করোনা ভাইরাস এর ক্ষোত্রে ’আপাত সারসংক্ষেপ’ লিখতে হচ্ছে কারন নতুন নতুন গবেষনা আর আবিষ্কারের সাথে সাথে প্রতিনিয়তই আমাদের জ্ঞান পরিতাজ্য, পরিশীলিত, পরিবর্তিত এবং সমৃদ্ধ হচ্ছে।
করোনা ভাইরাস
ভাইরাস জীব ও জড়ের মধ্যবর্তী অবস্থানে, কোষের অভ্যন্তরে জীবিত, কোষের বাইরে প্রানহীন অবস্থার কাছাকাছি। ভাইরাস ডিএনএ, আরএনএ-এক অথবা দ্বি- তন্তু বিশিষ্ট হতে পারে। ইলেক্ট্রন মাইক্রস্কোপে এর চেহারা ক্রাউন বা মুকুটের মত বলে একে করোনা ভাইরাস বলা হয়। অনেক ধরনের করোনা ভাইরাস আছে এবং এগুলো সর্দি জ্বর, সার্স, মার্স এবং কভিড-১৯ রোগ করে থাকে।
COVID 19 রোগের করোনা ভাইরাসের নাম SARS Cov-2 এবং এটা একটা এক-তন্তু বিশিষ্ট আরএনএ ভাইরাস যার চারিদিকে রয়েছে নিউক্লিওকাপ্সিড প্রোটিন, বাহিরে রয়েছে চর্বিজাতীয় এনভেলোপ, গায়ে লাগানো কাটার মতো স্পাইক প্রোটিন ছাড়াও ই-প্রোটিন, এম-প্রোটিন ইত্যাদি।
স্পাইক প্রোটিনের রিসেপ্টর বাইন্ডিং সাইট, ঝিল্লি কোষের এইস-২ রিসেপ্টরের সাথে যুক্ত হয়ে এইসব কোষের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে, সাইটপ্লাজমের ভিতর সংখ্যা বৃদ্ধি করে, কোষগুলোকে ধ্বংস করে বেরিয়ে আসে এবং নতুন কোষসমুহকে আক্রান্ত করে।
করোনা ভাইরাসের লক্ষণ ও রোগ উৎপত্তি
করোনা ভাইরাসের লক্ষণ জানতে হলে আগে জানতে হবে এই রোগের উৎপত্তি। করোনা ভাইরাস ঝিল্লিকোষে প্রদাহ সৃষ্টি করে, কোষ ধ্বংস করে কিন্তু মুলত আক্রান্ত কোষ এবং রোগ প্রতিরোধক কোষ থেকে নিঃসৃত রস (সাইটোকাইন- লিম্ফোকাইন, কেমোকাইন) ইত্যাদি শরীরের বিভিন্ন সিস্টেমে আঘাত করে এবং এগুলোকে অযথা অনিয়ন্ত্রিতভাবে চালু করে সর্বনাশ ডেকে নিয়ে আসে।
শ্বাসতন্ত্রে নিউমোনিয়া এবংপানি জমে যাওয়া, পরবর্তীতে লাংস ফাইব্রোসিস বা শক্ত হয়ে অক্সিজেন-কার্বন ডাই-অক্সাইড বিনিময় ব্যাহত হয়। রক্তনালীর প্রদাহে শিরা বা ধমনীর ভিতর রক্ত জমাট বেঁধে যায়, ফলশ্রুতিতে ডিভিটি, পাল্মোনারী এম্বোলিজম, হার্ট এটাক, স্ট্রোক, কিডনী ফেল করা, গাংগ্রীন হতে পারে।
পরিপাকতন্ত্রের প্রদাহের ফলে বমি, ক্ষুধামন্দা, ডায়ারিয়া হতে পারে, জ্বর, মাথা ব্যাথা, মাংশপেশীতে ব্যাথা, ঘ্রানশক্তি সাময়িকভাবে নষ্ট হয়ে যাওয়া ইত্যাদি নানারকম উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
ডায়াগনোসিস
করোনা ভাইরাস সংক্রমণ শনাক্তে ডায়াগনোসিস এর জন্য CBC, ESR, CRP, Serum Ferritin, Procalcitonin, D-dimer, Fibrinogen level, লিভার বা কিডনীর পরীক্ষা প্রয়োজনভেদে লাগবে। RT-PCR, Antibody/antigen detection, CT scan of chest ইত্যাদি পরীক্ষা লাগবে।
এন্টিবডি টেস্ট সাধারনত ১০দিন পর থেকে IgM এবং ২-৩ সপ্তাহ পর থেকে IgM, IgG এবং তার পর শুধু IgG নিরুপন করতে পারে। রোগীর শরীরে রোগ আক্রমনের ফলে এন্টিবডি তৈরি হলেই কেবল তা পজিটিভ হবে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কতটুকু গড়ে উঠবে তা অনেকগুলো ফ্যাক্টরের উপর নির্ভর করে।
