“একবিংশ শতাব্দীর চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং…” লেখার শিরোনামটা ইচ্ছা করেই অসম্পুর্ন রাখা হয়েছে যাতে কি, কেন, কিভাবে এই প্রশ্নের উত্তর নিজেরাই খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেন। ক্ষুদ্র পদক্ষেপ থেকেই দীর্ঘ যাত্রার শুরু হয়, তাই মাইলফলকগুলোকে অসংখ্য ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত করা যায় যা অতিক্রম করতে অগনিত বৈজ্ঞানিকের অপরিসীম শ্রম, মেধা এবং ত্যাগের প্রয়োজন হয়েছে।
বিশদভাবে বর্ননা করার এখানে অবকাশ নেই, তার পরেও যদি বলতে হয়, তবে রোগ নির্নয়ের ক্ষেত্রে মেডিকেল ইমেজিং এর মধ্যে রয়েছে, X-ray, CT scan, MRI scan, PET scan, Radioisotope scan, Ultrasound, Echocardiography এর বিভিন্ন প্রয়োগ। রয়েছে বিভন্ন প্রকারের এন্ডোস্কপি যেমন, Alimentary tract, Sinobronchial tract, Genito-urirary tract, Thoracoscope, laparoscope, Angioscope, Capsule endoscope, etc.।
প্যাথলোজী পরীক্ষার মধ্যে রয়েছে, Cytology, Histology, Immunohistochemistry, Genetic study, Flow cytometry, ল্যাবরেটরী পরীক্ষার মধ্যে আছে, Biochemical test, Hormone, Tumor marker, Hematology ইত্যাদি। এছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কার্যক্ষমতা নিরূপনের জন্য বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরিক্ষা। বলা হয়ে থাকে যে, যত ধরনের পরীক্ষা রয়েছে তা যদি কোন একজনের উপর প্রয়োগ করা হয় তবে তার মৃত্যু অবধারিত।
চিকিৎসার ক্ষেত্রেও নানাবিধ অগ্রগতি হয়েছে যেমন, এন্টিসেপ্সিস, এসেপ্সিস, এনেস্থেসিয়ার প্রভূত উন্নতি। বিভিন্ন রকমের কমক্ষত উৎপাদনকারী সার্জারী (Minimally invasive surgery) যেমনঃ ক্যান্সার সার্জারি, ট্রান্সপ্লান্ট সার্জারী, হার্ট, লাংস, ও ব্রেনের অপারেশন ইত্যাদি এখন অত্যন্ত অগ্রসর পর্যায়ে চলে গিয়েছে।
সাথে সাথে এগিয়েছে রেডিওথেরাপী, কেমোথেরাপী, ইমিউনোথেরাপী, ফিজিওথেরাপী সহ এবং অন্যান্য সাহায্যকারী চিকিৎসা পদ্ধতি। কোন কোন পদ্ধতিতে আবার রোগ নিরূপন এবং রোগের চিকিৎসা দুটোই করা যাচ্ছে। এগিয়েছে রোগ প্রতিরোধের জন্য বিভিন্নরকম জনস্ব্যাস্থ বিষয়ক ব্যবস্থা যেমনঃ ভাক্সিন, এন্টিবডি তৈরি এবং সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রন ও চিকিৎসার জন্য এন্টিভাইরাল ড্রাগ আবিষ্কার, ভেক্টর (মশা-মাছি, কীটপতঙ্গ) নিয়ন্ত্রন ইত্যাদি কার্যক্রম।
প্রতিদিনই নতুন কোন না কোন ঔষধ আবিষ্কারের প্রচেষ্টা চলছে। আবার চিকিৎসা বিজ্ঞান -এ বিভিন্ন পদ্ধতিকে একসাথে করে (Multidisciplinary approach, Hybrid procedure) চিকিৎসা পদ্ধতির সক্ষমতা আরও বাড়িয়ে ফেলা সম্ভব হয়েছে।
