দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত যন্ত্রপাতির সূক্ষতা মাপতে ব্যবহার করা হত মিলিমটার স্কেল। সেই সময়ে ন্যানোটেকনোলজি (Nanotechnology) তো দুরের কথা মিলিমিটারের থেকে ছোট কোন বস্তু নিয়েও চিন্তা ভাবনা করার অবকাশ ছিলনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ট্রানজিস্টর আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে সেমিকন্ডাকটরের পথচলা শুরু হয়, আর এখান থেকেই সূচনা হলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এক নতুন অধ্যায়ের।
এর পর ১৯৮০ সনে IBM এর একদল গবেষক আবিষ্কার করলেন STM (Scanning Tunneling Microscope) যা দিয়ে অণুর গঠন সুক্ষভাবে দেখা সম্ভব। মুলত মইক্রোটেকনোলজির পথচলার শুরুটাও হয়েছিলো এখান থেকেই। আর এই STM যন্ত্রটি আবিষ্কারের ফলেই সময়ের বিবর্তনে আজকের এই ন্যানোটেকনোলজি।
ন্যানোটেকনোলজি (Nanotechnology) কি?
এক মিটারের একশো কোটি (১০-৯) ভাগের এক ভাগ হচ্ছে এক ন্যানো মিটার। এই মাপের ক্ষুদ্র বস্তু নিয়ে কাজ করে যে প্রযুক্তি তাকে ন্যানোটেকনোলোজি বলে। স্কেল অনুযায়ী ১ থেকে ১০০ ন্যানোমিটার সাইজের পদার্থ নিয়েই ন্যানোবিজ্ঞানের কাজ কারবার।
মূলত অনু এবং পরমানুকে প্রযুক্তিখাতে ব্যবহার করে বিভিন্নরকম ক্ষুদ্র ও সুক্ষ যন্ত্র তৈরি এবং তার মাধ্যমে আরও উন্নতমানের উৎপাদিত বস্তু তৈরি করা এর মুল উদ্দেশ্য। এই প্রযুক্তির প্রথমে এরোসল তৈরিতে ব্যবহার হলেও এখন তা ব্যবহার হচ্ছে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় এবং তা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বৈজ্ঞানিকরা ভাবছেন আগামী ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে মানুষের কোষের মতো স্বয়ংসম্পূর্ণ একটা যন্ত্র উৎপাদন করা সম্ভব হবে এই টেকনোলজি ব্যাবহার করে যা নিজে নিজেই কাঁচামাল থেকে কেবল শুধু কাঙ্খিত বস্তু উৎপাদনই করবে না বরং এক কোষ যেমন অন্য কোষ জন্ম নেয়, তেমনিভাবে একটা যন্ত্র থেকে আরও যন্ত্র স্বয়ংক্রিয় ভাবে উৎপাদন করতে পারবে।
অদূর ভবিষ্যতে আমরা একটা বিপ্লব দেখতে পাবো বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায়, নতুন নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে উঠবে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে যা সারা বিশ্বের উৎপাদন, বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক ব্যাবস্থাপনায় ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারে। গায়ের জোরের থেকে মেধার জোরই হবে ক্ষমতার মুল উৎস।
ন্যানোটেকনোলজির ব্যবহারে উৎপাদন খরচ অনেক কমে যাবে, উন্নতমানের বস্তু আর পণ্য উৎপাদিত হবে, হয়ত লোহা থেকে সোনা-হীরে-মুক্তা-জহরত সবই উৎপাদন করা সম্ভব হবে। সময় নষ্ট না করে এখন আমাদের উচিৎ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই প্রযুক্তি আত্মস্থ করে ব্যবহার করতে শুরু করা।
ন্যানোটেকনোলজির ব্যবহার
