনেই সেগুলোকে এড়িয়ে গিয়ে শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নিয়ে এখানে আলোচনা করা হবে।
নাসার (NASA) প্রাণের উৎস সম্পর্কে সংজ্ঞা অনুয়ায়ী, ‘জীবন হচ্ছে স্বনির্ভরশীল একটা রাসায়নিক পদ্ধতি যা বিবর্তিত হতে সক্ষম’ (A self-sustaining chemical system capable of Darwinian evolution)। অর্থাৎ প্রাণের মূল বৈশিষ্ট হচ্ছে বিপাক (Metabolism), স্ব-মেরামত ( Self-repair) আর বিভাজন (Replication)।
প্রাণের উৎস সম্পর্কিত গবেষণা
পৃথিবীতে জীবনের শুরু প্রায় ৩.৮ থেকে ৪.৮ বিলিয়ন বছর (Archean Eon) আগে। কিন্তু এর রহস্য ভাঙ্গার চেষ্টা চলছে মাত্র ১০০ বছরেরও কম সময় ধরে। ১৯৫২ সালে মিলার-ইউরি গবেষণা (Miller-Urey experiment) তাপ, চাপ, বিদ্যুৎ প্রবাহের মাধ্যমে কিছু অজৈব পদার্থ থেকে আমাইনো এসিড উৎপাদন করতে সক্ষম হয়। তখন থেকেই এবায়োজেনেসিস আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
মিলার-উরে গবেষণার সংরক্ষিত নির্যাস নিয়ে ২০০৭ সালে পরীক্ষা করা হয়। পরিক্ষায় দেখা যায়, এর ভিতরে প্রকৃতিতে অবস্থানরত ২০ টি এমাইনো এসিড ই রয়েছে। আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যূৎপাতের মত অবস্থা যোগ করলে আরও বেশী ধরনের প্রোটিনয়েড এর থেকে পাওয়া যায়।
এবায়োজেনেসিস অর্থাৎ অজৈব পদার্থ থেকে প্রাণের উৎপত্তি হয়েছে, এই তত্ত্বটাকে বেশ কয়েকটা পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। আমরা একটা পর্যায় সারনীর মাধ্যমে এটাকে প্রকাশ করতে পারি।
Simple Chemical→Polymer→Replicating Polymer→Hypercycle→Protobiont→Protocell→Prokaryotes- Eukaryotes
প্রটোবায়োন্ট যা জীবিত না হলেও এর মধ্যে প্রাণের অন্তত দুটো গুনাগুণ পাওয়া যায়, এই দুই ধরন মাক্রোমলিকিউলের পুঞ্জিভুত (Aggregate) রূপ দিয়ে গঠিত। Oparin-Haldane theory অনুযায়ী এরা Coacervates এবং Microspheres এই দুই ধরনের হয়ে থাকে যা গবেষণাগারে প্রস্তুত করা সম্ভব হয়েছে।
Coacerbates হচ্ছে লিপিডের তৈরি এবং একপর্দার মেম্ব্রেন দ্বারা আবদ্ধ। আর Microspheres হচ্ছে প্রোটিনের তৈরি এবং দুই পর্দার লিপিড মেম্ব্রেন দ্বারা আবদ্ধ। সোভিয়েত জীববিজ্ঞানী Alexander Oparin আবিষ্কার করেন কসারভেটস (coacervates) আর Sydney Fox আবিষ্কার করেন মাইক্রোস্পিয়ার (Microspheres).
এদের বৈশিষ্ট হলো এরা উপযুক্ত পরিবেশ পেলে আশপাশ থেকে আর ও মাক্রোমলিকিউল নিয়ে বড় হতে পারে, এদের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়া চলতে পারে। প্রটোবায়োমের সাথে জেনেটিক মেটেরিয়াল যোগ করলে প্রটোসেল (Protocell) তৈরি হয়।
ভাইরাস হচ্ছে এধরনের একজাতীয় প্রটোসেল। এবায়োজেনেসিস হলো কোষ গঠনের রাসায়নিক পর্যায় (Chemical Evolution) আর বায়োজেনেসিস হলো তার পরবর্তী বিবর্তন (Biologic Evolution)। এরপর এককোষী প্রাণী থেকে ক্রমান্নয়ে বহুকোষী প্রাণী আর উদ্ভিদের বিবর্তন/ বিকাশ হয়েছে।
প্রাণের উৎস সম্পর্কে দ্বিধাবিভক্তিঃ
প্রাণের উৎপত্তি সম্বন্ধে বৈজ্ঞানিকদের ভিতরে স্পষ্ট বিভাজন লক্ষ্য করার মত। একদল সৃষ্টিতত্বে বিশ্বাসী, অন্যদল বিবর্তনে বিশ্বাসী। কারা কোন দলে তা গুগল করলেই খুজে পেতে সময় লাগবে না, তাই নাম উল্লেখ না করে আমরা মুল আলোচনাতে যেতে চাই।
বিজ্ঞানীরা আরেকটা ব্যাপারেও দ্বিধাবিভক্ত, সেটা হচ্ছে প্রথম প্রাণের উৎপত্তি পানিতে না শিলাখন্ডে! বেশীরভাগ বিজ্ঞানী মনে করেন প্রাণের উৎপত্তি হয়েছে পানিতে, তবে ইদানীংকালে বিভিন্ন ফসিল রেকর্ড বিবেচনা করার পর শিলাখন্ডে প্রাণের উৎপত্তি হয়েছে এ ধারনাটা জোরালো হয়ে উঠছে।
