‘সিনথেটিক বায়োলজি (Synthetic Biology)’ শিরনামটাকে বেশি বর্ধিত করার প্রয়োজনীয়তা আশা করি নেই, কারন এমনিতেই এই বিষয়টির কলেবর বৃদ্ধি পাচ্ছে, প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত। সিনথেটিক বায়োলজি মুলত বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেরই একটি আধুনিক শাখা যেখানে বায়োলজি আর ইঞ্জিনিয়ারিংকে সমন্বিত করা হয়েছে।
সিনথেটিক বায়োলজির প্রেক্ষাপট
ফেব্রুয়ারী ২৩, ১৯৫৩ সালে, রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন (Rosalind Franklin), ফ্রান্সিস ক্রিক (Francis Crick), এবং জেমস ওয়াটসন (James Watson) ডিএনএ-র রাসায়নিক সংকেত আবিষ্কার করেন। তারপরে চেষ্টা চলেছে, বিভিন্ন প্রানী, উদ্ভিদ আর জীবাণুর জেনেটিক কোড আবিষ্কার করার এবং এ নিয়ে সামনের দিনের গবেষণাকে এগিয়ে নেবার।
এর মধ্যে সবচেয়ে জটিল হচ্ছে মানুষের জিনোম (Genome), এখানে ৩ বিলিয়ন বেস পেয়ার রয়েছে, বিশ হাজার থেকে পঁচিশ হাজার জীন (Gene) রয়েছে। একেকটা জীন আবার প্রায় তিন হাজার বেস পেয়ার দিয়ে গঠিত। মানুষের জীনের প্রায় ৯৯.৯০% একই রকমের, মাত্র ০.১% আলাদা, এই সামান্য পার্থক্যের কারনেই মানব জাতির মধ্যে বিভিন্ন বৈসাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়।
শিম্পাঞ্জীর সাথে আমাদের জীনের প্রায় ৯৮% মিল রয়েছে, ইঁদুরের সাথে মিল রয়েছে ৭৭%, এবং ভাইরাস থেকে শুরু করে মানুষ পর্যন্ত যত জীবন্ত বস্তু আছে সবার একই জেনেটিক কোড, পার্থক্য শুধু এর সংখ্যা আর ব্যাপ্তিতে।
ডিএনএ -র মুল একক হচ্ছে ডিওক্সিরাইবোনিউক্লিয়িক এসিড (DNA- deoxyribonucleic acid), এটা আবার চার ধরনের যেকোন একটি নাইট্রোজেনিয়াস বেস (Nitrogenous base, Adenine, Thyamine, Guanine, Cytosine) দ্বারা গঠিত, এগুলো আটকিয়ে থাকে ডিওক্স্যিরাইবোস (Deoxyribose) সুগার আর ফসফেট (Phosphate) বন্ধনী দিয়ে।
আডেনাইন (A-Adenine) সব সময় থায়ামিনের (T- Thiamine) সঙ্গে এবং গুয়ানাইন (G-Guanine) সবসময় সাইটোসিনের (C- Cytosine) সঙ্গে বন্ধন তৈরি করে। এই ডিএনএ থেকে ডুপ্লিকেশন (Duplication) এর মাধ্যমে কোষ বিভাজন হয়।
ডিম্বানু/ শুক্রানু তৈরি হয়, যেখানে অর্ধেক অর্ধেক ক্রোমোসম/ ক্রোমাটিন যায়, আর ট্রান্সকৃপ্সশনের (Transcription) মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের আরএনএ (RNA- ribonucleic acid) তৈরি হয়। যা থেকে ট্রান্সশ্লেষন (Translation) এর মাধ্যমে বিভিন্ন প্রোটিন তৈরি হয়।
ডিএনএ -র তিনটি তিনটি করে বেস একটা করে এমাইনো এসিডের কোডন (Codon) তৈরি করে যেখান থেকে আরএনএ -র এন্টিকোডন (Anti-codon) এটাকে ডিকোড করে পুর্বনির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ি এমাইনো এসিড (Amino Acid) সাজিয়ে পলিপেপ্টাইড (Polypeptide) চেইন তৈরী করে।
