জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন ২০০৪ যা যার প্রয়োগ শুরু হয় ২০০৬ সালে এবং ২০১৩ সালে প্রথমবার সংশোধন করা হয়। পরবর্তিতে ২০১৮ সালে ”জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন বিধিমালা ২০১৮” -এর মাধ্যমে বাংলাদেশে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন একটি পূর্ণাঙ্গ প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো লাভ করে।
মুলত জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন কার্যক্রম ২০০৬ সাল থেকে চলমান থাকলেও তা ছিলো শুধুমাত্র অফলাইন নিবন্ধনের মাধ্যই সিমাবদ্ধ। ২০১৮ সালের পরে সব তথ্য ডিজিটালাইজ পদ্ধতিতে সংরক্ষন শুরু হয় এবং এই সময় থেকেই মুলত শুরু হয় অনলাইন জন্ম নিবন্ধন।
বাংলাদেশ সরকার তার সকল নাগরিকের জন্ম নিবন্ধন তথ্য অনলাইন ডাটাবেইজে সংরক্ষনের জন্য ২০২১ সাল থেকে নতুন একটি নিয়ম চালু করে। নতুন নিয়মে যাদের জন্ম ২০০১ সালের পরে তাদের জন্ম নিবন্ধন ও জন্ম নিবন্ধন সংশোধনের জন্য বাবা-মায়ের অনলাইন জন্ম নিবন্ধন সনদও বাধ্যতামুলকভাবে সংযুক্ত করতে বলা হয়েছিলো।
তবে এই নিয়মে ভোগান্তির কারনে ২৭ জুলাই ২০২২ তারিখ থেকে সন্তানের জন্মনিবন্ধনের ক্ষেত্রে আর বাবা-মায়ের জন্ম নিবন্ধন বাধ্যতামুলক থাকছেনা। শুধমাত্র হাসপাতালের ছাড়পত্র অথবা টিকা কার্ড জমা দিলেই জন্ম নিবদ্ধন করা যাবে। তবে এক্ষেত্রে এখনও কোন সরকারি আদেশ জরী করা হয়নি।
তাই আপনার বা আপনার শিশুর জন্ম নিবন্ধন এখনও যদি না করা হয়ে থাকে তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তা করে ফেলুন। আর ভোগান্তি কমাতে এই লেখাটি থেকে জেনে নিন অনলাইন জন্ম নিবন্ধনের জন্য খরচ কত হবে, আপনাকে কোথায় যেতে হবে এবং কি কি প্রয়োজনীয় কগজ পত্র রেজিস্ট্রেশনের জন্য সাথে নিতে হবে।
জন্ম নিবন্ধনের প্রয়োজনীয়তা
জন্ম নিবন্ধন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি সনদ তবে সত্যিকরে বলতে এর গুরুত্বটা আমরা সথাসময়ে বুঝিনা। শুধুমাত্র যখন প্রয়োজন পড়ে তখনই মাত্র এটার গুরুত্ব আমরা বুঝতে পারি এবং শুরু হয় ভোগান্তি ও দৌড়াদৌড়ি। আসুন প্রথমে জেনে নেওয়া যাক কি কি কাজে আপনার জন্ম নিবন্ধন সনদটির প্রয়োজন হবে।
- জাতীয় পরিচয়পত্র গ্রহণের জন্য জন্ম নিবন্ধন বাধ্যতামুলক।
- ১৮ বছর পর্যন্ত বা জাতিয় পরিচয় পত্র না পাওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে জন্ম নিবন্ধন সনদ ব্যবহার করতে হবে।
- শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি ও মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের রেজিস্ট্রেশনের জন্যও জন্ম নিবন্ধন সনদ বাধ্যতামুলক
- বিবাহ নিবন্ধনের ক্ষেত্রে জন্ম নিবন্ধন সনদের ব্যবহার বাধ্যতামুলক।
তাছাড়া আপনি যে জন্মসূত্রে একজন বাংলাদেশী নাগরিক তার পরিচয় বা প্রমান এই জন্ম নিবন্ধন সনদপত্রটি। তাই একটি শিশু জন্ম নেওয়ার পরেই বাবা-মায়ের উচিত অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজের পাশাপাশি অনলাইনে জন্ম নিবন্ধনটি সেরে ফেলা।