শুধু চিকিৎসকগণ নয়, স্বাস্থ্য শিক্ষা, ব্যবস্থাপনা, গবেষনা ও চিকিৎসার সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত আছেন প্রকৌশলী, ইনফরমেশন টেকনোলজী (IT) বিশেষজ্ঞ, জীববীদ, পদার্থবিদ, রসায়নবিদ, পরিসংখ্যানবিদ, মহামারীবিদ ইত্যাদি নানা পেশার বিশেষজ্ঞ আর কর্মীবাহিনি। তাই এককথায় বলা যায় মানব শরীরের এমন কোন অঙ্গ আর বাকী নেই যেখানকার অসুখ নিরূপন করা অসম্ভব।
যদিও ক্যান্সারকে এবং কিছু Autoimmune রোগকে এখনও পুরোপুরি পরাস্থ করা সম্ভব হয়নি। তবে এগুলো এখন শুধুমাত্র সময়ের প্রশ্ন, একবিংশ শতাব্দীতে যা সমধান হয়ে যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। নিচে এই শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ আর সম্ভাবনাগুলো নিয়ে এখন সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হয়েছ।
সম্পর্কিত আর্টিকেলঃ ঔষধ শিল্প; উদ্ভাবন থেকে মান নিয়ন্ত্রণ । রোগ নির্ণয়ে মেডিকেল ইমেজিং
চিকিৎসা বিজ্ঞান ও ডিজিটাইজেশন
আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান -এ চিকিৎসা সেবা আরও বেশী করে প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার বেশ কিছুদিন থেকে শুরু হলেও এর প্রভাব এবং সক্ষমতা ক্রমশই বাড়ছে। আগে যেখানে মনিটরিং, অ্যালার্ম, ফিডব্যাক, ভেন্টিলেটর এবং অন্যান্য কিছু যন্ত্রপাতিতে সীমিত মাত্রায় Artificial intelligence (AI) ব্যবহার করা হতো, এখন সেটা কৃত্রিম রোবট অথবা ড্রোন হিসাবে ব্যবহার করা হবে।
মারাত্মক সংক্রমনের চিকিৎসায়, অথবা উচ্চমাত্রার রেডিয়েশন বা কেমোথেরাপী দেওয়ার ক্ষেত্রে এরা নার্স হিসাবে ব্যবহৃত হবে। যন্ত্রপাতিতে অটোমেশন ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। রোগীরা শরীরে বিভিন্ন রকমের গ্যাজেট পরে থাকবে, যার ভিতরে থাকবে বিভিন্ন ধরনের সার্কিট, যেগুলো ডাটা সংগ্রহ করে টেলিমেট্রির মাধ্যমে কম্পিউটারে পৌছবে এবং সেখান থেকে প্রোগ্রামিং এর মাধ্যমে নির্দেশনা রোগীর শরীরে পৌছবে।
চিকিৎসক টেলিমেট্রির সংবেদনশীলতা, অ্যালার্ম, এবং প্রোগ্রামিং পরিবর্তন বা রিসেট করতে পারবেন। এটা পেসমেকারের ক্ষেত্রে অনেক আগে থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে, এখন অন্যান্য মেশিনেও কাজে লাগানো হবে।
কোন চিকিৎসক এখন কম্পিউটার, প্রোগ্রামিং, ক্যালিব্রেশন সম্বন্ধে অবগত না থাকলে তাকে এক ধরনের অশিক্ষিতই বলা হবে। ডাটা এন্ট্রি, সংরক্ষন, প্রোসেসিং ইত্যাদি সম্বন্ধে প্রশিক্ষন এখন থেকে স্নাতক পর্যায়েই শিখাতে হবে। রোগ নির্নয়ে, রোগ নিরাময়ে হাতের স্পর্শ ক্রমশ কমে যাবে।
বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের এ্যপস (Application) তৈরি করা হচ্ছে যাতে ড্রপচার্ট থাকবে। ড্রপচার্টের উপর লক্ষন অনুযায়ী ক্লিক করলেই কেস হিস্টরি তৈরি হয়ে যাবে। তাছাড়া শরীরে পরে থাকা গ্যাজেট (Gadget) থেকে প্রাপ্ত তথ্যের মাধ্যমে শরীরের পালস, ব্লাড প্রেশার, তাপমাত্রা, শ্বাস-প্রশ্বাস, অক্সিজেন এর মাত্রা, সুগার লেভেল, ইসিজি, ইকো, আল্ট্রাসনোসহ নানাবিধ তথ্য পাওয়া যাবে।