বিজ্ঞানের সকল শাখায় ব্যবহৃত হচ্ছে ন্যানোটেকনোলজি, বিশেষ করে রসায়ন, পদার্থ বিদ্যা, ইলেক্ট্রনিক্স, বায়োটেকনোলজিত উল্লেখযোগ্য। আবার খাদ্য সংরক্ষন থেকে শুরু করে খাদ্য প্যাকেটজাতকরনেও ব্যবহৃত হচ্ছে এই টেকনোলজি। শুধুু যে খ্যাদ্য প্যাকেটজাত করনেই সীমাবদ্ধ থাকছে এই টেকনোলজি তা কিন্তু নয়! পরিবেশ দুষনের ঝুঁকি কমাতেও কাজ করছে এই টেকনোলজি।
ন্যানোটেকনোলজি ব্যবহার করে যে প্যাকেট প্রস্তুত করা হচ্ছে তার ভিতরে একদিকে যেমন গ্যাস, জলীয় পদার্থ, লবন ইত্যাদির সংযোজন-বিয়োজন যেমন হতে পারে না, আবার অন্যদিকে এসব প্যাকেট এমন ভাবে তৈরি করা হচ্ছে যা, সহজেই মাটির সাথে মিশে গিয়ে পরিবেশ দূষণ কমাতে সাহায্য করবে।
এছাড়াও বিভিন্ন যন্ত্রাংশের উপর স্থায়ী আবরন তৈরি করতে, বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট তৈরি করতে, বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী পরিবেশবান্ধব সোলার প্যানেল নির্মানেও ব্যবহৃত হচ্ছে এই টেকনোলোজি।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে ন্যানোটেকনোলজি
চিকিৎসা বিজ্ঞানের অনেক শাখায় বেশ আগেই ন্যানোটেকনোলজির ব্যবহার শুরু হয়েছে। বিভিন্ন রোগ নির্ণয় থেকে শুরু করে চিকিৎসা ব্যবস্থায়ও ন্যানোটেকনোলজির ব্যবহার ক্রমাগত বাড়ছে এবং বাড়বে সময়ের সাথে সাথে। একটা উদাহরন দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে সকলের কাছে।
ক্যান্সার নির্ণয় করতে আর চিকিৎসা দিতে কত কসরতই তো করতে হয়, কিন্তু সফলতা কতোটুকু? এখন যদি আমরা সিটি স্ক্যান, এম আর আই ইত্যাদি বাদ দিয়ে শুধুমাত্র একটা ইনজেকশন এর মাধ্যমে রোগটা ধরতে পারি তাহলে নিশ্চয় সবাই খুশিই হবেন।
আবার, যেসব ক্যান্সারের ভাল চিকিৎসা নেই সেগুলোতে ন্যানোটেকনোলজি ব্যবহার করা যেতে পারে, যাতে অধিকতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পন্ন ঔষধ কম মাত্রায় শুধুমত্র শরীরের ক্যান্সার আক্রান্ত স্থানেই ব্যবহার করা যায়। এর ফলে ক্যান্সার চিকিৎসায় অধিকতর ফল আশা করা যেতে পারে।
বিভিন্নপ্রকার এরোসল জাতীয় ঔষধ উৎপাদনে ন্যানোটেকনোলজির ব্যবহার বেশ আগে থেকেই আছে। তবে এখন চিকিৎসাবিজ্ঞানে ন্যানোটেকনোলজির সাহায্যে যে কাজগুলো করা হচ্ছে তা নিম্নরুপঃ
- সহজ উপায়ে রোগ নির্ণয়
- নির্ভুলভাবে এবং পরিমিত পরিমানে ঔষধ প্রয়োগ
- রোগের মাত্রা বুঝে স্বয়ংক্রিয় ভাবে ঔষধ প্রয়োগ
- ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিরুপন
- জীবাণু ঘটিত ইনফেকশনে এন্টিবায়োটিক এর কার্যকারিতা বৃদ্ধি
এমন একটা ক্ষুদ্র ক্যাপসুল যদি উৎপাদন করা সম্ভব হয় যা, মানুষের শরীরের চামড়ার নীচে বসিয়ে দিলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে রক্তের চিনির মাত্রা নিরুপন করতে পারবে এবং সেই অনুযায়ী প্রয়োজনমত ইনসুলিনও রোগীর শরীরে প্রয়োগ করতে পারবে। তবে একজন ডায়াবেটিক রোগীর জীবনযাপন অনেক সহজ হয়ে যাবে।
