পৃথিবীর এই বিশাল জনসংখ্যার খাদ্যতালিকায় মাংস একটি বড় জায়গা দখল করে আছে। কয়েক বিলিয়ন মানুষের প্রতিদিনের মাংসের চাহিদা মেটাতে প্রাণীহত্যর সাথে সংযুক্ত রয়েছে পরিবহন, প্রক্রিয়াজাতকরন, সংরক্ষণ ইত্যাদি কাজগুলো, যেগুলোর প্রতিটি পর্যায়েই ঘটে উচ্চ পরিমাণে কার্বন নিঃসরণ। পরিসংখ্যান বলে বিশ্বের ১৪ শতাংশ গ্রিন হাউজ গ্যাসের সৃষ্টি হয় গবাদি পশু থেকে। অন্যদিকে কার্বন নিঃসরণের এক-তৃতীয়াংশের জন্য দায়ী খাদ্য উৎপাদন খাত। তাই গবেষণা চলছে কৃত্রিম মাংস (Artificial Meat) উৎপাদন করে তা প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় অর্ন্তভুক্তির।
খাদ্য তালিকায় কৃত্রিম মাংসের (Artificial Meat) চাহিদা
বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ২০১৭ সালের (UN Food and Agriculture Organization, 2017) জরীপ অনুযায়ী মানুষের মাংসের চাহিদা মেটানোর জন্য প্রতিবছর প্রায় ৭২ বিলিয়ন (৭২০০ কোটি) প্রাণী হত্যা করা হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রায় ৫০০০ কোটি হাঁস মুরগী, ১৫০ কোটি শূকর, ৫৪ কোটি ৬০ লক্ষ ভেড়া, ৪৪ কোটি ৫০ লক্ষ ছাগল এবং ৩০ কোটি গরু মহিষ। এর সঙ্গে যুক্ত হবে ধর্মীয় উৎসব, বিভিন্ন অনুষ্ঠান, শোক সভা ইত্যাদিকে ফলপ্রসূ করার জন্য প্রাণীহত্যা।
এই হিসাবে মাছ, হাঙ্গর, কুমীর, সাপ, নানারকম বন্য প্রানীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। হলে সংখ্যা অবিশ্বাস্য রকমের বড় হতে পারত, তাতে সন্দেহ নেই। মানুষ নিষ্ঠুরতায় সব প্রাণীকে ছাড়িয়ে গেছে। হাঙ্গরের চোয়ালের থেকেও তার হাতের ছুরি অনেক ধারালো তা প্রতিয়মান।
বড় প্রাণী ছোট প্রাণীকে খেয়ে ফেলে, বড় মাছ ছোট মাছকে খেয়ে ফেলে, এদের সংবেদনশীল স্নায়ুতন্ত্র একের মৃত্যুযন্ত্রণা আর অপরের ক্ষুৎপিপাসা নিবারণ এই চক্রে আবর্তিত। কিন্তু অন্য রকম মানুষও তো আছে, যারা ফুড চেইনের এই নিষ্ঠুর বর্বরতা থেকে বের হয়ে আসতে চাইছেন।
এটা প্রাকৃতিক নির্বাচন এবং যোগ্যতমের বেঁচে থাকার শর্ত পুরন করে এটা যেমন সত্য, তেমনই এই মানুষেই পারে কৃত্রিম বিবর্তনের মাধ্যমে এই নিষ্ঠুরতার খাদ্যচক্রকে ভেঙ্গে ফেলতে। গবেষণা চলছে তাই কৃত্রিম খাদ্য উৎপাদনের জন্য, এক্ষেত্রে গুণসম্পন্ন এবং মানসম্পন্ন মাংস উৎপাদনের গবেষণা এগিয়ে আছে সবচেয়ে বেশী। তবে কৃত্রিম মাংস বিভিন্ন স্বাদের প্রানীজ মাংসের স্বাদের বিভিন্নতা পূরণ করতে পারবে কিনা সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
কৃত্রিম মাংস (Artificial Meat) কি?
কোনও প্রাণী হত্যা থেকে প্রাপ্ত মাংস নয়, গবেষণাগারে তৈরি মাংস বানিজ্যিকভাবে উৎপাদন ও মানুষের খাবার হিসেবে গ্রহণ ও বিক্রয়ের অনুমতি দিয়েছে সিঙ্গাপুর সরকার, যা এ পর্যন্ত বিশ্বে গবেষণাগারে মাংস উৎপাদন ও বিপননের প্রথম ঘটনা। তবে প্রশ্ন থাকতেই পারে যে, এই কৃত্রিম মাংস আসলে কি?