চিকিৎসক এসব তথ্যের ভিত্তিতে দূর থেকেও (Telemedicine) চিকিৎসা দিতে পারবেন। রোগের অগ্রগতি সম্বন্ধে জানতে পারবেন, এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনা মেসেজ হিসাবে দিয়ে রাখতে পারবেন। চিকিৎসকের ফি দেওয়ার জন্য আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপনার ব্যাংকের হিসাব থেকে তা ট্রান্সফার হয়ে যাবে চিকিৎসকের একাউন্টে।
এগুলো শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি নয়, অনেক দেশেই ইতোমধ্যে এগুলো চালু হয়ে গেছে। Artificial intelligence (AI), Information Technology (IT) যেমন চিকিৎসা বিজ্ঞান এর উপর প্রভাব বিস্তার করছে, সেরকমভাবে তথ্য সংগ্রহ করে রাখার জন্য ডিস্ক, ক্লাউড স্টোরের বিপরীতে জীবানুর ডিএনএ তে তথ্য জমা করে রাখা যায় কিনা তা নিয়েও গবেষনা চলছে।
জেনেটিক্স এবং মলিকিউলার বায়োলজী
আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান -এ জেনেটিক্স এবং মলিকিউলার বায়োলজী একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মলিকিউলের সামান্য পরিবর্তনে যেমন রোগের সৃষ্টি হতে পারে ঠিক তেমনিভাবে মলিকিউল বা অনুর সামান্য পরিবর্তন করে রোগ সারিয়েও তোলা যেতে পারে।
বংশগতির ধারা নির্ধারক ক্রোমোজোমের সংখ্যা (Numerical) বা গঠনে (Structural) পরিবর্তনে, অথবা এর অন্তর্গত জীনের পরিবর্তনে (Mutation), ঘাটতিতে (Deletion), পরিবর্ধনে (Amplification), অতি তৎপরতাই (Overexpression), বা নিষ্ক্রিয়তাই (Underexpression, inactivity) যেমন রোগ সৃষ্টি হতে পারে, তেমনিভাবে এগুলোকে বিপরীত প্রক্রিয়াই সারিয়ে তুলতে পারলে রোগের নিরাময় হবে।
মলিকিউলার বায়োলজী এবং বায়োটেকনলজীর যাবতীয় গবেষনা এখন জীনের ত্রুটি সংশোধন, জীন সংযোজন, বিয়োজন অথবা পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত। এখন এই চিকিৎসা প্রযুক্তির মাধ্যমে সন্তান আকাঙ্ক্ষী পিতা-মাতা থেকে ত্রুটিপুর্ন জীন খুঁজে বের করে সেই অনুযায়ী পরামর্শ দেওয়া (Genetic counseling) হচ্ছে।
ত্রুটিমুক্ত নিষিক্ত ভ্রূণ (Zygote) তৈরি করা হচ্ছে, মাতৃত্বকালীন সন্তানের ত্রুটি সংশোধন করা সহ বাচ্চার জন্মগত ত্রুটি সারানো হচ্ছে। বন্ধ হচেছ মেডিক্যাল গর্ভপাত। যদিও এর ভিতর সার্জারীর অবদান রয়েছে কিন্তু মুল ভুমিকা পালন করছে জেনেটিক এবং মলিকিউলার বায়োলজী।