অনলাইন জন্ম নিবন্ধন আবেদন পদ্ধতি
অনলাইনের মাধ্যমে আপনি নিজেই নিজের জন্ম নিবন্ধন সম্পন্ন করতে পারবেন, তার জন্য আপনাকে জন্ম নিবন্ধনের জন্য আবেদন ফরম টি ওপেন করে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি প্রদান করে নিবন্ধনের জন্য সাবমিট করতে হবে। এবং সাবমিট করা ফরমটির একটি প্রিন্ট কপি নিয়ে তার সাথে প্রয়োজনীয় কাগজ (নিচে উল্লেখ করা আছে) সংযুক্ত করতে হবে। আসুন ধাপগুলো জেনে নেওয়া যাক পর্যায়ক্রমে।
- অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন-এর জন্য আবেদন করতে প্রথমে যেতে হবে বাংলাদেশ সরকারের জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন ওয়েবসাইটে। প্রথমে কোথা থেকে জন্ম নিবন্ধন সনদ সংগ্রহ করবেন সেটা নির্বাচন করুন। আপনি অপনার জন্মস্থান অথবা স্থায়ী ঠিকানা অথবা বর্তমানর মধ্যে যেকোন একটি জায়গা থেকে জন্ম সনদ নিতে পারবেন।
- এরপরের ধাপে যার জন্য নিবন্ধন করা হচ্ছে সঠিক ভাবে তার নাম, ঠিকানা ও বাবা-মায়ের তথ্য প্রদান করতে হবে। অবেদনকারীর জন্ম যদি ২০০১-এর আগে হয় তহলে বাবা-ময়ের নাম এবং জাতীয় পরিচয়পত্রের নাম্বার প্রদান করতে হবে। অন্যথায় বাবা ও মায়ের অনলাইন জন্ম সনদের নাম্বার এখানে লিপিবদ্ধ করতে হবে। (তবে ২৭ জুলাই ২০২২ তারিখ থেকে বাবা মায়ের জন্ম নিবন্ধন আর বাধ্যতামুলক জমা দেওয়া লাগছে না।)
- সবশেষে প্রার্থীর মোবাইল নাম্বার অর্ন্তভুক্ত করতে হবে। অর্ন্তভুক্ত নাম্বারে একটি অ্যাপ্লিকেশন আইডি সহ জন্ম সনদের জন্য আবেদন সংক্রান্ত বার্তা মেসেজ আকারে পাবেন। যা দিয়ে আাপনার আবেদনের অবস্থা জানতে পারবেন।
- অনলাইনে আবেদনটি সম্পন্ন করে একটি কপি ডাউনলোড করে প্রিন্ট নিয়ে নিন এবং আবেদন পত্রের সাথে প্রয়োজনীয় সকল কাগজপত্র সংযুক্ত করুন।
- সকল কাগজপত্র সহ সর্বোচ্চ ১৫কর্ম দিবসের মধ্যে আপনার এলাকার সিটি করপোরেশন/পৌরসভা/ইউনিয়ন পরিষদের কার্যালয়ে জন্ম নিবন্ধন ফি সহ ফরমটি জমা দিন।
- দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আপনার থেকে ফরমটি জমা নিয়ে একটি গ্রাহক কপি প্রদান করবে। এর পরে আপনার দেওয়া মোবাইলে জন্ম সনদ নিশ্চিতকরণ বার্তা আসলে গ্রাহক কপিটি জমা দিয়ে আপনার জন্ম নিবন্ধন সংগ্রহ করুন।
জন্ম নিবন্ধনের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
আপনার বয়স অনুযায়ী প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ভিন্ন হতে পারে। যেমন যে শিশু গতকাল ভুমিষ্ঠ হয়েছে তার জন্য যে কাগজপত্র প্রয়োজন হবে ঠিক একই কাগজ একটি ৬ বছর বয়সের শিশুর জন্য প্রয়োজন হবেনা। আবার আপনার শিশুর জন্ম নিবন্ধন করতে গিয়ে দেখলেন শিশুর সাথে সাথে আপনারও জন্মনিবন্ধন ডিজিটাল করা নেই। সেক্ষেত্রে আপনার জন্ম নিবন্ধনের জন্য প্রয়োজনীয় কগজ হবে ভিন্ন। আসুন জেনে নেওয়া যাক বয়স ভেদে কার জন্য কি কাগজ পত্র প্রয়োজন হবে।