জীবাণুর বিরুদ্ধে এন্টিবায়োটিক এর কার্যকারিতা অনেকাংশেই নষ্ট হয়ে গেছে এর অপব্যাবহারের ফলে। জীবাণুর কোষের ভিতরে এন্টিবায়োটিক ঢুকতে পারেনা ফলে জীবাণুও মরে না। যদি ন্যানোটেকনোলজি ব্যবহার করে জীবাণুর কোষের ভিতরে প্রচলিত এন্টিবায়োটিক ঢোকানোর ব্যবস্থা করা যায় তবে জীবাণুকে সাধারণ এন্টিবায়োটিক দ্বারাই নির্মূল করা সম্ভব।
সম্পূর্ণ নতুন ধরনের একটা এন্টিবায়োটিক আবিষ্কার করতে লাগে ১০ বছর, আর এটাকে অকার্যকর করতে জীবাণুর সময় লাগে মাত্র ৫ বছর। ন্যানোটেকনোলজি ব্যবহার করতে না পারলে জীবাণুর কাছে পরাজিত হওয়া ছাড়া আমাদের কোন উপায় ছিলনা।
ঠিক তেমনই, অনেক ক্যান্সার আছে যার মধ্যে ঔষধ ঠিকমত ঢুকতে পারেনা, ফলে অধিক মাত্রায় ঔষধ প্রয়োগ করতে হয়। এর ফলে ক্যান্সারে মৃত্যুর আগেই ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ই অনেক রোগীর অকাল মৃত্যু হয়। ঔষধ প্রয়োগের এই নতুন পদ্ধতির মাধ্যমে কম মাত্রার ঔষধ ব্যবহার করা সম্ভব হবে যা, শুধু কান্সার আক্রান্ত কোষ ধ্বংস করবে স্বাভাবিক কোষের কোন ক্ষতি না করেই।
সাধারন পদ্ধতিতে ক্যান্সার এর ঔষধ যখন প্রয়োগ করা হয় তখন তা সারা শরীরে ছড়িয়ে পরে এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। ন্যানোটেকনোলজিতে সূক্ষ্ম ভাবে ঔষধ প্রয়োগ করার সাথে সাথে বাইরে থেকে বিদ্যুৎ- চৌম্বক তরঙ্গ অথবা আলোক রশ্মি প্রয়োগের মাধ্যমে শুধু কান্সার আক্রান্ত জায়গায় ঔষধকে কার্যকরী তোলা হয়। ফলে একদিকে কান্সার যেমন ধ্বংস হয়, অন্যদিকে স্বাভাবিক কোষগুলো ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়। ফলশ্রুতিতে রোগী সুস্থ হবার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়।
ন্যানোটেকনোলজি ও এর ভবিষ্যৎ
মাইক্রো চিপসের থেকে ন্যানোচিপস অনেক সুক্ষ এবং ত্রুটিমুক্ত। তবে তা কাজে লাগানোর জন্য কিভাবে তৈরি করা হবে তা নিয়ে ছিলো কিছুটা বিপত্তি। আর এই বিপত্তি থেকে উদ্ধার করেছে গ্রাফিন (Graphene)। গ্রাফিন হচ্ছে একধরনের ন্যানোপদার্থ যেখানে কার্বনের এক স্তর থেকে বহুস্তর বিশিষ্ট সীট, রজ্জু প্রস্তুত করা যায়।
ইলেকট্রনিক্সের বিভিন্ন কাজে এখন ব্যবহার করা হচ্ছে এই গ্রাফিন (Graphene)। গ্রাফিন ব্যবহারে ভবিষ্যতে সমস্ত ডিভাইসগুলো আরো হালকা ও ছোট আকারে হবে এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে গ্রাফিন যেমন দুষ্প্রাপ্য এর উৎপাদন পদ্ধিতিও খুব জটিল ও ব্যয়বহুল। আর এ কারনে কারণে গ্রাফিনের ব্যবহার এখনও পর্যন্ত সীমিত রয়েছে।
বিজ্ঞানের সব বিভাগেই ন্যানোটেকনোলজির ব্যবহার বাড়ছে, সামনের দিনে আরও একটা শিল্পবিপ্লব হয়তো আসতে চলেছে, আর সেটা হতে পারে ন্যানোটেকনোলজির হাত ধরে ’ন্যানোবিপ্লব’। বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার মত চিকিৎসা বিজ্ঞানেও বিপ্লব ঘটে যাবে ন্যানোটেকনোলজি ব্যবহারের ফলে, এখন শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা।