জাপানি বিজ্ঞানী ইউশিনোরি ওশুমি (Yoshinori Ohsumi) অটোফেজি (Autophagy) নিয়ে গবেষণা করে নোবেল পুরষ্কার পান ২০১৬ সালে। এর পরে থেকেই বিজ্ঞানের অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত বিষয় অটোফেজি এবং ফাস্টিং (Fasting) নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।
বিজ্ঞানী ইউশিনোরি ওশুমি দেখিয়েছেন, কিভাবে শরীরের কোষগুলো নিজেরাই নিজেদের বর্জ্য বা আবর্জনাগুলোকে আটকে ফেলে। এবং সেখান থেকে ভাল উপাদানগুলোকে ছেঁকে আলাদা করে সেগুলো দিয়ে শক্তি উৎপাদন করে অথবা নতুন কোষের জন্ম দেয়।
পরবর্তীতে গবেষণা শুরু হয় কিভাবে অটোফেজি প্রক্রিয়াটেকে ত্বরান্বিত করা যায়। তবে এখনও পর্যন্ত ফাস্টিং বা উপবাস, ডায়েটিং এবং ব্যায়াম শরীরে অটোফেজি প্রক্রিয়া কে সচল কারার অন্যতম উপায়।
এই আলোচনার মাধ্যমে আমরা জানার চেষ্টা করবো ফাস্টিং কিভাবে অটোফেজি প্রক্রিয়াকে সচল করে শরীর কে সুস্থ্য রাখতে সাহায্য করে।
অটোফেজি (Autophagy) প্রক্রিয়াটি কি?
শরীরের কোষগুলো বিশেষ একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিজেই নিজেদের অংশবিশেষ খেয়ে ফেলে যাকে বলা হয় অটোফেজি। অটোফেজি (Autophagy or Autophagocytosis) শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ ‘অটো’ ও ‘ফাজেইন’ থেকে।
যার বাংলা অর্থ দাড়ায় ’আত্ম ভক্ষণ’ বা আরো সহজ করে বললে ’নিজেকে খেয়ে ফেলা’। কি উদ্ভট আর ভয়ানক কথা না? তবে, বিষয়টি শুনতে উদ্ভট বা ভয়ানক যাই হোক না কেনো শরীরের জন্য এটা কিন্তু খুবই উপকারী একটি বিষয়।
আমাদের শরীরের কোষগুলো একেক সময় ক্ষয়ে যায়। কোষের সেই ক্ষয়প্রাপ্ত অংশ বা বর্জ্যকে আবার ব্যবহারের উপযোগী করা সম্ভব অটোফেজি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। বিষয়টি এভাবে ব্যাক্ষা করা যায়; যখন আপনি দীর্ঘক্ষন খাওয়া বন্ধ করে দেন, তখন দেহের কোষগুলো বাইরে থেকে আর কোনও খাবার পায় না।
ফলে বাইরে থেকে খাবার না পেয়ে কোষগুলো নিজেরাই নিজের রোগজীবাণু সৃষ্টিকারী কোষ ও বর্জ্য-আবর্জনা খেতে শুরু করে। তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে অব্যাবহারযোগ্য ও ক্ষয়প্রাপ্ত কোষগুলোকে শুধু খেয়েই ফেলে তা নয়। তারা আবার নতুন কোষও তৈরি করে।
অটোফেজি প্রক্রিয়ার জন্য ফাস্টিং
বর্তমান সময়ে ফাস্টিং (Fasting) একটি ব্যাপক প্রচলিত শব্দ, যাকে বাংলায় বলে না খেয়ে থাকা, উপবাস বা উপাস। সাধারণত নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সব ধরনের খাবার গ্রাহণ করা থেকে বিরত থাকাকে ফাস্টিং বা উপবাস বলে। আর ফাস্টিং মানব শরীরে অটোফেজি প্রক্রিয়াকে পরিচারিত করার জন্য অন্যতম কার্যকারী পদ্ধতি।
আরো সহজ করে যদি বলি; শরীরকে অটোফেজি পর্যায়ে পৌছে দিতে হলে একটি নির্দিষ্ট সময় আপনাকে না খেয়ে থাকতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো যে, এই নির্দিষ্ট সময় কতক্ষন বা কতক্ষন না খেয়ে থাকলে অটোফেজি প্রক্রিয়া শরীরে শুরু হবে? বিজ্ঞানীরা এই সঠিক সময়টা জানতে এখনও গবেষণা চলিয়ে যাচেছন। তবে এখন পর্যন্ত যা জানা সম্ভব হয়েছে তা নিম্নরুপঃ