বিভিন্ন রকম জীন থেরাপী যেমন Recombinant DNA technology, CRISPR-Cas9 ইত্যাদি এখানে কার্যকর ভুমিকা রাখতে পারে। জীন ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের এপিজেনেটিক (Epigenetic) এবং পরিবেশগত পরিবর্তন এনে রোগ নিরাময় করা সম্ভব। ছোট বেলা থেকেই যথাযথ খাদ্য এবং পুষ্টি গ্রহনের মাধ্যমে এবং প্রয়োজনীয় শারীরিক ব্যায়ামের মাধ্যমে ভবিষ্যত জীবনের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তের চর্বির সমস্যা, গেটে বাত, স্থুলতা ইত্যাদি প্রতিরোধ করা সম্ভব।
অংগ প্রতিস্থাপন (Transplantation)
অংগ প্রতিস্থাপনের এর জন্য ডোনোর বা অংগ দানকারীর সংখ্যা অপ্রতুল থাকার কারনে অংগ প্রতিস্থাপন অনেক সময় সম্ভব হয়ে ওঠে না। শুকরের HLA জীন ভ্রূণ অবস্থায় মানুষের HLA জীন দ্বারা প্রতিস্থাপিত করে শুকর উৎপাদন করলে শুকরের হার্ট দিয়ে মানুষের রোগাক্রান্ত হার্ট প্রতিস্থাপন করা যায়। এতে শুকরের হার্ট টি বর্জিত (Rejected) হবে না। এ ব্যাপারে বিস্তর গবেষনা চলছে এবং আশা করা যাচ্ছে ২০২৫ সালের দিকে সফল প্রতিস্থাপন সম্ভব হবে।
গরুর হার্ট ভাল্ব নিয়ে আমাদের দেশে গবেষনা হয়েছে কিন্তু এটার সাইজ বড় থাকার কারনে মানুষের হার্টে লাগানো সম্ভব হয় নি। মৃত মানুষের হার্টের ভাল্ব সংগ্রহ, জীবানুমুক্ত করন এবং সংরক্ষনের প্রথম গবেষনাটি আমার করা। মুশকিল হলো মৃত্যুর সময় থেকে ৬ ঘন্টার মধ্যে আমাদের দেশে পোস্ট মরটেমগুলো হয়না। তাই নির্ধারিত সময়ের ভিতর মৃতব্যাক্তি থেকে হার্ট সংগ্রহ করা অত্যন্ত দুরূহ। আমার ছাত্ররাও পরবর্তীতে এই গবেষনা চালিয়ে নিয়ে গিয়েছে কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা এটা মানব দেহে লাগাতে পারি নাই।
হার্টভাল্ব নিয়ে বিস্তারিত লেখাঃ আবিষ্কারের কাহিনী- কৃত্রিম হার্ট ভাল্ব
স্টেম সেল (Stem cell)
স্টেম সেল ( Stem cell) একধরনের প্রাথমিক কোষ যা থেকে উপযুক্ত পরিবেশ এবং পরিস্থিতিতে যে কোন ধরনের কোষ উৎপাদন করা যায়। স্টেম সেল দুই ধরনের।
- ভ্রূণ জাত (Embryonic stem cell) এবং
- প্রাপ্ত বয়ষ্কদের স্টেম সেল (Adult stem cell)
বাচ্চা হবার পরে নাড়ির রক্ত (Umbilical cord blood) ব্লাড ব্যাংকে সংগ্রহ করে রাখা যেতে পারে, এটা থেকে ভবিষ্যতে বিভিন্ন অংগ তৈরি করে তা প্রতিস্থাপনের কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। এডাল্ট স্টেম সেল বিভিন্ন রোগ সারানোর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়। জীন এবং স্টেম সেল নিয়ে গবেষনা এমন পর্যায়ে পৌছেছে যে এখন পুরুষ নারী ছাড়াই বাচ্চা উৎপাদন সম্ভব।
চিকিৎসা বিজ্ঞান ও ন্যানোটেকনোলোজী
চিকিৎসা বিজ্ঞান -এ প্রযুক্তির ব্যবহার নানা শাখায় শুরু হয়ে গিয়েছে আরো আগেই। বিভিন্ন রোগ নির্ণয়ে, চিকিৎসায় এর ব্যাবহার ক্রমাগত বেড়ে যাচ্ছে এবং জাবে। একটা উদাহরন দিলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। কান্সার নির্ণয় করতে আর চিকিৎসা দিতে কত কসরতই তো করাহয়। কিন্তু সফলতা কতোটুকু?
