প্রাচীন কাল থেকেই আয়ু বৃদ্ধি (Longevity) এবং প্রকারান্তে অমরত্ব (Immortality) লাভের আশায় ঘুরেছে মানুষ, গীলগমেশের কাহিনী, গ্রীক, ভারতীয় বা চৈনিক উপকথাসমূহের ভিতর আমরা এর অনেক প্রমান পাই। তবে লক্ষনীয় বিষয় হলো অমরত্বের জন্য এখানে দেবতার আশীর্বাদের প্রয়োজন হয়েছে, কারন এখানে ধরেই নেওয়া হচ্ছে, অমরত্বে একচ্ছত্র অধিকার শুধুমাত্র দেবকুলের আর অন্য যা কিছু সৃষ্টি তার জন্য মৃত্যু অবধারিত।
’দ্বৈতবাদ’ আত্মা আর দেহকে আলাদা করে ফেলেছে, আত্মা অবিনশ্বর আর দেহ নশ্বর। আত্মার অবিনশ্বরতা দিয়ে অবচেতনভাবে একজাতীয় অমরত্বের আকাংখা আর আকুতি তার ভিতর ফুটে উঠেছে। এখন দার্শনিক আলোচনা বাদ দিয়ে পরবর্তী আলোচনায় মননিবেশ করাই হবে, বিজ্ঞান এখানে কি ভূমিকা নিচ্ছে মূলত তার উপর।
আয়ু বৃদ্ধি ও অমরত্ব সন্ধানে গবেষণা
এই মুহুর্তে অমরত্ব লাভ করা একটা অতিপ্রত্যাশা ছাড়া আর কিছুই নয়, তাই বিজ্ঞানের সমস্ত গবেষণাই এখন অনুবর্তিত হচ্ছে মুলত আয়ু বৃদ্ধি সম্পর্কিত। আর এখানে বিজ্ঞানের লক্ষ্য এখন শুধুমাত্র আয়ু বৃদ্ধিতেই সীমাবদ্ধ নয়। বিজ্ঞান এখন কাজ করছে মানুষের জীবনকে একটা বয়সের মধ্যে আটকে রাখতে।
যেখানে তার যৌবন, কর্মক্ষমতা, পরিপক্কতা, উৎপাদনশীলতা ইত্যাদি সবই বজায় থাকবে। তারপরেও একটা সমস্যা থেকেই যায়, তা হচ্ছে অভিযোজনের সমস্যা। আবহাওয়া, পরিবেশ আর প্রতিবেশের সঙ্গে ক্রমবিকাশমান যে অভিযোজন জন্ম আর মৃত্যুর মাধ্যমে হয় তার মুকাবিলা করা।
সেজন্য আগে থেকেই উপযুক্ত জেনেটিক, এপিজেনেটিক পরিবর্তন করে রাখা দরকার, এবং প্রয়োজনে তাকে যুগোপযোগী করে তোলা প্রয়োজন। এই প্রবন্ধে আমরা বিবেচনা করব, এ প্রসঙ্গে যেসব গবেষণা হচ্ছে সেটা নিয়ে।
আয়ু বৃদ্ধি গবেষণায় একবিংশ্ব শতাব্দীর লক্ষ্য
বিংশ্ব শতাব্দীতে চিকিৎসাবিজ্ঞানের লক্ষ্য ছিল প্রত্যেকটা রোগকে আলাদাভাবে সনাক্ত করে তার চিকিৎসা প্রদান করা, যার ফলশ্রুতিতে আয়ু বৃদ্ধি সম্ভব হয়েছে। আর একবিংশ্ব শতাব্দীর চিকিৎসা বিজ্ঞানে সমস্ত অবক্ষয়জনিত রোগের কারন নির্ধারণ করে তার চিকিৎসা করা হচেছ।
এক্ষেত্রে মুলত প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে বার্ধক্য এবং বিপাক জনিত রোগের মুল কারনের উপর। গবেষণা চলছে বিভিন্ন জেনেটিক এবং এপিজেনেটিক কারনসমুহ নির্ধারণ করে কিভাবে বার্ধক্য এবং বিপাক জনিত রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় সে বিষয়ে। আর এক্ষেত্রে যেসব বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে প্রধান হচ্ছেঃ
- সঠিক খাদ্যাভাস
- নিয়মিত ব্যায়াম এবং মেডিটেশন
- সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ এবং প্রতিকার করা