০১ থেকে ৪৫ দিনের মধ্যে জন্ম নিবন্ধনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কগাজ
- হাসপাতালের ছাড়পত্র/ইপি.আই বা টিকা কার্ড অথবা স্বাস্থ্য কর্মীর স্বাক্ষর ও সীলমোহর সহ প্রত্যয়নপত্র।
- বাবা ও মায়ের অনলাইন জন্ম নিবন্ধন সনদের (বাংলা ও ইংরেজী) ফটোকপি। (এখন আর বাধ্যতামূল নয়)
- বাবা ও মায়ের জাতীয় পরিচয় পত্রের ফটোকপি
- বাসার/বাড়ির হোল্ডিং ট্যাক্স রশিদের ফটোকপি (হাল সন)
- আবেদনকারী অথবা অভিভাবকের মোবাইল নম্বর।
- ০১ কপি রঙ্গিন পাসপোর্ট সাইজ ছবি।
৪৬ দিন বয়স থেকে ৫ বছরের মধ্যে জন্ম নিবন্ধনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কাগজ
- অনলাইনে আবেদনকৃত ফর্মের প্রিন্ট কপি।
- হাসপাতালের ছাড়পত্র/ইপি.আই বা টিকা কার্ড।
- বাবা ও মায়ের অনলাইন জন্ম নিবন্ধন সনদের (বাংলা ও ইংরেজী) ফটোকপি। (বাধ্যতামূলক নয়)
- বাবা ও মায়ের জাতীয় পরিচয় পত্রের ফটোকপি
- প্রযোজ্য ক্ষেত্রে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের প্রত্যয়নপত্র সীল ও স্বাক্ষর সহ।
- বাসার/বাড়ির হোল্ডিং ট্যাক্স রশিদের ফটোকপি (হাল সন)
- আবেদনকারী অথবা অভিভাবকের মোবাইল নম্বর।
- ০১ কপি রঙ্গিন পাসপোর্ট সাইজ ছবি।
০৫ বছরের উর্ধ্বে বয়স অথবা ০১/০১/২০০১ এর পরে যাদের জন্ম তাদের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজ
- শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদপত্র অথবা সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকের প্রত্যয়ন (স্বাক্ষর ও সীল সহ) এবং জন্ম নিবন্ধন আবেদন ফরমে ৭ এর ১ নং কলামে স্বাক্ষর ও সীল (বাধ্যতামূলক)।
- বাবা ও মায়ের অনলাইন জন্ম নিবন্ধন সনদ (বাংলা ও ইংরেজী)।
- বাবা ও মায়ের জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি।
- বাড়ীর হোল্ডিং নাম্বার এবং হোল্ডিং ট্যাক্স এ রশিদ হাল সন লাগবে।
- আবেদনকারী অথবা অভিভাাবকের মোবাইল নম্বর।
- ০১ কপি রঙ্গিন পাসপোর্ট সাইজের ছবি।
- সংযুক্ত সকল ডকুমেন্টে সরকারি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অথবা ওয়ার্ড কাউন্সিলরের সীলমোহর সহ স্বাক্ষর বাধ্যতামূলক।
- আবেদনের সাথে সংযুক্ত সকল ডকুমেন্টের মূল কপি আবেদন পত্র জমা দেওয়ার সময় প্রদর্শন করতে হবে।
যাদের জন্ম ০১/০১/২০০১ এর আগে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
- শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদপত্র অথবা সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকের প্রত্যয়ন (স্বাক্ষর ও সীল সহ) এবং জন্ম নিবন্ধন আবেদন ফরমে ৭ এর ১ নং কলামে স্বাক্ষর ও সীল (বাধ্যতামূলক)।
- নিজের জাতীয় পরিচয়পত্রে ফটোকপি।
- পিতা-মাতার জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি। পিতা-মাতা মৃত হলে মৃত্যু সনদ প্রদান করতে হবে।