এখন যদি আমরা সিটি স্ক্যান, এম আর আই ইত্যাদি বাদ দিয়ে শুধুমাত্র একটা ইনজেকশন এর মাধ্যমে রোগটা ধরতে পারি তাহলে নিশ্চয় সবাই খুশি হবেন, আবার যেসব কান্সারের ভাল চিকিৎসা নেই সেগুলোতে ন্যানোটেকনোলজি ব্যাবহার করে অধিকতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পন্ন ঔষধ কম মাত্রায় শুধু শরীরের আক্রান্ত স্থানে ব্যাবহার করা যায় তাহলে ভাল ফল আশা করা যেতে পারে।
মুলত সহজ উপায়ে রোগ নির্ণয়ে, নির্ভুলভাবে এবং পরিমিত পরিমানে ঔষধ প্রয়োগে, রোগের মাত্রা বুঝে স্বয়ংক্রিয় ভাবে ঔষধ প্রয়োগে, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিরুপনে, জীবাণু ঘটিত ইনফেকশনে এন্টিবায়োটিক এর কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে এর ব্যাবহার শুরু হয়েছে। বিভিন্নপ্রকার এরোসল জাতীয় ঔষধ উৎপাদনে এর ব্যবহার বেশ আগে থেকেই আছে।
যদি এমন একটা ক্ষুদ্র ক্যাপসুল উৎপাদন করা যায় জা চামড়ার নীচে বসিয়ে দিলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে রক্তের চিনির মাত্রা বুঝে সেই অনুযায়ী প্রয়োজনমত ইনসুলিন প্রয়োগ করতে পারে তবে একজন ডায়াবেটিক রোগীর জীবন যাপন অনেক সহজ হয়ে যাবে। জীবাণুর বিরুদ্ধে এন্টিবায়োটিক এর কার্যকারিতা অনেকাংশেই নষ্ট হয়ে গেছে এর অপব্যাবহারের ফলে, জীবাণুর কোষের ভিতরে এন্টিবায়োটিক ঢুকতে পারেনা ফলে জীবাণুও মরে না।
ন্যানোটেকনোলজি ব্যাবহার করে জীবাণু কোষের ভিতরে প্রচলিত এন্টিবায়োটিক ঢুকানোর ব্যাবস্থা করে তাকে নির্মূল করা সম্ভব। সেইরকম ভাবে অনেক কান্সার আছে যার মধ্যে ঔষধ ঠিকমত ঢুকতে পারেনা, ফলে অধিক মাত্রায় ঔষধ প্রয়োগ করতে হয়। মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ফলে অনেক রোগীর অকাল মৃত্যু হয়। ঔষধ প্রয়োগের এই নতুন পদ্ধতি কম মাত্রার ঔষধ এর মাধ্যমে শুধু কান্সার আক্রান্ত কোষ ধ্বংস করবে স্বাভাবিক কোষের কোন ক্ষতি না করেই।
কান্সার এর ঔষধ যখন প্রয়োগ করা হয় তখন তা সারা শরীরে ছড়িয়ে পরে এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে, ন্যানোটেকনোলজিতে সূক্ষ্ম ভাবে ঔষধ প্রয়োগ করার সাথে সাথে বাইরে থেকে বিদ্যুৎ- চৌম্বক তরঙ্গ অথবা আলোক রশ্মির প্রয়োগের মাধ্যমে শুধু কান্সার আক্রান্ত জায়গায় ঔষধকে কার্যকরী তোলা হয় ফলে একদিকে কান্সার যেমন ধ্বংস হয়, অন্যদিকে স্বাভাবিক কোষগুলো ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়, ফলশ্রুতিতে রোগী সুস্থ হবার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার মত চিকিৎসা বিজ্ঞানেও বিপ্লব ঘটে যাবে ন্যানোটেকনোলজি ব্যাবহারের ফলে।
আয়ু বৃদ্ধিতে চিকিৎসা বিজ্ঞান
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বে গড় আয়ু ছিল ৫০বছর, মুক্তিযুদ্ধের সময় তা ৪৭বছরে নেমে যায়, কিন্তু এর পর গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়ে ২০১২ সালেই ৭০ বছর হয়ে গেছে এবং আরও বাড়বে বলে ধারনা করা হচ্ছে। এখন যুক্তরাষ্ট্রে গড় আয়ু ৭৮ বছর এবং প্রতিবছর তা তিন মাস করে বেড়ে যাচ্ছে। সর্বোচ্চ ৮৭-৮৮ বছর গড় আয়ু নিয়ে শীর্ষে আছে জাপান, চীন, হংকং, ফ্রান্স, ইতালি, সুইজারল্যান্ড ইত্যাদি দেশসমুহ আর ৪৮-৫১ বছরের গড় আয়ু নিয়ে সর্বনিম্নে অবস্থান করছে আফগানিস্তানসহ আফ্রিকার লেসোথো, সিয়েরা লিওন, বোতসোয়ানা ইত্যাদি দেশসমুহ।
একটু ভাল করে দেখলেই বোঝা যাবে, গড় আয়ু বৃদ্ধির পিছনে রয়েছে শিশু আর মাতৃ মৃত্যুর হার কমে যাওয়া, জীবানুজনিত রোগের সুচিকিৎসা, রোগ প্রতিরোধে ভাক্সিনের ব্যাবহার, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ডায়াবিটিস,কান্সার ইত্যাদি রোগের প্রতিরোধ, চিকিৎসা এবং নিয়ন্ত্রন, অপুষ্টির বিরুদ্ধে লড়াই, সবার জন্য উন্মুক্ত প্রাথমিক এবং উন্নতমানের চিকিৎসা নিশ্চিত করা, মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি , ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি, নিরাপদ পানীয় জলের সরবরাহ, পয়ঃনিস্কাশনের সুব্যাবস্থা ইত্যাদি নানাবিধ কারন।
সমাজ থেকে শোষণ নির্মূল করে ধনী গরীবের পার্থক্য ঘুচানো গেলে, নারীর ক্ষমতায়ন, সবার জন্য ভাত, কাপড়, জমি, কাজ সহ শিক্ষা নিশ্চিত করা গেলে, কুসংস্কার দুরীভুত করা গেলে সব দেশেই গড় আয়ু বৃদ্ধি পেত। মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেলেই চলবে না, প্রয়োজন কর্মক্ষম, অভিজ্ঞ নীরোগ দীর্ঘায়ু মানুষ, তা নাহলে তারা সমাজের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। বৈজ্ঞ্যানিকেরা ধারনা করছেন আগামী ২০৫৫ সালে যুক্তরাজ্যে মেয়েদের গড় আয়ু দাঁড়াবে ১০০বছরে, আর ২০৮০ সালের মধ্যে পুরুষদেরও গড় আয়ু ১০০ বছরে পৌছবে।
রোগ প্রতিরোধ এবং সুচিকিৎসা, স্ব্যাস্থকর জীবন যাপন, পরিমিত আহার-ব্যায়াম-বিশ্রাম, সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরনের মাধ্যমে, শোষণ- বৈষম্য- দুর্নীতি নির্মূল করা গেলে মানুষের গড় আয়ু ১৫০বছরে পৌছুতে পারবে। এর পরে বাড়াতে গেলে হাত দিতে হবে মানুষের জীনের উপর। বৈজ্ঞ্যানিকেরা বসে নেই, তারা বের করে ফেলেছেন প্রানীরা কেন বুড়ো হয়। বার্ধক্যকে এখন দেখা হচ্ছে একটা রোগ হিসাবে।
প্রত্যেক ক্রোমোজোমের (Chromosome) একপ্রান্তে টেলোমার (Telomere) বলে একটা অংশ থাকে যা বয়স বাড়ার সাথে সাথে ছোট হয়ে আসতে থাকে আর এক কোষ থেকে আর এক কোষ তৈরি হবার ক্ষমতা কমতে থাকে, আর তা হয় কোষের অভ্যন্তরের একজাতীয় এনজাইমের (Enzyme) কারনে। এই এনজাইমের প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়ে গেছে এবং এটা গবেষণাগারে অন্য প্রানীর উপর আরোপ করে ভাল ফল পাওয়া গিয়েছে।
উপসংহার
বিজ্ঞানের প্রত্যেকটা আবিষ্কারের ভাল এবং মন্দ দিক উভয়ই আছে। নির্ভর করে প্রয়োগের উপর, যেটার নিয়ন্ত্রন রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক শক্তির হাতে। মুনাফা অর্জনের জন্য, উদ্বৃত্ত মুল্য তৈরীর জন্য পুঁজিবাদ সস্তা শ্রমের বিপরীতে নতুন টেকনোলজি আবিষ্কারে ব্যস্ত।
টেকনোলজির অভুতপুর্ব উন্নয়নের সাথে সাথে তা ব্যবহারের খরচ বাড়ছে, গরীবের জন্য একধরনের টেকনোলজি ধনীদের জন্য আরেক ধরনের টেকনলজী। বৈষম্য বাড়ছে, সম্পদ, মুদ্রা কেন্দ্রীভুত হচ্ছে। আমরা রয়েছি চৌরাস্তার (Crossroad) সংযোগস্থলে। আমরা কোনদিকে যাব সে সিদ্ধান্ত আমাদেরকেই নিতে হবে।