- ক্যান্সার প্রতিরোধ এবং প্রতিকার করা
- অবক্ষয় রোধ
- বার্ধক্যজনিত এবং বিপাকজনিত রোগের মূলোৎপাটন করন
- হরমোন জনিত রোগের চিকিৎসা করা
- দুর্ঘটনা প্রতিরোধ
- চিকিৎসার উন্নয়ন
- প্রবীণত্বের জন্য দায়ী জীনগুলোকে প্রতিরোধ করা
- নবীনত্বের জীনগুলোকে উৎসাহিত করা ইত্যাদি।
বর্তমানে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন সংগঠন যারা লগ্নি করছে আয়ু বৃদ্ধি সম্পর্কিত যাবতীয় গবেষণায়। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে আমেরিকা এবং ইউরোপের বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদের নিয়ে বোস্টনে গঠন গঠিত হয়েছে Academy for Health and Lifespan research । এরা প্রথমে ইস্ট ও কৃমির উপর রিসার্চ করে তাদের আয়ু বৃদ্ধি করতে পেরেছেন এবং আশা করছেন মানুষের আয়ুও তারা বাড়াতে পারবেন।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে যে মানুষের আয়ু বৃদ্ধি ঘটেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। যেখানে যুক্তরাস্ট্রে ১৯৫০ সালে মানুষের গড় আয়ু ছিল ৬৮ বছর, সেটা এখন বেড়ে হয়েছে ৭৭ বছর।
জাপানিজদের গড় আয়ু এখন ৯০ বছরের উর্ধে আর বাংলাদেশের গড় আয়ু এখন ৭০ বছরের সামান্য বেশী। পরিসংখ্যান বলছে আমেরিকানদের গড় আয়ু প্রতিবছর ১.৫ বছর করে বৃদ্ধি পাচ্ছে, এবং তাদের টার্গেট রয়েছে ২০৫০ সালের ভিতর এটাকে ১৫০ বছরে উন্নীত করার।
যোগাযোগ ক্ষেত্রে পরিবহণের উন্নয়নের সাথে সাথে যন্ত্রচালিত স্বয়ংক্রিয় যানের উন্নয়ন দুর্ঘটনার হার কমিয়ে মৃত্যু বা অঙ্গহানির হার কমিয়ে দেবে। তাছাড়া বিভিন্ন প্রকার আধা-যন্ত্র, আধা-জীবন্ত মানুষ সারা পৃথিবীতে বিচরন করে বেড়াবে।
অংগ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে হোমোগ্রাফট (মানুষ থেকে মানুষে প্রতিস্থাপন) ছাড়াও পিগ বা লোয়ার এনিম্যালের HLA Gene মানুষের জীন দ্বারা প্রতিস্থাপিত করে সেখান থেকে কিডনি, লিভার ইত্যাদি নিয়ে প্রতিস্থাপিতকরনের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
তাছাড়া Embryonic/Adult stem cell নিয়ে অংগ প্রতিস্থাপনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। হয়তো ভবিষ্যতে সব মানুষই একজাতীয় হাইব্রীড মানুষে পরিনত হবে। বিজ্ঞানের চোখে বার্ধক্যকে এখন একটা বয়সজনিত অসুবিধা না ভেবে একটা রোগ হিসাবে দেখা হচ্ছে, এবং যার চিকিৎসা সম্ভব।
আয়ু বৃদ্ধি গবেষণায় প্রাপ্ত বিভিন্ন পদ্ধতি
আয়ু বৃদ্ধি সম্পর্কিত গবেষণা বিজ্ঞানের একটি চলমান প্রক্রিয়া। দীর্ঘায়ুর জন্য মানুষকে সুস্থ্য রাখতে হবে, আর এই সুস্থ্য রাখার প্রচেষ্টাতেই সমৃদ্ধ হচ্ছে একবিংশ শতাব্দীর চিকিৎসা বিজ্ঞান। এছাড়া গবেষনা আরও বলছে পরিবর্তন করতে হবে মানুষের খাদ্যাভ্যাস ও জীবনধারণ পদ্ধতি।
আসুন আমরা সংক্ষিপ্ত আলোচনার মাধ্যমে উপস্থাপন করার চেষ্টা করি গবেষণাতে প্রাপ্ত আর কি কি পদ্ধতির আয়ু বৃদ্ধির জন্য কার্যকর।
জেনেটিক পদ্ধতি (Genetic reprogramming)
মানুষের দৈহিক কোষে রয়েছে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম। এদের ভিতর ২২ জোড়া অটোসোম, বাকী ২ জোড়া সেক্স ক্রোমোজম, পুরুষের ক্ষেত্রে XY, এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে XX । ডিম্বানু অথবা শুক্রানুর ভিতর রয়েছে ২২ টা অজোড়া ক্রোমোজোম, এবং X অথবা Y ক্রোমোজোম।
মাইটোকন্ড্রিয়ার ভিতরেও ক্রোমাটিন মেটেরিয়াল রয়েছে। আমরা মাইটোকন্ড্রিয়া সবসময় মায়ের দিক থেকে পেয়ে থাকি। বিবর্তনের তত্ত্ব অনুযায়ী এগুলো ব্যাকটেরিয়া থেকে প্রাপ্ত ক্রোমাটিন যা আমরা বংশ পরম্পরা হিসাবে উত্তরাধিকারসুত্রে পেয়ে আসছি।
ক্রোমোজোমের কার্যকরী অংশগুলোকে বলা হয় জীন (Gene), যারা প্রোটিন উৎপাদন করে থাকে। এগুলো আবার অনেকগুলো DNA দিয়ে তৈরী। এই জীনগুলির মধ্যে রয়েছে
- প্রোটো অনকোজীন
- এন্টী অনকো জীন
- রেগুলেটরী জীন
- রিপেয়ার মেকানিজমের জীন ইত্যাদি
এই সব জীনের বিভিন্ন ত্রুটি বা বিচ্যুতির কারনে জীনের কাজ বাধাগ্রস্থ হতে পারে। ফলে টেলোমার (ক্রোমোজোমের লেজের দিকের অংশ) ছোট হয়ে যায়। যার ফলে ক্যান্সার তৈরি থেকে শুরু করে বার্ধক্যজনিত রোগ দেখা দেয়।
আমরা জীন থেরাপির মাধ্যমে অসুস্থ জীনগুলোকে সারিয়ে তুলতে পারি। সেলুলার রিপ্রোগামিং করে অসুস্থ কোষকে পুনরায় সচল করে তুলতে পারি।
ইয়ামানাকা ফ্যাক্টর সেলুলার রিপ্রোগামিং এর ক্ষেত্রে বড় ভুমিকা পালন করতে পারে। এছাড়াও বিভিন্ন রকম নিউট্রিশনাল সাবস্ট্যান্স সরবরাহ করে কোষগুলিকে পুনর্জীবিত করা সম্ভব।
হেফ্লিক লিমিট (Hayflick limit)
স্বাভাবিক অবস্থায় মানবদেহের কোষগুলির মধ্যে বিভক্ত হওয়ার একটা সীমারেখা থাকে। কোষগুলি ভাগ হওয়ার সাথে সাথে তার টেলোমারও ছোট হতে থাকে। বয়সজনিত বিভিন্ন প্রকার বর্জ্য পদার্থ কোষের অভ্যন্তরে জমা হতে থাকে, ফলে কোষ পুনরায় আর বিভাজিত হতে পারে না। যার ফলে মানুষের আয়ু ১২৫ বছরের বেশী হতে পারে না।
উপরের তত্ত্বটির আবিষ্কারক লিওনার্দ হেফ্লিক এর নামানুসারে হেফ্লিক লিমিট বলা হয়ে থাকে। তবে পরবর্তী যত গবেষণা হয়েছে তাতে এই তত্ত্বটি ভুল প্রমানিত হয়েছে। এখন বিভিন্ন ধরনের ঔষধ ব্যবহারের মাধ্যমে এই হেফ্লিক লিমিটকে পরিবর্তিত করে আয়ু বৃদ্ধি করা সম্ভব। এইসব ঔষধের মধ্যে রয়েছে ইনসুলিন ২ রিসেপ্টর এন্টাগনিস্ট, মেটফরমিন, র্যাপামাইসিন জাতীয় ঔষধ। এগুলো সস্তা কিন্তু কার্যকর।
আয়ু বৃদ্ধির জন্য সামাজিক পরিবর্তন (Social change)
আয়ু বৃদ্ধি মানেই সুস্বাস্থ্য, আর সুস্বাস্থ্যের জন্য সামাজিক পরিবর্তন জরুরী। কারন সুস্বাস্থ্য শুধু রোগের অনুপস্থিতিই নয়, এটা মানুষের জন্য সম্পুর্ন সুখকর একটা অবস্থা। আর শোষন-বঞ্চনা মুক্ত একটা উত্তরোত্তর বিকাশমান সমাজই মানুষকে দিতে পারে এই সুখকর অবস্থা।
এখানে Paradigm shift এর একটা যায়গা রয়েছে যেখানে প্রত্যেক মানুষই তার মর্যাদা নিয়ে সুখকর একটি অবস্থার মধ্যে বেঁচে থাকতে পারবে।
লাইফস্টাইল পরিবর্তনে আয়ু বৃদ্ধি
জীবনাভ্যাস এবং জীবনাচরণ পরিবর্তনের মাধ্যমে দীর্ঘায়ু লাভ করা যায়। আপনি কি পছন্দ করছেন, কি খাচেছন, কি পান করছেন, কখন খাবর গ্রহন করছেন, কখন বিশ্রাম নিচেছন, কতক্ষন বিশ্রাম নিচেছন, কি ধরনের খাবার গ্রহন করছেন সবকিছুই আপনার লাইফস্টাইলেরই অংশ। আর এই লাইফস্টাল থেকে খারাপ বিষয়গুলোকে বাদ দেওয়া জরুরী।
আয়ু বৃদ্ধি করতে ফাস্টিং (Fasting)
অক্টোবর, ২০১৬ তে প্রায় ১,৩০,০০০ স্বাস্থ্য কর্মীর উপর পরীক্ষা করে একটা গবেষণা পত্র আমেরিকান জার্নালে প্রকাশিত হয়। এতে দেখা যায় উদ্ভিদজাত প্রোটিন বিভিন্ন হার্ট এবং রক্তনালীর রোগ থেকে সুরক্ষা দেয়। আর এর উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন আয়ু বৃদ্ধিকারী ডায়েট।
লিটারেচার খুঁজলে এরকম অনেক ডায়েটের খবর পাবেন, যা আপনার মাথাকে তালগোল পাকিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট। এগুলোর মধ্যে যা রয়েছেঃ
- নিম্ন ক্যালোরি যুক্ত খাবার
- নিম্ন প্রোটিনযুক্ত (বেশিরভাগটাই উদ্ভিদজাত প্রোটিন) খাবার
- দুধ এবং ননীমুক্ত খাবার
- উচ্চ মাত্রার আশযুক্ত খাবার
- ভিটামিন এবং মিনারেল সমৃদ্ধ খাবার
- একটা নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে মাঝে মাঝে উপবাস থাকা।
এছাড়া বিভিন্ন ধরনের টেকনিক নিয়েও আলোচনা রয়েছে, এবং এ টেকনিকগুলো নিয়ে বিভিন্ন গবেষণাপত্র ও প্রকাশিত হয়েছে। যা অনলাইনে খুজলেই পেয়ে যাবেন। যেমনঃ
- খাদ্য নিয়ন্ত্রন (Dietary restriction/Calorie restriction/Protein restriction),
- উপবাসের (Intermittent Fasting/Periodic Fasting)
তবে মোদ্দা কথা হল, আয়ু বৃদ্ধি করতে গেলে, আক্রান্ত এবং অপ্রয়োজনীয় কোষগুলোকে খাদ্যে পরিনত (Cellular Autophagy) করার জন্য যেটা প্রয়োজন, সেটা হচ্ছে মাঝে মাঝে ১২ থেকে ৪৮ ঘন্টার উপবাস (পানি খাওয়া সহযোগে/ ব্যাতিরেকে)।
যা আমাদের আক্রান্ত কোষগুলিকে নির্মুল করতে পারে। বিভিন্ন সমাজ ব্যবস্থায় বিভিন্ন প্রকারভেদে এই উপবাস প্রথা চালু রয়েছে, যেমনঃ
- ভারতীয় মুনি ঋষিদের উপবাস
- ইহুদিদের উপবাস (Yom Kippur, Tisha B Av etc.)
- খৃস্টানদের উপবাস (Partial fast/ Liquid fast/40 day Fast/ Fast from sex etc.)
- মুসলমানদের রোজা
- বৌদ্ধদের বুদ্ধ ডায়েট
এ সবগুলিই বিভিন্ন ধরনের ফাস্টিং বা উপবাসের ধরন। আপনার শরীর বুঝে উপবাস বা রোজা করতে পারেন। তবে কিডনী রোগীদের একনাগাড়ে ডিহাইড্রেশন ক্ষতিকর। তাছাড়া নির্জলা উপবাসের পর অতিভোজন অত্যন্ত ক্ষতিকর।
আয়ু বৃদ্ধি করতে ব্যায়াম (Exercise)
দীর্ঘজীবন লাভ বা আয়ুবৃদ্ধির জন্য যেসব গবেষণা হয়েছে তার অনেকগুলোতেই নাম এসেছে ডাঃ ভল্টার লংগো ( Dr. Valter Longo is the Edna M. Jones Professor of Gerontology and Biological Sciences, and director of the Longevity Institute at the University of Southern California – Davis School of Gerontology, Los Angeles) এর নাম।
ডাঃ ভল্টার লংগো যা বলেছেন তা সাধারনভাবে বলতে গেলে প্রতিদিন ১ ঘণ্টা জোরে হাঁটা, সপ্তাহে ৯-১০ ঘন্টা হাঁটা, মাঝে মাঝে সাঁতার কাটা বা সাইক্লিং করা, শরীরভেদে হালকা এরোবিক/ এনেরোবিক/ যোগব্যায়াম করা এবং তারসাথে মেডিটেশন করা আপনাকে সুস্থ এবং দীর্ঘ জীবন দেবে।
বার্ধক্য এবং বিপাকজনিত অসূখ নিয়ন্ত্রণে ঘটবে আয়ু বৃদ্ধি (Controlling geriatric, degenerative and Metabolic diseases)
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তালিকায় বার্ধক্য এখন একটা রোগ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এবং যার চিকিৎসাও সম্ভব। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, গেঁটে বাত, হার্ট, মস্তিষ্ক বা হাত পায়ের রক্তনালী ব্লক হয়ে যাওয়া, বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেমন কিডনী, চক্ষু ইত্যাদি আক্রান্ত হওয়া, রক্তে খারাপ চর্বির মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া মুলত একটা সমস্যারই বিভিন্ন প্রকাশ।
এখানে আমাদের ম্যাজিক ড্রাগ হচ্ছে স্টাটিন জাতীয় ঔষধ যা একই সঙ্গে সব সমস্যাগুলোকে সারিয়ে তুলতে পারে। এর সঙ্গে অন্যান্য চিকিৎসা তো অবশ্যই চলবে। বার্ধক্য আর বিপাকজনিত সমস্যার চিকিৎসায় এরকম আরো বিভিন্ন ধরনের ঔষধ আবিষ্কারের চেস্টা চলছে, যা মূলত বার্ধক্যের মূলে যে কারন তা সমাধান করবে।
এ ব্যাপারে মেটফরমিন (Metformine) এবং নিকোটিনামাইড মনোনিউক্লিওটাইড (Nicotinamide Mononucleotide, NMN) নিয়ে গবেষণা চলছে, বিশেষ করে ন্যানোটেকনোলজি ব্যবহার করে এর ব্যবহার নিরাপদ এবং কার্যকর করার গবেষণা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন ধরনের এন্টি-অক্সিডেন্ট, প্রাকৃতিক উপাদান (RTB 101) ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা।
আয়ু বৃদ্ধি -র জন্য সার্জারীর ভূমিকা (Role of Surgery)
সার্জারী এখন শুধু কাটা আর সেলাই দেওয়ার ভিতরেই সীমাবদ্ধ নেই। বিভিন্ন ধরনের এন্ডোস্কোপি, রবোটিক, গামা নাইফের মাধ্যমে কম টিস্যু নষ্ট করে যেসব সার্জারী আগে করা অসম্ভব ছিল, সেগুলো নিরাপদে করা সম্ভব হচ্ছে। মেডিক্যাল সায়েন্স এখন একটা টীম এপ্রোচ, বিভিন্ন বিভাগের বিশেষজ্ঞগণ একসাথে কাজ করেন সর্বোচ্চ সুফল পাওয়ার জন্য।
আয়ু বৃদ্ধি কার্যক্রমে ট্রান্সপ্লান্টেশন, প্রস্থেসিস বা ইমপ্লান্ট লাগানো, বিভিন্ন ধরনের ইন্টারভেনশন, কেমোপোর্ট বসানোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ন। রেডিওলোজী, নিউক্লিয়ার মেডিসিন রোগ নির্ণয়ে এবং চিকিৎসাই গুরুত্বপুর্ন ভুমিকা রেখে চলেছে।
বদভ্যাস এবং স্ট্রেস ত্যাগে ঘটবে আয়ু বৃদ্ধি (Avoidance of Stress and bad habits)
দীর্ঘায়ু বা আয়ু বৃদ্ধির জন্য অন্তরায় হিসাবে কাজ করে ধূমপান, তামাকজাতীয় পদার্থ গ্রহন এগুলো থেকে দুরে থাকতে হবে। অতিরিক্ত এলকোহল গ্রহন এবং সবধরনের নেশাযুক্ত ড্রাগ পরিহার করা অবশ্য কর্তব্য। এছাড়াও অতিরিক্ত মানসিক চাপ হতে পারে এমন কিছু থেকে সবসময় দুরে থাকতে হবে এবং প্রতিদিন পর্যাপ্ত ঘুমের জন্য সবধরনের ব্যবস্থা করতে হবে।
ক্র্যায়োজেনিক স্লিপ (Cryogenic sleep)
আজকের যেটা কল্পনা, আগামীকালের সেটা বাস্তবতা। শরীরকে খুব ঠান্ডায় রেখে বিপাক প্রক্রিয়া শুন্যে নামিয়ে আনা হয় এবং এই অবস্থায় গভীর ঘুমে রেখে আবার নিদৃষ্ট সময় পরে জাগিয়ে তোলা হয়। এ ক্ষেত্রে নাসার গবেষণা যদি সফলতা পায় তবে মহাকাশ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এটা হবে একটি যুগান্তকারী ঘটনা।
যদিও এটা শুধুমাত্র সায়েন্স ফিকশন এর ভিতরেই এখনও পর্যন্ত সীমাবদ্ধ, তবে বাস্তবে এই পদ্ধতিটি নিয়ে বিস্তর গবেষণা চলছে। তবে লাইন দেওয়া শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকেই! এখন পর্যন্ত প্রায় ৪০০ টি শরীর এভাবে ক্রায়োজেনিক স্লিপে রাখা হয়েছে, যারা সকলেই কোন না কোন অপ্রতিকারযোগ্য রোগে আক্রান্ত ছিলেন। সকলেরই আশা, যখন রোগগুলোর চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার হবে তখন শরীরগুলোকে আবার জাগিয়ে তুলে ঐসব রোগের চিকিৎসা করা হবে।
ক্রায়োপ্রিজারভেশন টেকনিকের মাধ্যমে হার্টের ভাল্ভ বা মূল ধমনী সংরক্ষন করা যায়, এখানে তরল ক্রায়োপ্রিজারভেশন টেকনিকে তরল নাইট্রোজেনকে -৬০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ব্যবহার করে হার্টের ভাল্ভ বা মূল ধমনী সংরক্ষন করা যায়। যা পরবর্তীতে চিকিৎসা প্রযোজনে বা সংযোজনের কাজে ব্যবহার করা যায় এবং এটা আমাদের দেশেও হচ্ছে।
মেমরী প্রিজারভেশন (Brain & Memory preservation)
আমাদের দেহকে সংরক্ষণ না করা গেলেও আমাদের ব্রেনের যাবতীয় কার্যক্রম কম্পিউটার মেমরিতে সংরক্ষন করা সম্ভব। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্ত্বা ব্যবহার করে সেই মেমোরি থেকে বৈজ্ঞানিক সমাধান খুঁজে পাওয়া সম্ভব। এখন চেষ্টা করা হচ্ছে ব্রেন সংরক্ষন করার, ক্রায়োবায়োলজী এখন অনেকদুর এগিয়ে গেছে।
ব্রেনকে ঠান্ডা করে, অতিনিম্ন তাপমাত্রায় তাকে সংরক্ষন করা যায়, মেমোরি অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য আল্ডিহাইড (Glutaraldehyde) ব্যবহার করা যায়, তবে এখনও এ বিষয়ে বিস্তর গবেষনা চলমান।
আয়ু বৃদ্ধি ও অমরত্ব সন্ধানের বাজার মুল্য
আয়ু বৃদ্ধি ও অমরত্ব সম্পর্কিত গবেষনার বাজার এখন পর্যন্ত প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলারের মত। সুতরাং এখানে প্রকৃত বিজ্ঞান আর নকল বিজ্ঞানের লড়াই চলছে বাজার দখলের উপর। নকল বিজ্ঞান মূলত নির্ভর করছে গালভরা, চটকদার বিজ্ঞাপনের উপর। সুতরাং এখানে প্রকৃত তথ্য খুজে বের করতে গেলে ৩৬৫০ বিশ্লেষনের প্রয়োজন হবে। ডামাডোলে আক্রান্ত না হয়ে প্রকৃত তথ্য বের করে, যাচাই-বাছাই করে তারপর সেটাকে অনুসরণ করুন।
আয়ু বৃদ্ধি ও অমরত্ব সন্ধান এবং এর বাস্তবতা
বিজ্ঞান থেমে নেই, আয়ু বৃদ্ধি সম্পর্কিত গবেষনার পাশাপাশি অমরত্ত্ব নিয়েও গবেষনা শুরু হয়েছে এবং চলছে। পরীক্ষাগারে নিম্নশ্রেনীর প্রানী যেমন হাইড্রার উপর সফলতাও এসেছে। তবে মানুষের ক্ষেত্রে এখনও এ গবেষনাটি প্রয়োগ করা হয়নি।
মানুষের উপর অমরত্ব নিয়ে গবেষনা করতে হলে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে যেমনঃ অমরত্ত্বের সংজ্ঞা নির্ধারণ, ফিলোসফিক্যাল, ধর্মীয় ও এথিক্যাল বিষয় ইত্যাদি। তাই আগে মানুষের জন্য দীর্ঘ, কর্মক্ষম, নিরোগ, সুখময় জীবন লাভের প্রত্যাশাই হোক মুখ্য বিষয়, তার পরে না হয় অমরত্ত্ব নিয়ে ভাবা যাবে।
রেফারেন্সঃ কিছু রেফারেন্স নীচে দেওয়া হয়েছে, আগ্রহী পাঠক পড়ে দেখতে পারেন।
- Song M, Fung TT, Hu FB, et al. Association of animal and plant protein intake with all-cause and cause-specific mortality. JAMA Intern Med. 2016;176(10):1453–1463. doi:10.1001/jamainternmed.2016.4182
- Nature Aging | VOL 1 | JanuarY 2021 | 47–59 | www.nature.com/nataging
- What exercise is best for longevity? – Blue Zones
- The Brain Preservation Foundation
- JTF_Immortality_fnl.pdf (templeton.org)
- Anti-aging research: ‘Prime time for an impact on the globe’ – Harvard Gazette