২০১৬ সালে প্রাণের আদি উৎস (LUCA- Last Universal Common Ancestor) বলে যে ফর্মটাকে ধরে নেওয়া হয়, তার ৩৫৫ টা জীনকে সিকোয়েন্সিং করা সম্ভব হয়। ধারনা করা হয়, প্রাথমিক একটা জলীয় দ্রবনের ভিতর (Primordial Soup) ক্রমাগত রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে (Autocatalytic reaction) অক্সিজেন ব্যাতিরেকেই অ্যানেরোবিক রিএকশনের (Anaerobic reaction) মাধ্যেমে প্রাণের উৎপত্তি হয়েছে।
প্রথমে আর এন এ (RNA- Ribonucleic acid) তৈরি হয়েছে, তারপর ডিএন এ (DNA- Deoxyribonucleic Acid) এবং প্রোটিন তৈরি হয়েছে। তবে প্রাণের ব্যাপ্তি আরও জটিল। একটা পুর্নাংগ কোষ (Cell) তৈরি করার জন্য আরও অনেক গবেষণার প্রয়োজন হবে।
প্রাণের উৎস সম্পর্কিত সম্ভাব্য ব্যাখ্যাঃ
পৃথিবীর ভৌতিক গঠন, তাপ, চাপ, বিকিরণ, আলো, বাতাস, পানি-কাদা-মাটি-শিলাখন্ড, উল্কাপিন্ড ইত্যাদি কোন না কোন ভাবে প্রাণ সৃষ্টিতে কাজ করেছে। এখন পর্যন্ত যতটুকু জানা আর বোঝা সম্ভব হয়েছে তা হচ্ছে, প্রাণের উৎস রহস্যের সম্পুর্ন সমাধান এখনও সম্ভব না হলেও এ বিষয়ে বিজ্ঞানের গবেষণা অনেকখানিই এগিয়ে গেছে।
উষ্ণ প্রসবনের (Geiser) তলদেশে অটোক্যাটালায়টিক রিয়্যাকশন এর মাধ্যমে বড় ধরনের অনু তৈরি হল, এবং তা একসময় উপরে উঠে এর থেকে তৈরি হলো রাইবোজোম (Ribosome)। রাইবোজোমের চারিদিকে ফ্যাটি লেয়ার জমে একজাতীয় প্রোটো- কোষ (Proto-cell) তৈরি হলো এবং এখান থেকে অপেক্ষাকৃত স্থায়ী ডিএনএ (DNA) এবং পরবর্তীতে প্রোটিন তৈরি হলো।
কিছু কিছু কোষে ক্রোরোফিল তৈরি হলো, তারা ফটোসিন্থেসিস (Photosynthesis) মাধ্যমে অক্সিজেন তৈরি করতে লাগলো এবং পর্যায়ক্রমে তৈরি হলো বায়ুমন্ডল ও ওজোন স্তর। কোষের ভিতর ডিএন এ, মাইটোকন্ড্রিয়া ইত্যাদি জমা হবার ফলে প্রথমে প্রোকারিয়োট (Prokaryote- without nuclear membrane, Bacteria) এবং পরে ইউকারিয়োট (Eukaryote- Animal and plant cell with a nuclear membrane) কোষের জন্ম হলো।
এই কোষ থেকে পরবর্তীতে জন্ম হলো বিভিন্ন প্রানী আর উদ্ভিদের (এর পরে পর্যায়ক্রমে আরো কিছু ধাপ রয়েছে যা পরে অন্য প্রবন্ধে আলোচনা করা হবে)। সময়ের পরিক্রমায় বার বার জীবন তৈরি হয়েছে আবার ধ্বংশ হয়েছে (Mass extinction) এবং এই জন্ম আর ধ্বংশের মধ্যে টিকে গেছে কিছু প্রাণ, যার থেকে আবার বহুমাত্রায় বিকশিত হয়েছে নতুন প্রান। বিবর্তন এর ব্যাপারে মূল ধারার বিবর্তন (Stem evolution) এবং তার শাখা-প্রশাখার বিবর্তন (Crown evolution) পরিলক্ষিত হয়।
উপসংহারঃ
মানুষ এখন গ্রহান্তরে আবাস নির্মাণের জন্য প্রস্তুত। মঙ্গল বা অন্যান্য গ্রহে প্রাণ তৈরি করে সেখানে মানুষের বসবাসের উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলার চেষ্টা চলমান। আর এই চলমান প্রচেষ্টার জন্যই জানা প্রয়োজন পৃথিবীতে কিভাবে প্রানের উৎপত্তি আর এর বিকাশ সম্ভব হয়েছে। আর সেই লক্ষে নিরন্তর প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
প্রায় ৫ বিলিয়ন বছর আগে সৃষ্ট প্রাণ তৈরির উপযুক্ত পরিবেশ ল্যাবরেটরীতে সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। গবেষণার প্রয়োজনে যা করা হয়েছে বা হচ্ছে সেগুলো সেই সময়ের পরিবেশ পরিস্থিতির কাছাকাছি।
বৈজ্ঞানিকদের অক্লান্ত পরিশ্রম ভবিষ্যতে এ রহস্যের কুল কিনারা করতে পারবে কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়। তবে এখন পর্যন্ত যতটুকু অগ্রগতি হয়েছে সে ব্যাপারে এই নিবন্ধটিতে নিরপেক্ষভাবে সবকিছু আলোচনা করার চেষ্ট করা হয়েছে।