ক্রিস্টোফার কলম্বাস কে ছিলেন?
আমেরিকা অভিযাত্রা ও ঐ অঞ্চলে ইউরোপীয়দের উপনিবেশ স্থাপনের সূচনা করেছিল ইতালীয় নাবিক ও ঔপনিবেশিক ক্রিস্টোফার কলম্বাস । ইতালির বন্দর শহর জেনোয়াতে বেড়ে ওটা ক্রিস্টোফার কলম্বাস (১৪৫১-১৫০৬) ১৪৭৭ সালের দিকে পর্তুগালের লিসবনে চলে যান এবং সেখান থেকে ভূমধ্যসাগর এবং আটলান্টিক মহাসাগরীয় বাণিজ্যিক বন্দরগুলোতে নৌ অভিযান পরিচালনা করেন।
কলম্বাস ১৪৮৩ সালে পর্তুগালের রাজা জন দ্বিতীয়র কাছে পরিকল্পনা জমা দেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি আটলান্টিক হয়ে পশ্চিমের দিকে ইন্ডিজে (এশিয়া) যাওয়ার ইচ্ছা পোষন করেন। কিন্তু রাজা যখন তার পরিকল্পনায় সম্মতি দিলেন না, তখন তিনি স্পেনের রাজা ও রাণীর (ইসাবেলা ও ফার্দিনান্দ) কাছে তার পরিকল্পনা প্রকাশ করেন। স্পেনের রাজদরবার তাকে ইন্ডিজ দ্বীপপুঞ্জের ভাইসরয় হিসাবে নিযুক্ত করে তার অভিযানে সম্মতি প্রদান করেন।
আবিস্কারক, ঔপনিবেশিকের আড়ালে লুটেরা
তিনটি জাহাজে করে ১৪৯২ সালের ১২ অক্টোবর আমেরিকার বাহামাস দ্বীপে পৌঁছান ক্রিস্টোফার কলম্বাস। সেখানকার সরলমনা স্থানীয় আদিবাসীরা তাদেরকে অতিথি হিসেবে স্বাগত জানান এবং কলম্বাসের একটি ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজ মেরামতও করে দেন তারা। কলম্বাস সেখানকার স্থানীয় আদিবাসীদের দেহে স্বর্ণের অলঙ্কারের প্রাচুর্য দেখে অনুমান করেন যে, আশেপাশের কোথাও অবশ্যই স্বর্ণের খনি রয়েছে।
বাহামাস দ্বীপের আদিবাসীদের সরলতা দেখে কলম্বাস ধারনা করে নেন যে, তিনি খুবই সহজেই ওই ভূখণ্ডের সব কিছু নিজের দখলে নিতে পারবেন। আর এই উদ্দেশ্যে তিনি আমেরিকার মূল মালিক আদিবাসীদের নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা করে স্পেনে ফিরে গিয়ে আরও এক হাজার দুইশ ইউরোপীয়কে সঙ্গে করে দ্বীপে নিয়ে আসেন।
আর এখান থকেই শুরু হয় নির্মম অত্যাচার। কলম্বাসের বাহিনী হিস্পানিওলা দ্বীপে ১৪ বছরের উপরের সব আদিবাসীকে প্রতি তিন মাসে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণে স্বর্ণ জমা দেওয়ার নির্দেশ জারি করেন। যারাই এই নির্দেশ পালনে ব্যর্থ হতো তাদেরই দুই হাত কেটে দেওয়া হতো। যারা বাঁচার জন্য পালানোর চেষ্টা করতো, তাদেরকে হিংস্র কুকুর দিয়ে খুঁজে টর্চার করে অথবা জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হতো।
ঐতিহাসিক গবেষনা বলছে, কলম্বাসের নেতৃত্বাধীন ইউরোপীয় বাহিনীর নির্মমতা সইতে না পেরে হিস্পানিওলা দ্বীপে বসবাসকারী আরাওয়াক গোত্রের ৫০ হাজার আদিবাসী বিষ খেয়ে গণ-আত্মহত্যা করেছিলেন। মায়েরা বাচ্চাদের বিষ খাইয়ে মেরে ফেলতেন কারন ইউরোপীয়রা যেন ওই বাচ্চাদেরকে কুকুরের খাবারে পরিণত করতে না পারে। এরপরও যারা বেঁচে ছিলেন তাদেরকে কলম্বাস দাসে পরিণত করেনা।
আরাওয়াক গোত্র সংক্রান্ত ঐতিহাসিক তথ্য থেকে জানা যায়, ১৫১৫ সালে যেখানে আরাওয়াক গোত্রের জনসংখ্যা ছিলো ৫০ হাজার সেখানে ১৫৫০ সালে সেই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ৫০০ জনে। এর পরে ১৬৫০ সালে দ্বীপটিতে আর কোন আরাওয়াক গোষ্ঠীর সদস্য বেঁচে ছিল না। তবে এর বহু আগেই কলম্বাস মারা গেলেও আমেরিকাতে দখলদার ইউরোপীয়দের গণহত্যা থেমে যায়নি। কলম্বাসের উত্তরসূরিরা তারই পথ অনুসরণ করে আদিবাসী নিধন চলিয়ে যায়।