যার থেকে কোষের অভ্যন্তরে থাকা এন্ডোপ্লাস্মিক রেটিকুলাম (ER- Endoplasmic Reticulum) আর গলজি কমপ্লেক্সের (Golgi complex) মাধ্যমে প্রোটিন তৈরি হয়। আরএনএ (RNA) -র গঠন প্রায় ডিএনএ -র (DNA) অনুরূপ, এখানে সুগারটি হচ্ছে ডিওক্সিরাইবোসের (Deoxyribose) পরিবর্তে রাইবোজ (Ribose), আর সাইটোসিনের (Cytosine) এর বদলে এখানে রয়েছে উরাসিল (U- Uracil )।
বিভিন্ন ধরনের জীবকুলের জেনেটিক কোড আবিষ্কারের ফলে এখন গবেষনার নতুন নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হচ্ছে। এতদিন পর্যন্ত প্রাকৃতিক বিবর্তনের (Natural Evolution) কথা মানুষ জেনে এসেছে, এখন কৃত্রিম বিবর্তনের (Artificial Evolution) কথা মানুষ জানবে। এর বেশীরভাগ দিকই উপকার বয়ে নিয়ে আসবে, আবার খারাপ লোকের হাতে পড়ে ক্ষতিকর কিছু হওয়ার সম্ভবনাকেও উড়িয়ে দেওয়া যায়না।
সিনথেটিক বায়োলজি কি?
এক কথায় সিনথেটিক বায়োলজি -র সংজ্ঞা দেওয়া মুশকিল, তবে এটুকু বলা যায়, বায়োলজি আর ইঞ্জিনিয়ারিং এর সর্বাধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করে নতুন ধরনের কোষ তৈরি বা কর্মক্ষমতা তৈরি করার কাজটি করছে সিনথেটিক বায়োলজি। সিনথেটিক বায়োলজি বিষয়টির মধ্যে বায়োলজির বিভিন্ন বিষয়গুলো ছাড়াও আরও যে বিষয়গুলো একিভুত করা হয়েছে তা হচ্ছেঃ
- Biotechnology
- Molecular Biology
- Genetic Engineering
- Molecular Engineering
- Systems Biology
- Biophysics
- Electrical Engineering
- Computer Engineering
- Control Engineering and
- Evolutionary Biology
বলা যায়, সাধারণ বায়োলজিকে একটা নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে সিনথেটিক বায়োলজি। এখন এক প্রানী থেকে অন্য প্রানীতে পরিনত করা। তৈরি করা যায় প্রায় নতুন জীবন। ক্লোনিং পদ্ধতিতে এক প্রানীর বিভিন্ন অনুলিপি তৈরি করা, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে অনুজীব থেকে ইনসুলিন বা অন্যান্য প্রোটিন তৈরি করা ইত্যাদি। পুরুষের শরীর থেকে শুক্রাণু এবং ডিম্বাণু তৈরি করে বাচ্চা উৎপাদন করা, জরায়ু ছাড়াই বাচ্চা উৎপাদন এখন বাস্তবতা, কোন কল্পকাহিনী নয়।
সিনথেটিক বায়োলজির বর্তমান ও ভবিষ্যত
চিকিৎসাবিজ্ঞান, কৃষিবিজ্ঞান, শিল্প –কারখানা ও পরিবেশ রক্ষায় এখন সিনথেটিক বায়োলজি ব্যবহার বেড়েছে। মূলত অনুজীব (Virus, Bacteria, Yeast) বা ক্ষেত্রবিশেষে মানুষের কোষ অথবা উদ্ভিদ কোষ এখানে মূল গবেষণার বস্তু হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে যেমন এদের স্বাভাবিক কাযকর্ম পরিবর্তন করে নতুন নতুন বস্তু তৈরি করা যাচ্ছে, তেমনি আবার মানুষ, অন্য প্রানীর বা উদ্ভিদের কার্যক্রম পরিবর্তনের জন্য এদেরকে ব্যবহার করা হচ্ছে।