তবে এই টেস্টের মাধ্যমে আক্রান্ত এবং অনাক্রান্ত ব্যাক্তিকে চিহ্নিত করা যায়। RT-PCR সাধারনত ৭০% ক্ষেত্রে পজিটিভ হয়। ফলস নিগেটিভ হবার কারন হিসাবে সোয়াব কোথা থেকে নেওয়া হলো (Nasal, Nasopharyngeal, Oropharyngeal, BAL etc.), আরএনএ এর কোন অংশটাকে বিবর্ধন করে কোন মেশিনের সাহায্যে পরীক্ষা করা হলো (Life technologies, Bio-rad, Gene expert, Bio molecular system etc.), এসবকে দায়ী করা হয়।
করোনা ভাইরাস সক্রমণের চিকিৎসা
লক্ষন অনুযায়ী (৮০% রোগী ঘরে রেখেই চিকিৎসা নিতে পারেন), বিভিন্নভাবে ফুস্ফুসে অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করা, দেহে তরল পদার্থ,পুষ্টি, ক্ষার ও এসিডের ভারসাম্য রক্ষা করা, প্রয়োজন অনুযায়ী ব্রংকোডাইলেটর, সেকেন্ডারী ইনফেকশনের ক্ষেত্রে এন্টিবায়োটিক, বিশেষ ক্ষেত্রে গাইডলাইন অনুযায়ী স্টেরয়েড, এনক্সাপারিন, টসিলিযুম্যাব, প্লাজমা থেরাপি দেওয়া যেতে পারে।
এন্টিভাইরাল ঔষধ সম্বন্ধে বিস্তর বিতর্ক রয়েছে। ফ্লাভিপিরাভির, রেমডেসিভির এর কার্যকারিতা আদৌ আছে কিনা তা বিতর্কিত, শক্তিশালী প্রমান নেই এর পক্ষে। হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন, আইভারমেক্টিন ব্যবহারের কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। রেমডেসিভির ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অংশ হিসাবে ব্যবহারের অনুমতি আছে।
করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর নতুন এন্টিভাইরাল ঔষধ তৈরি না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। ট্রিট্মেন্ট চলবে গাইডলাইন অনুযায়ী বৈজ্ঞানিক তথ্যের উপর ভিত্তি করে, তবে রোগীভেদে চিকিৎসায় পরিবর্তন আসতে পারে।
করোনা ভাইরাস রোধে ভ্যাক্সিন
প্রায় ১৫০ ধরনের ভ্যাক্সিন নিয়ে কাজ চলছে, যার মধ্যে ৮-১০ টি মানুষের উপর ট্রায়াল দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের ভ্যাক্সিন নিয়ে কাজ চলছে, এদের মধ্যে ভাইরাসের ডিএনএ , আরএনএ, প্রোটিন, পরিবর্তিত অথবা নিষ্ক্রিয় ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করিয়ে ভাইরাস প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে।
প্রত্যেকটা পদ্ধতি আলাদাভাবে তৈরি করে ভাক্সিন তৈরি করতে গেলে অনেক সময় লেগে যাবে বিধায় একটা কমন পদ্ধতিকে ( Viral platform) ব্যবহার করে তার উপর কিছুটা পরিবর্তন এনে নতুন ধরনের ভাক্সিন তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে।
এখানে প্লাটফরম হিসাবে মানুষের শরীরে ভাইরাস বা তার অংশ প্রবেশ করানোর জন্য অন্য ভাইরাস (যা মানুষে রোগ তৈরি করেনা) অথবা নিউক্লিয়িক এসিড ব্যবহার করা হচ্ছে। এর সাথে ভাইরাসের পরিবর্তিত অংশ যেমন নিস্ক্রিয় ভাইরাস, পরিবর্তিত আরএনএ, ভাইরাস এস প্রোটিন বা এর RBD (Receptor binding domain), যা মানুষের ACE-2 রিসেপ্টরের সাথে যুক্ত হয় তা সংযুক্ত করে মানুষের শরীরে প্রবেশ করানো হচ্ছে।
নতুন মেডিসিন উদ্ভাবন বিষয়ে জানতে পড়ুনঃ ঔষধ শিল্প; উদ্ভাবন থেকে মান নিয়ন্ত্রণ