সাধারণত আপনাকে মাংস পেতে হলে প্রাণী হত্যা করে তার থেকে মাংস সংগ্রহ করতে হবে। তবে কৃত্রিম মাংসের ক্ষেত্রে তার কোন প্রয়োজন পড়বে না। কারন, গবেষণাগারে প্রাণীদেহের অভ্যন্তরেই কোষ (Cell) কালচারের মাধ্যমে তৈরি হয় কৃত্রিম মাংস। এই ব্যবস্থাকে কোষীয় পর্যায়ের একটি উৎপাদন ব্যবস্থাও বলা যেতে পারে।
কৃত্রিম মাংস (Artificial Meat) উৎপাদনের ইতিহাস
প্রথম কৃত্রিম মাংস নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয় ১৯৩১ সালে, উইনস্টন চার্চিল তার ‘ফিফটি ইয়ারস হেন্স’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন: ‘মুরগির শরীরের প্রতিটি অংশ আলাদা আলাদা উৎপাদনের মাধ্যমে মুরগির পাখা বা বুকের মাংস খাওয়ার জন্য একটি সম্পূর্ণ মুরগিকে বড় করে তোলার অযৌক্তিকতা থেকে মুক্তি পাবো’।
এরপর অনেক বৈজ্ঞানিক Artificial Meat নিয়ে গবেষণা করলেও ২০০১ সালে নাসার নভোচারীদের প্রয়োজনে এ বিষয়ে গবেষণা আবার বৃদ্ধি পায় এবং এই মাংস মানুষের খাদ্য হিসাবে Food and Drug Administration (FDA) -এর স্বীকৃতি পায়।
বেঞ্জামিন্সন ২০০২ সালে গোল্ডফিসের মাংসপেশি কৃত্রিম মিডিয়াতে কালচার করতে সক্ষম হন, এবং জন এফ ভেইন টিস্যু ইঞ্জিনিয়ারিং পদ্ধতিতে Artificial Meat তৈরি করার পদ্ধতি পেটেন্ট করেন ১৯৯১ সালে। পাশের দেশ ইন্ডিয়াতে কৃত্রিম মাংস ও দুধ উৎপাদন অনেকটা এগিয়েছে তবে, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কৃত্রিম মাংস উৎপাদন বা বাজারজাতকরন নিয়ে কোন উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি।
কেন কৃত্রিম (Artificial Meat) মাংসের প্রয়োজন
আদিমকালে পশুশিকার থেকে শুরু হয়েছে মাংস খাওয়ার পালা। তারপর কিছু কিছু পশু, হাঁস-মুরগী, টার্কি, কবুতর পালন, মৎস্য শিকার ইত্যাদির মাধ্যমে এর ব্যাপ্তি বৃদ্ধি পেয়েছে, আর মসলার আবিষ্কার মাংসকে বানিয়েছে সুস্বাদু রসনাতৃপ্তিকর। এসব কর্মকান্ডে ব্যবহৃত হচ্ছে অনেক জমি, প্রচুর পশুখাদ্য, তৈরি হচ্ছে প্রচুর বর্জ্য আর কার্বন ফলে বাড়ছে জলবায়ু দূষণ।
এছাড়া জীবানুঘটিত রোগ, হার্ট ও রক্তনালির রোগ সহ স্ট্রোকের পরিমাণ যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমনই, খাদ্যদূষণ, হেভী মেটাল পয়জনিংসহ আরো অনেক সমস্যা মাংস ভক্ষণের সাথে সাথে বাড়ছে। আর এই করনেই চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে যে, কিভাবে জীবানুমুক্ত, ক্ষতিকর পদার্থমুক্ত মানুষের শরীর উপযোগী উপাদান ঠিক রেখে মাংস উৎপাদন করা যায়। ল্যাবোরেটরী ছাড়া এর বিকল্প নেই।
কৃত্রিম মাংস (Artificial Meat) উৎপাদন পদ্ধতি
জীবানুমুক্ত পরিবেশে কৃত্রিম মাংস উদপাদন করতে হবে যাতে সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। এখানে সংক্ষিপ্ত আকারে এই পদ্ধতিগুলো নিয়ে আলোচনা করা হবে।