ল্যাবরেটরিতে সম্পুর্ন কৃত্রিম ভাইরাস তৈরি করা সম্ভব যা দিয়ে রোগ সারানও সম্ভব, আবার জীবাণু যুদ্ধ করাও সম্ভব। বিশ্বের রাজনৈতিক ক্ষমতা কিভাবে এই ক্ষমতাকে কাজে লাগাবে, এটা এখন দেখার বিষয়।
সাইবারজেনেটিক্স ও সিনথেটিক বায়োলজি
কম্পিউটারের সাথে জীবন্ত বস্তুর আদান প্রদান করা সম্ভব, আলো অথবা কোন রাসায়নিক পদার্থ এখানে সিগন্যাল (Signal) হিসাবে কাজ করতে পারে। এটা এখন সাইবারজেনেটিক্স (Cybergenetics) এর প্রধান বিষয়বস্তু।
এখানে রক্তের গ্লুকোজ স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্নয় করে প্রয়োজন অনুযায়ী ইনসুলিন দেওয়ার জন্য ছোট্ট একটি যন্ত্রের প্রয়োজন হবে মাত্র। এরকম আরও অসংখ্য বিষয়ে গবেষণা চলছে সিনথেটিক বায়োলজি বিভাগে, যার ফলে প্রতিনিয়ত রুটিনমাফিক ঔষধ গ্রহন করা থেকে মানুষকে দেবে স্বাধীনতা।
বহুরোগের চিকিৎসায় সিনথেটিক বায়োলজি
মানুষের একটা ক্রোমোসমকে ভাইরাস অসংবেদী করার জন্য প্রায় ৪,০০,০০০ বেস পেয়ার পরিবর্তন করার প্রয়োজন হয়, যা বিশাল ব্যয়সাধ্য ব্যাপার। John Craig Venter এর অবদানে মানুষের জেনোম সিকোয়েন্সিং এখন অনেক সহজলভ্য হয়ে গেছে, সুতরাং ভাইরাস রোগ ছাড়াও অন্যান্য বহুরোগের চিকিৎসায় সিনথেটিক বায়োলজি অচিরেই ব্যবহৃত হবে এতে কোন সন্দেহ নেই।

বিবর্তনে সিনথেটিক বায়োলজি
ব্যাকটেরিয়ার অভ্যন্তরস্থিত প্লাজমিড (Plasmid DNA) এর মাধ্যমে নতুন নতুন জেনেটিক তথ্য জীবাণুর শরীরে প্রবেশ করানো যায়, জীবাণু পরিবর্তিত হয়ে যায় আর মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় পদার্থ তৈরি করতে থাকে। সিনথেটিক বায়োলজি -র কল্যানে এখন বিবর্তন মানুষের হাতে! প্রকৃতির উপরে মানুষের এই খবরদারি ভাল হবে, না খারাপ হবে, সেটা সময়ই নির্ধারণ করবে।
জীবানুর ভিতর ক্লোরোফিল সংযোজন করে খাদ্য উৎপাদনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। লিথোট্রপিক (Lithotropic) ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে পাথর থেকে অক্সিজেন উৎপাদনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। মূলত মঙ্গল গ্রহকে মানুষের বসবাসের উপযোগী করে তোলার জন্যই এত প্রচেষ্টা।
তথ্য সংরক্ষণে সিনথেটিক বায়োলজি
জীবানুর ক্রোমোসম হতে পারে তথ্য সংরক্ষণের বিশাল আধার। ATGC কোডের মাধ্যমে অল্প জায়গায় বিশাল পরিমান তথ্য সংরক্ষণ করা যেতে পারে, আবার এসব তথ্যকে কম্পিউটারের বাইনারী কোডে (Binary Code 010101) পরিবর্তন করে ডিজিটাইজ (Digitize) করে টেলিট্রান্সপোর্টেশন (Teletransportation) করা সম্ভব।
থ্রি-ডি প্রিন্টারের (3-D Printer) এর মাধ্যমে এসব কোডকে ডিসাইফার করে আবার নতুন প্রানী বানানোর চেষ্টা চলছে। মঙ্গলে মানুষ না পাঠিয়েও ওখানে জীব জগত গড়ে তোলা সম্ভব।
দুষণ কমাতে সিনথেটিক বায়োলজি
