সৌন্দর্যের বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানের সৌন্দর্য এ দুটি বিষয়ের মধ্যে সাদৃশ্য হচ্ছে সৌন্দর্য। এই সৌন্দর্য বা সুন্দরের সজ্ঞা আসলে কি বা সৌন্দর্য বিচারের মাপকাঠিই বা কি? সুন্দরের সংজ্ঞা দেশে দেশে, কালে কালে পরিবর্তিত হয়েছে, এখনও পর্যন্ত শাশ্বত সুন্দর বলে পৃথিবীতে কিছু নেই। কারন, সৌন্দর্য বিষয়টি অবলোকনকারির রুচি, অভিরুচি ও মানসিকতার উপর অনেকখানি নির্ভর করলেও এটাই চরম এবং পরম ধরে নেওয়ার কোন কারন নেই।
ব্যক্তিমানুষের রুচিবোধ বিভিন্ন থাকলেও সাধারণভাবে কিছু কিছু বৈশিষ্ট মানুষের সৌন্দর্যকে প্রকাশিত হতে সহায়তা করে। এর অনেকগুলোই কালচার, সামাজিক, হরমোনাল, ফারটিলিটি, বিবর্তনের ধাপ ইত্যাদির সঙ্গে সম্পর্কিত। আবার কোন কোনটি শুধু শারীরিক সৌন্দর্য নয়, মানসিক সৌন্দর্যের সাথেও জড়িত।
তবে, এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য নান্দনিকতা (Aesthetics) সম্বন্ধে আলোচনা করা নয়। এখানে উপরে উল্লেখিত দুটি বিষয়ে আলোচনা করা হবে এবং পরিশেষে এদের ভিতর একটা অন্তঃমিল খোঁজার চেষ্টা করা হবে।
বিজ্ঞান সম্পর্কিত আরো লেখা.. |
---|
ছদ্মবিজ্ঞান বা অপবিজ্ঞান (Pseudoscience) প্রাণের উৎস সন্ধানে বিজ্ঞানের যত গবেষণা! আয়ু বৃদ্ধি ও অমরত্বের সন্ধানে বিজ্ঞান! |
সৌন্দর্যের সংজ্ঞা ও মাপকাঠি
সুন্দরের অনেক সংজ্ঞা রয়েছে, ’Unity in variety’ থেকে শুরু করে ‘Be yourself’ পর্যন্ত এর দৌড়। সুতরাং সৌন্দর্যের শারীরিক (Physical), মানসিক (Mental) এবং বিমূর্ত (Abstract) দিক রয়েছে। একসময় ইথিওপিয়ার কালো মেয়েরা সবচাইতে বেশি সুন্দরী বলে বিখ্যাত ছিল, পরবর্তীতে সাদা আধিপত্যের (White supremacy) কবলে পড়ে ফর্সারাই সুন্দর হয়ে উঠলো আর কালোরা প্রান্তিক বলে গন্য হতে থাকলো। সেই হিসাবে সৌন্দর্যকে রাজনৈতিক প্রপাগান্ডার অংশ হিসাবেও ধরা যায়।
নারীদের ক্ষেত্রে সৈন্দর্য্যের মাপকঠি
পুরাতন গ্রীক তত্ত্ব অনুযায়ী সৌন্দর্য নির্ভর করে প্রতিসাম্য/ভারসাম্যর (Symmetry) উপর। নানারকম মাপজোক করে তারা একটা গোল্ডেন রেশিও (Golden ratio, Phi= 1.6) বের করেছিলেন যার মান হচ্ছে ১.৬, অর্থাৎ একটু লম্বাটে ধরনের মুখমণ্ডল। সেই অনুযায়ী ২০১৯ সালে সবচেয়ে সুন্দর মহিলা নির্বাচিত হয়েছেন সুপার মডেল বেল্লা হাদিদ (Bella Hadid), এর পর রয়েছেন বিয়োন্স, এম্বার হার্ড, এরিয়ানা গ্রান্ডে ছড়াও অনেকের নাম [১]। আপনাদের জানার জন্য উল্লেখ করছি যে, বেল্লা হাদিদ এর প্রাপ্ত নম্বর ছিলো ৯৪.৩৫%।
পুরুষদের ক্ষেত্রে সৈন্দর্য়ের মাপকাঠি
পুরুষের সৌন্দর্য নির্ভর করে তার পৌরুষের গুনাগুনের উপর। পেশীর সাথে পকেটের একটা বড় সম্পর্কও এখানে রয়েছে। গোল্ডেন রেশিও অনুযায়ী রবার্ট প্যাটিনসন (Robert Pattinson) ৯২.১৫% নম্বর পেয়ে বিশ্বের সর্বাপেক্ষা সুন্দর পুরুষ বিবেচিত হয়েছেন, তারপর রয়েছেন হেনরি ক্যাভিল (Henry Cavill) 91.64%, ব্র্যাডলি কুপার (Bradley Cooper) 91.08%, ব্র্যাড পিট (Brad Pitt) 90.51%, এবং ডেভিড বেকহ্যাম (David Beckham) 88.96% পয়েন্ট পেয়ে রয়েছেন সপ্তমে [২]।