- বাড়ীর হোল্ডিং নাম্বার এবং হোল্ডিং ট্যাক্স এ রশিদ হাল সন লাগবে।
- আবেদনকারী মোবাইল নম্বর।
- ০১ কপি রঙ্গিন পাসপোর্ট সাইজের ছবি।
- সংযুক্ত সকল ডকুমেন্টে সরকারি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অথবা ওয়ার্ড কাউন্সিলরের সীলমোহর সহ স্বাক্ষর বাধ্যতামূলক।
- আবেদনের সাথে সংযুক্ত সকল ডকুমেন্টের মূল কপি আবেদন পত্র জমা দেওয়ার সময় প্রদর্শন করতে হবে।
আবেদন পত্র ও নিবন্ধন ফি কোথায় জমা দেবেন এবং কত সময় লাগবে
আবেদনপত্রের সাথে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংযুক্ত করার পরে সংশ্লিষ্ট সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন শাখাতে জমা দিতে হবে। এই সময়ে আপনাকে ফি (যদি প্রযোজ্য হয়) প্রদান করতে হবে। সাধারণত আবেদন পত্র জমা দেওয়া থেকে ৫ কর্ম দিবসের মধ্যেই জন্ম নিবন্ধন সনদ তৈরি হয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ১ মাসের মত সময় লেগে যায়।
জন্ম নিবন্ধন-এর জন্য প্রয়োজনীয় ফি
নিবন্ধনের ধরন | বাংলাদেশের খরচ | বাংলাদেশের বাইরে খরচ |
---|---|---|
০ থেকে ৪৫ দিনের মধ্যে | ০০ টাকা | ০০ ইউএসডি |
৪৬ দিন থেকে ৫ বছরের মধ্যে | ২৫ টাকা | ০১ ইউএসডি |
৫ বছরে উর্ধ্বে | ৫০ টাকা | ০২ ইউএসডি |
সংশোধন | ১০০ টাকা | ০২ ইউএসডি |
জন্ম সনদের কপি নিতে | ৫০ টাকা | ০১ ইউএসডি |
সাধারণত যে প্রশ্নগুলো করা হয়ে থাকে
না, একই ব্যক্তি একবারের বেশি জন্ম নিবন্ধন করতে পারবে না। একাধিকবার জন্ম নিবন্ধন জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন ২০০৪ অনুযায়ী একটি দন্ডনীয় অপরাধ। যদি অনলাইনে একের অধিক জন্ম নিবন্ধন পাওয়া যায় তাহলে আসলটি রেখে সঠিক নিয়ম মেনে অন্যটি বাতিল করা উচিৎ। নতুবা ভবিষ্যতে না না ধরনের ঝামেলায় জড়াতে হতে পারে।
অনলাইন আবেদন ফরম পুরণের সময় বাংলা লেখার জন্য আপনাকে অবশ্যই উইনিকোড ব্যবহার করে লিখতে হবে। আর সেক্ষেত্রে সহজ সমাধান হতে পারে বিজয় অথবা অভ্র ব্যবহার।
বিবাহিত নারীর স্থায়ী ঠিকানা হিসাবে বিবাহের আগের ঠিকানা অর্থাৎ বাবার বাড়ীর ঠিকানা ব্যবহার করতে হবে।
জন্ম নিবন্ধন করার সময় বাংলাদেশের স্থায়ী নাগরিক হিসেবে যথাযথ প্রমাণ দেখিয়ে দেশের স্থায়ী ঠিকানায় জন্ম নিবন্ধন করতে পারবেন।
শেষকথা
আপনি যে জন্মসূত্রে একজন বাংলাদেশী নাগরিক তার পরিচয় বা প্রমান এই জন্ম নিবন্ধন সনদপত্রটি। তাই শিশু জন্ম নেওয়ার পরেই বাবা-মায়ের উচিত অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজের পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারের জন্ম নিবন্ধন রেজিস্টারে শিশুটির নাম লিপিবদ্ধ করানো। এবং লক্ষ রাখা উচিৎ যেন এটি সঠিক ও নির্ভুলভাবে তৈরী করা হয়। আশা করি কোনরকম ভোগান্তি ছাড়াই সঠিকভাবে জন্ম নিবন্ধন সনদ তৈরী করার মুক্তপ্রানের এই লেখাটি আপনাকে কিছুটা হলেও সাহায্য করবে।