পৃথিবীকে বসবাসের উপযোগী রাখার জন্য কার্বন নিঃসরণ কমাতে হবে। এখন চেষ্টা করা হচ্ছে সালোক সংশ্লেষন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জীবানুর দ্বারা খাদ্য উৎপাদনের মাধ্যমে বাতাসের কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা কমিয়ে নিয়ে আসার, আর তাছাড়াও প্রকৃতিবান্ধব জ্বালানী উৎপাদনের মাধ্যমে বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের নির্গমন কমিয়ে আনার।
হাইড্রোজেন এখানে কার্বনের জায়গা দখল করবে, এবং এখানে দহন (Combustion) প্রক্রিয়াই পানি উৎপাদিত হবে। বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক (Biodegradable plastic) উৎপাদনের ফলে পরিবেশ দূষণ অনেকটাই কমে যাবে। ন্যানোটেকনোলজি ব্যবহারের ফলে একটা ছোট রুমের ভিতর অনেক বড় শিল্প-কারখানা গড়ে তোলা যাবে। স্থান সংকুলানের সমস্যারও সমাধান হবে তাতে।
কৃত্তিম প্রান তৈরিতে সিনথেটিক বায়োলজি
Craig Venter এর সিন্থেটিক ব্যাকটেরিয়াল কোষ আবিষ্কার, ইষ্টের কৃত্রিম ক্রোমোসম আবিষ্কার, অথবা সম্পুর্ন নতুন ধরনের কমপক্ষে দুইটি ডিএনএ বেস আবিষ্কার কৃত্রিম প্রান উৎপাদনে বিজ্ঞানীদের আগ্রহী করে তুলেছে আরো বেশি।
এখন মানুষের কাজ হচ্ছে পুর্নাংগ একটা কার্যকরী জীবন্ত একটা কোষ তৈরি করা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial intelligence) এ ব্যাপারে অনেক সহায়তা করতে পারবে। এতে যে বিশাল পরিমান তথ্য (Data) ব্যবহার করা লাগবে, তার হিসাব নিকাশ রাখা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং যান্ত্রিক শিক্ষা (Machine Learning) ছাড়া সম্ভব হবে না।
কৃত্রিম প্রান ছাড়াও এখন গবেষণা চলছে কিভাবে বায়োলজী আর ইঞ্জিনিয়ারিং এর সংমিশ্রণে নতুন ধরনের মেশিন তৈরি করা যায়। ন্যানোপারটিকলের সেমিকন্ডাক্টরের (Semiconductor) উপর কৃত্রিম আর এন এ লাগিয়ে দিয়ে তার থেকে প্রোটিন উৎপাদন করা যায়। অনেক ধরনের গবেষণা চলছে, যার সম্বন্ধে আমাদের কোন ধারনাই নেই। আমরা ব্যস্ত আছি অন্য কাজ আর অকাজ নিয়ে।
উপসংহারঃ
জেনেটিক পদ্ধতির অনেক ধরনের টেকনিক রয়েছে, যেগুলো আলোচনা করতে গেলে লেখার কলেবর অনেক বৃদ্ধি পাবে। হয়ত অন্য পরিসরে সেগুলো নিয়ে আলোচনা করা যাবে। মিশিও কাকু (Michio Kaku) বলেছিলেন, যখন প্রথম টেলিফোন আসলো, তখন অনেকেই মন্তব্য করেছিলেন, এইবার ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া সব মাথায় উঠবে, কিন্তু তা হয়নি। সব টেকনোলজীরই একটা নিগেটিভ দিক থাকে। একটা সময় ভালটায় থেকে যায়, অপব্যবহার কমে যায়।
এখনকার মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, ইন্টারনেট ইত্যাদি সম্বন্ধেও বেশীরভাগ মানুষেরই একই ধরনের মতামত। সেরকম রয়েছে সিনথেটিক বায়োলজী নিয়েও। সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা রাজনীতিবিদদের। যদি রাজনীতি প্রগতির পরিপন্থী হয়, তবে রাজনীতিই পরিবর্তন করা দরকার, বিজ্ঞান নয়।