এতক্ষন জানলেন সৌন্দর্যের বিশ্লেষণে বিজ্ঞানের ব্যবহার, আসুন এবার বিজ্ঞানের সৌন্দর্য কোথায় সেটি নিয়ে আলোচনা করা যাক।
বিজ্ঞানের সৌন্দর্য
বিজ্ঞানের সৌন্দর্য নিহিত রয়েছে এর কল্পনা শক্তিতে (Hypothesis), প্রকল্প নির্মাণে (Project Development), পরীক্ষা পদ্ধতিতে, তথ্য সংগ্রহ এবং তথ্য বিশ্লেষণে, পরিসংখ্যান পদ্ধতিতে, যুক্তিতে ও সাক্ষ্য প্রমান সংগ্রহে। তবে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় এগুলোর প্রয়োগ রয়েছে বিভিন্নভাবে। তবুও তাত্ত্বিক এবং ফলিত বিজ্ঞানে ব্যবহৃত সমীকরণে (Equation) আলাদা এক ধরনের সৌন্দর্য লক্ষ্য করা যায়, যেখানে প্রতিসাম্য বা Symmetry র প্রয়োগ অত্যন্ত জোরালো। বিজ্ঞানের সিমেট্রি দেহের সৌন্দর্যের সিমেট্রি থেকে কিছুটা আলাদা।
যেখানে আলোচনার বিষয় বিজ্ঞানের সৌন্দর্য সেখানে প্রাসঙ্গিকভাবেই প্রতিসাম্য (symmetry) এবং fractal নিয়ে আলোচনার প্রয়োজনীয়তা এসে যায়।
বিজ্ঞানে প্রতিসাম্য (Symmetry)
প্রতিসাম্য বলতে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বুঝায় এমন একটা অবস্থা যা বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে অপরিবর্তনীয় থাকে। যখন কোন বস্তু, চিত্র, বা জ্যামিতিক আকৃতিকে এমনভাবে বিভক্ত করা যায় যে, একটা ভাগ আয়নার উপর ফেললে বাকী ভাগটার প্রতিবিম্ব মিলে চিত্রটিকে সম্পুর্ন করে তোলে, তখন তাকে সহজ ভাষায় প্রতিসম বা Symmetrical বলা হয় [৩]।
এখানে দ্বিমাত্রিক আকৃতিতে একটা প্রতিসাম্যতার রেখা (Line of symmetry) থাকে, আবার ত্রিমাত্রিক আকৃতির ক্ষেত্রে প্রতিসাম্যের তল (Plane of Symmetry) থাকে। ঠিক একই ভাবে গোলাকার বস্তুর ক্ষেত্রে এবং অন্য আকৃতির ক্ষেত্রেও একটা কেন্দ্র থাকে (Centre of Symmetry)। জ্যামিতিক আকার আকৃতি অনুযায়ী এ ধরনের প্রতিসাম্যতার রেখা, তল, কেন্দ্র ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। আবার বৃত্তের (Circle) ক্ষেত্রে কেন্দ্র দিয়ে এরকম অসংখ্য প্রতিসাম্য রেখা তৈরি করা যায়।
বিজ্ঞানে প্রতিসাম্য বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে, যেমনঃ
১. Translational symmetry (অনুবাদগত প্রতিসাম্য)
যখন কোন বস্তু একস্থান থেকে অন্য স্থানে নির্দিষ্ট রেখা বরাবর এমনভাবে যায় যেন এর আপেক্ষিক অবস্থানের কোন পরিবর্তন হয় না, তখন তাকে অনুবাদগত প্রতিসাম্য (Translational symmetry) বলে।
বিষয়টিকে এভাবে ব্যাক্ষা করা যায়, ধরুন বাম হাতে ঘড়ি পড়ে আছেন আপনি, এখন ঘড়িটি যদি বাম হাত থেকে খুলে ডান হাতে পড়েন তবে ঘড়ির স্থান এবং কালের রূপান্তর ঘটলো শুধু, কিন্তু ঘড়িটি বাম হাতে যেমনটি ছিলো ডান হাতে আসার পরেও একই রকম থাকবে। একেই বলে অনুবাদগত প্রতিসাম্য (Translational Symmetry)।
২. Rotational symmetry (আবর্তনশীল প্রতিসাম্য)
এখানে কেন্দ্রের চতুর্দিকে আবর্তিত হলেও প্রতিসাম্যের কোন পরিবর্তন হয় না। বস্তুর Rotational Symmetry হচ্ছে খুবই সাধারণ একটি বিষয়, কারন সব বস্তুই ৩৬০ ডিগ্রী কোণ বরাবর ঘুরতে পারে। এখন বস্তুটি ঘোনোর ফলে নিদৃষ্ট একটি কোন বরাবর যেয়ে দেখতে যদি একই রকম লাগে তখন তাকে আমরা Rotational Symmetry বলব।
৩. Reflexive symmetry (প্রতিফলিত প্রতিসাম্য)
এখানে আয়নার ভিতর অর্ধেকের ছবি ফেললে বাকী অর্ধেকটা এমনিতেই পূরণ হয়ে যাবে। যেমন ধরুন একটি টেনিস বল মাঝখান থেকে কেটে যদি আয়নার কাছাকাছি ধরেন তবে একটি আস্ত টেনিসবলই দেখতে পাবেন। এটিই হচ্ছে প্রতিফলিত প্রতিসাম্য (Reflexive symmetry)।
৪। Glide symmetry (গ্লাইড প্রতিসাম্য)
এখানে Glide symmetry -এর ক্ষেত্রে রিফ্লেকশন এবং ট্রান্সশ্লেষন একসঙ্গে হয়। যেমন ডান পায়ের ছাপকে বাম পায়ের ছাপ দিয়ে প্রতিস্থাপন করলে যে প্রতিসাম্য পাওয়া যায় সেটিই Glide symmetry.
অংক শাস্ত্র, জ্যামিতি, বায়োলজি, রসায়ন, পদার্থবিদ্যা ইত্যাদি বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় এই প্রতিসাম্যের ধারনাকে ব্যবহার করা হয়। বিজ্ঞানের সমীকরণ এরকম এমনই একটা ধারনা যা স্থান-কাল ভেদে একই রকম থাকবে এবং একই ধরনের ফলাফল দেবে।
ফ্রাক্টাল (Fractal)
ফ্রাক্টাল হচ্ছে একধরনের পুনরাবৃত্তিমূলক ঘটনা যা যতই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাগে দেখা হোক না কেন, তা একই ধরনের ছবি দেবে। বিজ্ঞানে এটাও এক ধরনের প্যাটার্ন যা প্রকৃতিতে অহরহ বিরাজমান।
১৯৭৭ সালে Benoit Mandelbrot প্রথমে fractal এর ধারনা দেন। এই ফ্রাক্টাল ডিজাইনকে যতই জুম (Zoom) করা হোক না কেন, এরা একই ধরনের আকৃতি দিতে থাকে। এটা এক ধরনের জুম প্রতিসাম্য তৈরি করে। বিভিন্ন উদ্ভিদের পাতা, প্রানীর ফুস্ফুস, আকাশের বজ্র ইত্যাদি অনেক কিছুতেই এই ফ্র্যাক্টাল ডিজাইন লক্ষ্য করা যায়।
উপসংহার
মানব দেহের প্রতিসাম্য যেমন সৌন্দর্যের একটি অংশ তেমনই বিজ্ঞানের প্রতিস্যাম্যও বিজ্ঞানের একটি সৌন্দর্য। অর্থাৎ মানবদেহ ও বিজ্ঞান দুটির ক্ষেত্রেই প্রতিসাম্য একটি কমন বিষয় যা না থাকলে সৌন্দর্যের বিষয়টি আর থাকে না, মানুষ যেমন সুন্দর হয়ে ওঠেনা তেমনই বিজ্ঞানও পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে না।
বিজ্ঞান নিরস কোন বিষয়বস্তু নয়, এর ভিতরেও সৌন্দর্য রয়েছে। আমাদের কাজ হলো প্রকৃতির নিখুঁত সৌন্দর্যে বিস্মিত না হয়ে তার অন্তর্নিহিত কারণগুলো অনুধাবন করা, আর নতুন নতুন সৌন্দর্যের জন্ম দেওয়া।
রেফারেন্স: |
---|
[১] –Bella Hadid Declared Most Beautiful Woman in World by THIS Maths Equation And we Are as Puzzled as You! (www.india.com) [২] –Robert Pattinson named most beautiful man in the world by scientists – beating Brad Pitt and David Beckham (www.the-sun.com) |