ইমিউন রেসপনসের কারনে শরীরে ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী এন্টিবডি অথবা ভাইরাস ধংশকারী T-cell গড়ে উঠবে, যা ভাইরাস আক্রমন প্রতিহত করতে পারবে। আক্রান্ত কোষের বাইরে যে ভাইরাস থাকবে তা এন্টিবডি দিয়ে প্রতিহত হবে এবং আক্রান্ত কোষের অভ্যন্তরের ভাইরাসগুলোকে অথবা আক্রান্ত কোষগুলোকেই T-cell (Cytotoxic) ধ্বংস করে দেবে।
এ পর্যন্ত হিসাব আর হিসাবের বাইরের আক্রান্ত জনসংখ্যাকে সর্বোচ্চ ৫ কোটি ধরলে, বাকি ৬৯৫ কোটি জনসংখ্যার কমপক্ষে ৮০% কে ভাক্সিন দিতে হলে কি পরিমান ভাক্সিন, জনবল, সময় আর খরচ লাগবে, সেটা অনুমান করার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। এর সঙ্গে বিশ্ব রাজনীতি, শোষন আর বঞ্চনার আগ্রাসী ভুমিকাতো আছেই।
একটা ভাইরাসে অনেক ধরনের এন্টিজেন থাকে এবং এর প্রতিক্রিয়ায় অনেক ধরনের এন্টিবডিও তৈরি হয়, কাজে লাগবে শুধু সেই ধরনের এন্টিবডি যা ভাইরাস প্রবেশে বাধা দিবে অথবা ভাইরাস আক্রান্ত কোষগুলোকে অংকুরেই বিনষ্ট করে দিবে। ব্যাপারটা অত সহজ নয়, সেটা সহজেই অনুমেয়।
মনোক্লোনাল এন্টিবডি
টিটেনাসের বিরুদ্ধে সক্রিয় ভাক্সিন হচ্ছে Tetanus Toxoid (TT) ইনজেকশন আর Tetanus immunoglobulin (TIG) হচ্ছে এন্টিবডি, যা এর বিরুদ্ধে সাথে সাথেই কাজ করে। কভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে আমাদের সক্রিয় ভাক্সিন ছাড়াও এন্টিবডি লাগবে।
সক্রিয় ভাক্সিন যাদের রোগ নেই, তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর কাজে লাগবে। আর যাদের শরীরে ভাইরাস ঢুকে গেছে তাদেরকে রোগের হাত থেকে বাচানোর জন্য এন্টিবডি অথবা কার্যকরী এন্টিভাইরাল ঔষধ লাগবে।
যাদের রোগ হয়ে গেছে তাদের জন্য কার্যকরী এন্টিভাইরাল ড্রাগ, লক্ষন অনুযায়ী চিকিৎসার যাবতীয় ঔষধ আর সরঞ্জাম লাগবে। প্রতিরোধের জন্য কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন, সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখা, লকডাউন ইত্যাদি সবগুলো পদ্ধতিই প্রয়োজনানুসারে ব্যবহার করতে হবে।
এছাড়া চিকিৎসাকেন্দ্রে Universal precautionএর উন্নত ধাপ Standard protocol ব্যবহার করতে হবে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পদ্ধতি ব্যবহার, মৃতদেহের সৎকারে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি এবং পরিবেশ সুরক্ষায় যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে।
শেষ কথা
ভাক্সিন ছাড়াও HIV ভাইরাস সৃষ্ট রোগ AIDS কে যেভাবে নিয়ন্ত্রন করা গেছে, সে ভাবেই হয়তোবা করোনা ভাইরাস কে নিয়ন্ত্রনে আনতে হবে। ভাক্সিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার দিকেও নজর রাখতে হবে, ৬৯৫ কোটি লোকসংখ্যার ১% ও কিন্তু অনেক লোক।
তাছাড়া শতকরা কতজনে ভাক্সিন প্রতিরোধক হিসাবে কাজ করবে, কতদিন এই প্রতিরোধ কার্যকরী থাকবে, বুস্টার ডোজ লাগবে কিনা, ভাইরাস মিউটেশন হয়ে গেলে ভাক্সিন কাজ করবে কিনা এসব জটিল প্রশ্নের সমাধান লাগবে।
করোনা ভাইরাস এর চিকিৎসায় লড়াইটা করতে হবে বিভিন্ন ফ্রন্টে, সার্বজনীন ভাবে ব্যাক্তিগত এবং সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকে। পরস্পরের প্রতি এবং নিজের প্রতি যত্নবান হতে হবে বোধি আর বোধের সংমিশ্রণে।