মাংস পেশীর কোষ এবং ছাঁচ ( Scaffold)
সুস্বাদু মাংস উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন মাংস তৈরির কোষ, বাড়ন্ত কোষগুলোকে ধরে রাখার জন্য উপযুক্ত ছাঁচ বা Scaffold এবং প্রয়োজনীয় চর্বি যা আবার কলেস্টেরল বাড়াবে না। এর পরে এগুলোকে এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে এর মধ্যে নরম থেকে শক্ত সব ধরনের মাংসই পাওয়া যায়।
Meat and Meat Alternatives Regulation | The Regulatory Review (theregreview.org)
প্রানীদের মাংসপেশীর আবরনের ভিতর একধরনের কোষ থাকে যাকে স্যটেলাইট সেল (Satellite cell) বলে। এছাড়াও গর্ভস্থ প্রাণীদের যে এম্ব্রায়োনিক মায়োব্লাস্ট (Embryonic Myoblast) থাকে সেগুলিকে সেল কালচার অথবা টিস্যু কালচারের মাধ্যমে উৎপাদিত করা হয়। পুর্নাংগ প্রাণীর দেহ থেকে অবশ করার পর বায়োপ্সি (Biopsy) করে এইসব কোষ সংগ্রহ করা হয়।
গুনাগুণ ও মান নিয়ন্ত্রণ
এরসঙ্গে অন্যান্য কোষ যেমন- চর্বি কোষ, ফাইব্রোব্লাস্ট ইত্যাদি যোগ করে মাংসের গুণাগুণ পরিবর্তন করা হয়। এখানে চর্বি কোষের কিছু পরিবর্তন করা হয় যাতে ক্ষতিকর কোলেস্টেরল তৈরি না হতে পারে। ওমেগা-৩ ফ্যাট তৈরির কোষ এখানে যোগ করা যেতে পারে। ছাঁচ তৈরির জন্য কোষ বিহীন টিস্যু, ন্যানোটেকনোলজি ব্যবহার করা যেতে পারে।
ছাঁচের উপর ফেলে এগুলোকে বিভিন্ন হরমোন, পুস্টিকর পদার্থ সহযোগে কালচার করা হয়। এভাবেই কৃত্রিম মাংস তৈরি হয়। আগে এইসব পুস্টিকর উপাদান বাছুরের সিরাম থেকে সংগ্রহ করা হত, এখন এগুলো উদ্ভিদ থেকেও পাওয়া যায়।
উদ্ভিদ থেকে কৃত্রিম মাংস
প্রানীর দেহ থেকে কোষ না নিয়েও খাদ্যগুন সম্পন্ন কৃত্রিম মাংস উদ্ভিদ থেকেও তৈরি করা যায়। যারা শুধুমাত্র নিরামিষে অভ্যস্ত তারা এখন এই মাংস খেতে পারবেন। উদ্ভিদ থেকে এই মাংস উৎপাদনের জন্য প্রায় ৯০% কম পানি, জমি আর শক্তির উৎস হিসাবে কম খনিজ তেল ব্যবহৃত হবে। বিভিন্ন রকম ইস্ট থেকে স্বাদ বৃদ্ধির জন্য এইসব আমিষের উপাদান তৈরি করা হয়। আর এই মাংসের স্টেক তৈরি হয় থ্রিডি প্রিন্টারের মাধ্যমে।
কৃত্রিম মাংস উৎপাদনের ভবিষ্যৎ
১৯৩১ সালে বৃটিশ প্রধান মন্ত্রী উইন্সটন চার্চিল ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন অল্প কিছুদিনের মধ্যেই কৃত্রিম মাংস বাজার দখল করে নেবে। ডক্টর মার্ক পোস্ট ২০১৩ সালে কৃত্রিম মাংস দিয়ে যে হ্যামবার্গার তৈরি করেছিলেন, তা তৈরি করতে লেগেছিল ২ বছরেরও বেশী সময়। আর তার দাম ছিল ৩,৩০,০০০ ইউএস ডলার, যেখানে এই একই মানের একটা হ্যাম বার্গারের দাম পড়ে ১০-১২ মার্কিন ডলার। তবে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, সামনের দিনের খাদ্যের যোগান যে বায়োটেকনোলোজির মাধ্যমে হবে এতে কোন সন্দেহ নেই।