কলম্বাসের নিজস্ব জার্নাল ও চিঠিতে সে সময়ের কিছু নির্মমতার ইতিহাস উঠে এসেছে। আরও কিছু তথ্য পাওয়া যায় হিস্টোরি অব দ্য ইন্ডিজ বইটিতে। বইটির লেখক স্পেনের ঐতিহাসিক বার্তোলমে দা লাস কাসাস লিখেছেন, ‘কলম্বাস বাহিনী তাদের ছুরি ও তলোয়ারের ধার পরীক্ষা করার জন্যও আদিবাসীদের টুকরো টুকরো করে কাটতো, নিষ্পাপ শিশুদের শিরশ্ছেদ করতো।’
কলম্বাস যাদেরকে রেড ইন্ডিয়ান মনে করতেন সেই আদিবাসীদের একটা বড় অংশক যখন নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, তখন ইউরোপীয়রা নিজেদের বিলাসী জীবন টিকিয়ে রাখতে সেবক বা দাস হিসাবে ব্যবহারের জন্য আফ্রিকা মহাদেশে থেকে কৃষ্ণাঙ্গদের ধরে আনতে শুরু করে। আর এভাবেই আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের আগমন। অর্থাত আমেরিকাতে কৃষ্ণাঙ্গদে আগমন সেচ্ছায় নায়।
বিখ্যাত কৃষ্ণাঙ্গ লেখক অ্যালেক্স হেলি আমেরিকায় তার নিজের প্রথম পূর্বপুরুষের অনুসন্ধানের জন্য প্রচুর গবেষণা করেছেন। আর এই গবেষনার তথ্যের ভিত্তিতেই তাঁর লেখা ‘রুট্স: দ্য সাগা অফ এন অ্যামেরিকান ফ্যামিলি’ বইটিতেই আফ্রিকা থেকে মানুষ ধরে আনার কিছু ঘটনার প্রামাণ্য বর্ণনা পাওয়া যায়।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে ক্রিস্টোফার কলম্বাস
যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি অক্টোবর মাসে ইতালির এই অভিযাত্রী ক্রিস্টোফার কলম্বাস এর সম্মানে সরকারি ছুটিও পালিত হয়। কিন্তু ‘নতুন বিশ্ব’ আবিষ্কারের কৃতিত্ব পাওয়া এই ব্যক্তিটি আবার যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে বিতর্কিত একটি নাম হিসাবে পরিচিত। বিশেষ করে, আদিবাসী আমেরিকান রেড ইন্ডিয়ানদের প্রতি কলোম্বাসের আচরণ ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। তিনি সহিংস পন্থায় উপনিবেশ স্থাপন করতে সহজ সরল মানুষদের জীবনকে বিপন্ন করেছিলেন।
বর্তমানে মিনেসোটা, আলাস্কা, ভারমন্ট ও ওরেগনের মতো বেশ কিছু শহর কলম্বাস দিবসের জায়গায় এখন আদিবাসী দিবস পালন শুরু করছে। কারন হিসাবে বলা হচ্ছে, কলম্বাস ও তার পরবর্তীতে অন্য ইউরোপীয় অভিযাত্রীরা স্থানীয় আদিবাসীদের সাথে যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও নিষ্ঠুরতা চালিয়েছে তারই প্রতিবাদে এটি করা হয়েছে।
ইতিহাস থেকে এটা স্পষ্টই বোঝা যায় যে, আমেরিকা আবিষ্কারের পর সেখানে ইউরোপীয়দের দ্বারা যে শাসন ব্যবস্থা তৈরি হয়েছিলো তার অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে আছে সহজ-সরল মানুষের রক্ত, ঘাম ও কান্না। প্রকৃত বর্বর কারা তা নতুন করে আর একবার জানার সুযোগ এনে দিয়েছে জর্জ ফ্লয়েডের হত্যা। কলম্বাস যুগের ৫০০ বছর অতিক্রান্ত হলেও আজও যে তার উত্তরসূরিদের চিন্তা-চেতনায় কোনো পরিবর্তন আসেনি ফ্লয়েডকে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনায় তার প্রমান।
ইতিহাস বিষয়ে আরা লেখাঃ |
---|
হায়া সোফিয়া, আর্কিটেকচারের ইতিহাস পরিবর্তনকারী একটি স্থাপনা। দ্য গ্রেট স্প্যারো ক্যাম্পেইন’ও প্রকৃতির নির্মম প্রতিশোধ! |
তথ্যসূত্র: |
---|
উইকিপিডিয়া। bonikbarta history.com পাঠশালা |