- ১২ ঘন্টা না খেয়ে থাকলে আপনি কিটোসিস (Ketosis) নামক মেটাবলিক ধাপে প্রবেশ করবেন, যেখানে আপনার শরীরের চর্বি ক্ষয় হতে থাকবে।
- ১৮ ঘন্টা শরীরকে কোন খাবার না দিলে আরো বেশি চর্বি ক্ষয় হবে এবং রক্তে কিটোনের পরিমান বেড়ে যাবে।
- ২৪ ঘন্টা একটানা খাবার গ্রহন না করলে শরীরের পুরাতন কোষগুলো ভাঙতে শুরু করবে। ফলে অপ্রয়োজনীয় প্রটিন ক্ষয় হয়ে নতুন কোষ গঠন করতে থাকবে। অর্থাৎ এই পর্যায়ে এসে আপনার শরীরে অটোফেজি শুরু হবে।
- ৪৮ ঘন্টার ফাস্টিং আপনার গ্রোথ হরমোন লেভেল ৫গুন বৃদ্ধি পাবে, যার ফলে আপনার শরীরের মাসল শক্ত হতে থাকবে।
- ৫৪ ঘন্টার ফাস্টিং এ আপনার ইনসুলিন লেভেল একেবারে নেমে আসবে ফলে ডায়াবেটিস থেকে বাচতে পারবেন।
- ৭২ ঘন্টা একটানা না খেয়ে থাকলে আপনার ভাল অথচ বৃদ্ধ কোষগুলো ধ্বংশ হবে এবং নতুন কোষ উৎপন্ন হবে।
প্রতিটি মানুষ বা মনবদেহ যেমন আলাদা, আলাদা তাদের অভ্যাস, আলাদা জীবনধারণ পদ্ধতি এবং আলাদা শারীরিক সমস্যাগুলোও। তাই ব্যক্তিভেদে ফাস্টিং সময়ের সাথে অটোফেজি প্রক্রিয়া শুরুর সময়ের তারতম্য হতে পারে। তাই মনবদেহের এই সমস্ত অবস্থা বিবেচনায় রেখে ফাস্টিং সময়কাল ও পদ্ধিতি নির্ধারিত হয়।
ফাস্টিং কত ধরনের?
শরীরকে সুস্থ্য ও কর্মক্ষম রাখতে অটোফেজি একটি কার্যকারী পদ্ধতি। এর জন্য প্রয়োজন ১৩ থেকে ৪৮ ঘন্টার উপবাস বা ফাস্টিং। যা, আমাদের শরীরের আক্রান্ত কোষগুলিকে নির্মুল করে শরীর কে সুস্থ্য রাখতে সাহায্য করতে পারে। প্রাচীন কাল থেকে এখন পর্যন্ত ফাস্টিংয়ের যে পদ্ধতিগুলো প্রচলিত রয়েছে সেগুলো নিয়ে নিচে সংক্ষিপ্ত আকারে আলোচনা করা হয়েছে।
থেরাপিউটিক ফাস্টিং (Therapeutic fasting)
থেরাপিউটিক ফাস্টিংয়ের ব্যাপক প্রয়োগ হয়ে থাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানেরই একটি শাখা ন্যাচারোপ্যাথি মেডিসিন এ। এখানে চিকিৎসার অংশ হিসেবে থেরাপিউটিক ফাস্টিং বা ফাস্টিং থেরাপি চালু রয়েছে । ফাস্টিং থেরাপিকে ব্যবহার করা হয়ে থাকে শরীর থেকে দূষিত বর্জ্য বের করে দেওয়া এবং শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কার্যক্ষমতাকে বাড়িয়ে তোলার জন্য।
জুস ফাস্টিং
শুধুমাত্র ফল ও শাকসবজির তরল নির্যাস বা রস পান করে ফাস্টিং করাকে জুস ফাস্টিং বলা হয়ে থাকে। এই ধরনের ফাস্টিং চলতে পারে অবস্থা বুঝে ৩ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত। এক্ষেত্রে শারীরিক সমস্যার ধরন অনুযায়ী ফল, সবজী, ভেষজ বা খাদ্যদ্রব্য নির্বাচন করতে হবে। কারন শরীরের বিভিন্ন সমস্যা বা প্রয়োজনের জন্য বিভিন্ন খাবার ভিন্ন ভিন্ন কাজে লাগে।
এবার নির্ধারিত ফল, সবজি অথবা খাদ্যদ্রব্য থেকে নিঃসৃত টাকটা ও সতেজ নির্যাস সংগ্রহ করে নিচের তালিকার নিয়ম অনুযায়ী পান করতে থকাুন। তবে মনে রাখবেন এই ফাস্টিংয়ে কোন রকম ভাবেই প্যাকেটজাত বা প্রিজারভেটিভ সমৃদ্ধ খাবারের নির্যাস ব্যবহার করা যাবেনা। আর শুরু করার আগে অবশ্যই কোন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেবেন।
জুস ফাস্টিংয়ের একটি নমুনা তালিকাঃ
মিল (Meal) | সময় (Time) | জুস (Juice) |
ব্রেকফাস্ট | সকাল ৮-৯ টা | প্রয়োজন অনুযায়ী |
স্ন্যাক টাইম I | সকাল ১০-১১ টা | প্রয়োজন অনুযায়ী |
লাঞ্চ | বেলা ১২-১ টা | প্রয়োজন অনুযায়ী |
স্ন্যাক টাইম II | দুপুর ২:৩০-৩:৩০ টা | প্রয়োজন অনুযায়ী |
স্ন্যাক টাইম III | বিকাল ৪:৩০-৫:৩০ টা | প্রয়োজন অনুযায়ী |
ডিনার | সন্ধ্যা ৬:৩০টা-৭:৩০টা | প্রয়োজন অনুযায়ী |
স্ন্যাক টাইম IV | রাত ৮-৯ টা | প্রয়োজন অনুযায়ী |
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং (Intermittent fasting)
বর্তমান সময়ে সবথেকে জনপ্রিয় ও আলাচিত হচ্ছে ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং বা সবিরাম উপবাস। এই পদ্ধতিতে প্রথমে দিনের ষোল ঘন্টা খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হয়। এর পরে আট ঘন্টা অন্তর খাবার গ্রহণ করার প্রয়োজন হয়।
তবে ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং এর ক্ষেত্রে এর সঠিক প্রয়োগ খুবই গুরুত্বপূর্ন। কেননা, সঠিক নিয়ম অনুযায়ী ফাস্টিং এর সাথে অনুশীলন না করলে উপকারের চেয়ে অপকারের ঝুঁকি অনেক বেশি থেকে যায়।
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং পদ্ধতির ইতিহাস প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পুরনো। প্রাচীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্র অনুসারে আমাদের শরীর ৩টি উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত, যথাঃ
- বায়ু
- পিত্ত ও
- কফ
তাই ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং পদ্ধতি শুরু করার আগে ব্যক্তির শরীরে এই ধাতুগুলোর ভারসাম্য নিশ্চিত হওয়াটা জরুরী। কারনঃ
- শরীরে কফের আধিক্য থাকলে আপনি ষোল ঘন্টা বা তার বেশি সময় ফাস্টিং করবেন। কারন হিসাবে বলা হয় কফের আধিক্যের কারনে খাবার ধীরে হজম হয়।
- আবার যার শরীরে বায়ুর আধক্য তাদের ক্ষেত্রে ১৪ ঘন্টা বা তার কম সময় ফাস্টিং উচিত। কারণ হিসাবে বলা হয় শরীরে বায়ুর প্রভাব বেশি হলে অধিক সময় পেট খালি থেকে গ্যাস তৈরি হয়ে কষ্ট পেতে পারন।
- আর শরীরে পিত্ত যাদের বেশি তদের হজম খুব দ্রুত হওয়ায় ষোল ঘন্টার ফাস্টিং যর্থাথ। তবে যাই করুন ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং এর ক্ষেত্র অবশ্যই বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করে তারপর ফাস্টিং শুরু করুন।
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিংয়ের একটি নমুনা তালিকাঃ
মিল (Meal) | সময় (Time) | খাবার ধরণ | ক্যালোরি গ্রহণ |
ঘুম থেকে উঠে | সকাল ০৭:০০ টা | অল্প গরম লেবু পানি অথবা ভিনেগার পানি | ০ ক্যলরি |
সকালের নাস্তা | সকাল ০৮:০০ টা | ব্ল্যাক কফি বা হারবাল চা | ০ ক্যলরি |
দুপুরের খাবার | দুপুর ১২:০০ টা | প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবারের সাথে সবজি অথবা সালাদ | ৭৫০ ক্যালোরি |
স্ন্যাকস্ | বিকাল ০৩:০০ টা | ড্রাই ফুটস্ যেমন এক মুঠো বাদাম বা ইয়োগার্ট | ৫০০ ক্যালোরি |
রাতের খাবার | সন্ধা ০৭:০০ টা | প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবারের সাথে সবজি অথবা সালাদ | ৭৫০ ক্যালোরি |
ঘুমানোর সময় | রাত্র ১০:০০ টা | নরমাল পানি বা হারবাল পানীয় | ০ ক্যলরি |
ধর্মীয় ফাস্টিং
ইসলাম ধর্মের ক্ষেত্রে আরবি মাসের চাঁদের হিসাব অনুযায়ী মুসলিমরা এক মাস রোজা রাখেন। চান্দ্রমাসের হিসাব অনুযায়ী প্রতি মাসে হিন্দুরা উপবাস বা উপাস পালন করেন, বৌদ্ধ্যরা পালন করেন বুদ্ধ ডায়েট। আবার খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা বছরে চল্লিশ দিন ফাস্টিং করে থাকে।
তো দেখা যায়, সব ধর্মেই মুলত ফাস্টিং করার প্রথা চালু রয়েছে। এখানে মানুষ স্রষ্টার নৈকট্য পাবার জন্য নিজ নিজ ধর্মের নিয়ম অনুযায়ী ফাস্টিং করে থাকেন।
ড্রাই ফাস্টিং
ড্রাই ফাস্টিং শুরু হয় মধ্যরাতে খাবারের পরে এবং শেষ হয় পরের দিন সূর্য অস্ত যাওয়ার সময় খাবার গ্রহনের মাধ্যমে। অর্থাৎ সূর্য উদয়ের আগে থেকে সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত যে কোন ধরনের খাবার (শক্ত এবং তরল) গ্রহন থেকে বিরত থাকাকে ড্রাই ফাস্টিং বলে।
সপ্তাহে এক অথবা দুইদিন, মাসে সাত অথবা পনেরদিন এবং একমাস থেকে চল্লিশ দিন পর্যন্ত ড্রাই ফাস্টিং করা যেতে পারে। ইসলাম ধর্মে রমাজানের এক মাস রোজা পালন ড্রাই ফাস্টিংয়ের নিয়মের মধ্যেই পড়ে। তবে যথাযথ স্বাস্থ্য সুফল পেতে হলে থেরাপিউটিক নিয়ম অনুসরন করাটা জরুরী।
রোজার মাসে সাধারণত আমরা ভাত, মাছ, মাংসসহ ভারী খাবার দিয়ে সেহেরী করে রোজা রাখি এবং দিন শেষে নানান রকম ভাজাপোড়া, প্যাকেটজাত খাবার দিয়ে ইফতার সম্পন্ন করি যা উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি হয়।
খাবার নির্বাচন ড্রাই ফাস্টিং করার জন্য গুরুত্বপূর্ন একটি বিষয় । ভিটামিন, মিনারেলস্, প্রোটিন, উপকারী ফ্যাট এবং আঁশজাতীয় খাবার খেতে হবে। শর্করা জাতীয় খাবার যতটা এড়িয়ে চল যায় ততটাই ভাল। নিয়ম অনুযায়ী তরল বা পানীয় খাবার গ্রহন করতে হবে যাতে, শরীর পানিশূন্য হওয়ার ঝুঁকিতে না পড়ে।
ওয়াটার ফাস্টিং
নাম শুনেই হয়তো বুঝতে পারছেন ওয়াটার ফাস্ট পদ্ধতি কি হতে পারে। ওয়াটার ফাস্টে আপনি শুধুমাত্র পানি ছাড়া অন্য কোন খাবার খেতে পারবেন না। পানি বলতে শুধুমাত্র সাধারণ পানি। কোন প্রকার চা বা কফি নয়, কোন প্রকার জুস বা ফলের রসও না। না কোন প্রকারের শক্ত খাবার।
সাধারণত ২৪ ঘন্টা থেকে ৭২ ঘন্টা পর্যন্ত ওয়াটার ফাষ্ট চলতে পারে। তবে চিকিৎসকের তত্বাবধানে আপনি ওয়াটার ফাষ্ট করতে পারেন একটানা ৪০ দিন পর্যন্ত। মনে রাখবেন, সেক্ষেত্রে আপনাকে অবশ্যই একজন চিকিৎসকের পরামর্শ ও তত্ববধানেই তা করতে হবে।
ফাস্টিংয়ের উপকারিতা
ফাস্টিং নিয়ে এখনও গবেষণা চলমান, তাই শেষ কথা বলার সময় এখনও আসেনি। তবে এ পর্যন্ত গবেষণা এবং প্রয়োগে যে ফল পাওয়া যাচেছ তা ইতিবাচক। আসুন আমরা সংক্ষিপ্ত আলোচনার মাধ্যমে জানার চেষ্টা করি ফাস্টিং করার উপকারিতাগুলো।
শরীর পরিচ্ছন্ন করা (Detoxification)
ফাস্টিং শরীরের অতিরিক্ত জমে থাকা পানি ও চর্বি এবং দূষিত পদার্থ ঘামের সাথে শরীর থেকে বেরিয়ে আসে। যার ফলে আপনার শরীর নতুনভাবে গড়ে ওঠার সুযোগ পায়। শরীরের রক্ত পরিষ্কার হবে এবং হজম প্রক্রিয়া শক্তিশালী হবে। অটোফেজি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শরীরের সমস্ত কোষগুলো রিকোভারী হয়ে নবজীবন লাভ করে। এর পলে আপনার শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কার্যক্ষমতা বেড়ে যাবে।
বিপাক প্রক্রিয়ার ভারসাম্য (Metabolic Balance)
ফাস্টিং চলাকালিন সময়ে পাকস্থলিতে কোন খাবার না যাওয়াতে এ সময় শরীরের হজম প্রক্রিয়া বিশ্রাম করার সুযোগ পায়। এই সময়ের মধ্যে পাকস্থলির হজম ব্যবস্থায় জমে থাকা বর্জ্য, গ্যাস, এসিড পরিষ্কার হয়ে নতুনভাবে কাজ কার জন্য তৈরি হয়। ফলে যারা ফাস্টিং করেন তাদের পাকস্থলী সংক্রান্ত অসুখ বিসুখ ভালো হয়ে যায়।
রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা (Immune system)
শ্বেত রক্তকণিকার (White blood cell or Leucocytes) মাধ্যমে আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হয়। শরীরের এই রক্তকনিকাগুলো ফাস্টিং চলাকালিন সময়ে পরিষ্কার এবং পুনরুজ্জীবিত হওয়ার সুযোগ পায়। ফলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা আরো কার্যকরী হয়ে ওঠে।
উপবাস চলাকালীন সময় শরীরের শ্বেত রক্তকণিকা, লোহিত রক্তকনিকা (Red Blood Cell) এবং প্লেটলেটস (Platelet) কনিকাগুলো জমে থাকা বর্জ্য পদার্থগুলো ধ্বংস করে এবং পরিষ্কার করে নতুনভাবে গড়ে ওঠে। এবং নতুন নতুন স্টেম সেল (Stem cell) গঠনে সাহায্য করে।
যৌবন ধরে রাখতে সাহায্য করে
ফাস্টিংয়ের মাধ্যমে শরীরে চালু হয় অটোফেজী প্রক্রিয়া, যার ফলে শরীর থেকে দুষিত পদার্থ অপসারন হয়ে কোষগুলো নতুন করে প্রান ফিরে পায়, আবার তৈরি হয় নতুন কোষ। অক্সিডেটিভ ড্যামেজগুলো নিয়ন্ত্রণ হয় এবং নতুন কোলাজেন উৎপাদন হয়, ফলে আপনার ত্বক ফিরে পায় উজ্জলতা। তাই বার্ধক্য প্রতিরোধ করতে এবং যৌবন দীর্ঘায়িত করতে ফাস্টিং একটি গুরুত্বপূর্ন বিষয়।
মেদ বা স্থুলতা কমায় (Reduces fat or obesity)
ফাস্টিং শরীর থেকে অপ্রয়োজনীয় চর্বি এবং কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে এবং আমাদের ক্ষুধা তৈরি করে যে হরমোন সেটা নিঃসরণে উপরে প্রভাব ফেলে ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এর ফলে শরীরে জমে থাকা চর্বি পুড়ে ওজন কমে শরীর হয়ে যায় স্লিম ও মেদবিহীন ও পরিমিত। সুস্বাস্থ্যের অধিকারি হতে যা খুবই গুরুত্বপূর্ন।
উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রন করে (Controls high blood pressure)
সঠিক পরিমাণে লবণ গ্রহন করতে হয় ফাস্টিং চলাকালীন সময়ে। এবং আমাদের শরীর এ সময় ঘাম এবং প্রস্রাবের মাধ্যমে জমে থাকা অতিরিক্ত সোডিয়াম বের করে দেয়। যা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা পালন করে।
হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়
উপবাসের ফলে শরীরের রক্ত এবং মাংসপেশীতে দিনে দিনে জমা হওয়া খারাপ কোলেস্টেরল এবং চর্বিগুলো ঝরে যায়। ফলে শরীরের রক্তনালীগুলো পরিষ্কার হয়ে ভালোভাবে রক্ত চলাচল করার সুযোগ পায়। যা অক্সিজেন সরবরাহ বাড়িয়ে হার্টের পেশিকে শক্ত করে হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে
ফাস্টিংয়ের ফলে আমাদের শরীর অতিরিক্ত এবং অপ্রয়োজনীয় খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকে। যা আমাদের শরীরে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে এবং টাইপ ২ ডায়বেটিস প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে।
মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি
বড়িয়ে নিতে চান বুদ্ধির ধার? সেই সঙ্গে স্মৃতিশক্তিও? যদি এমনটা চান তাহলে নিয়ম করে উপবাস শুরু করুন। রক্তের এনডোরফিন এনজাইম মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়াতে সহায্য করে। উপবাসের মাধ্যমে রক্তের মধ্যে এনডোরফিন এনজাইম নিঃসরণ বেড়ে যায়।
এবং সাথে সাথে মস্তিস্কের ভেতরে ইনফ্লেমেশনের মাত্রাও কমতে শুরু করে ফলে, মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়ে এবং যে কোন ধনের ব্রেন ডিজিজ হওয়ার সম্ভবনা কমে যায়।
অটোফেজী প্রক্রিয়ার জন্য ফাস্টিং ও সতর্কতা
অটোফেজী প্রক্রিায়ার জন্য ফাস্টিং একটি অন্যতম অপরিহার্য বিষয় তবে তা কোন বিশেষজ্ঞের পারামর্শ ছাড়া একদিনের বেশি করা উচিৎ নয়। কারণ, খাবার গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকলে শরীরের ভেতরে নানান ধরনের পরিবর্তন শুরু হতে থাকে। তার মধ্যে একটি রক্তের শর্করার মাত্রা কমতে থাকা, ফলে আগে থেকেই শরীরে মজুত থাকা শর্করাকে কাজে লাগিয়ে শরীর তার প্রয়োজনীয় চাহিদা পুরণ করে।
প্রসঙ্গত, যে সময় থেকে শরীরের মজুত শর্করা বা গ্লাইকোজেন ভাঙতে শুরু করে, সে সময় থেকে দেহের মধ্যে জমে থাকা অতিরিক্ত কোলেষ্টরেল ও চর্বিও ভাঙতে থাকে। তবে এমনটা কয়েকদিন একটানা চলতে থাকলে শরীর “কিটোসিস মোডে” চলে যায়। অর্থাৎ শরীরের ফ্যাট ভেঙে শরীর জ্বালানি তৈরির কাজে লেগে যায় এবং ওজন কমতে শুরু করে।
সেই সঙ্গে রক্তে বাড়াতে থাকে অ্যাসিডের মাত্রা। ফলে শুরু হতে পারে কিছু শরীরিক সমস্যা যেমন, মুখে দুর্গন্ধ, ক্লান্তি, অবসাদ সহ আরও অনেক উপসর্গ। তো সঠিক সময়ে যদি ঠিক মতো খাওয়া-দাওয়া আবার শুরু না করা হয়, তাহলে ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে কিডনি এবং লিভার। তাই বিশেষজ্ঞের পারামর্শ ছাড়া কখনও একদিনের বেশি ফাস্টিং করতে যাবেন না!