এ মহামারী হয়তো শেষ হচ্ছেনা খুব তাড়াতাড়ি। ১ম ঢেউ শেষ হতে না হতেই শুরু হয়েছে ২য় ঢেউ। সারাবিশ্ব হিমশিম খাচ্ছে কোভিড-১৯ এর ভয়াবহতা সামাল দিতে। প্রতি নিয়ত করনাভাইরাসের মিউটেশনের ফলে আসছে নতুন নতুন ভ্যারিয়ান্ট। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে যে, এই মহামারীর সমাপ্তি ঘটবে কোথায় এবং কেমন করে? বা আদৌ এই মহামারীর শেষ হচ্ছে কিনা?
সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় এই মুহুর্তে নিশ্চিত করে এটাই বলাই যায় যে, ’এই মহামারীর শেষ কোথায় এটা বলার সময় এখনও আসেনি’। তবে স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা বসে নেই, প্রতিনিয়ত নানারকম তথ্য বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে একটা রূপরেখা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা তারা করে চলেছেন। যা এই প্রবন্ধে আলোকপাত করা চেষ্টা করেছি।
এ সম্পর্কিত লেখাঃ ভাইরাস! বিভিন্ন সময় মানব সভ্যতাকে থমকে দিয়েছে যে পরজীবী
অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে কোডিভ-১৯
মূলত ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লুকে ভিত্তি করেই বিভিন্ন রকম ভবিষ্যতবাণী দেবার চেষ্টা করা হচ্ছে, কারন কোভিড-১৯ মানবজাতির জন্য সম্পুর্ন নতুন ধরনের একটি অভিজ্ঞতা। আর ১৯১৮ সালের আগের অতিমারীর উপর ভিত্তি করার মত পর্যাপ্ত তথ্যও বিজ্ঞানীদের হাতে নেই।
রোগের কারন হিসাবে ’ভাইরাস’ প্রতিষ্ঠা পায় বিংশ শতাব্দীতে, আর একবিংশ শতাব্দীতে এসে এটা অতিমারীর রূপ নিয়েছে। ভাইরাস ঘটিত রোগ অনেক পুরনো, গুটি বসন্তের কথা সবাই এখন পর্যন্ত জানে, তবে সামনের শতাব্দী নাগাদ সাধারন জনগণ হয়ত ভুলেই যাবে এই ভাইরাসের কথা।
কিন্তু একথা বাস্তব সত্য যে, এখন যদি গুটিবসন্ত ছড়িয়ে পরে তা আবার অতিমারীর রুপ নেবে নিশ্চিত। কারন বসন্ত রোগের টিকা নেওয়া জনগোষ্ঠির সংখ্যা বয়সের কারনে শেষ হতে খুব একটা বেশী দেরি নেই।
সংক্রামক ব্যাধির ক্ষেত্রে ওয়েভ (Wave)
স্প্যানিশ ফ্লুকে ভিত্তি করে কোডিভ -১৯ সম্বন্ধে বিভিন্ন ওয়েভ বা ঢেউয়ের কথা বলা হচ্ছে, কারন স্প্যানিশ ফ্লু ১ম, ২য়, ৩য় ওয়েভ আকারে এসেছিল এবং ২য় ওয়েভটি ১ম ওয়েভের থেকে আরো ভয়াবহ ছিল। কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে এখন ১ম ওযেভ না ২য় ওয়েভ চলছে এ ব্যাপারে স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীদের ভিতর মতদ্বৈধতা রয়েছে।
কেউ বলছেন কোভিড-১৯ এর ১ম ঢেউ বা ওয়েভ এখনও শেষ হয়নি, আবার কেউ বলছেন ২য় ওয়েভ শুরু হয়ে গিয়েছে। এখানে দুই পক্ষের মতামত, কিসের উপর ভিত্তি করে এই মতামত, করোনার সমাপ্তি কিভাবে হবে, এইসব বিষয়গুলোর প্রতি আলোকপাত করার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে এ মুহুর্তে আমাদের জেনে রাখা দরকার সংক্রামক ব্যাধির ক্ষেত্রে এই ওয়েভ বা ঢেও কি।
ওয়েভ ( Wave) কি এবং কেন?
দেখা যায় সংক্রামক ব্যাধি তার সংক্রমনের ক্ষমতা অনুযায়ী (R factor, Reproductive number, যেমন R factor 3 হওয়া মানে একজন আক্রান্ত ব্যক্তি ৩ জন সুস্থ ব্যক্তিকে সংক্রমিত করতে পারে) সংক্রমণ করতে থাকে। ফলে প্রথমদিকে রোগীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে বাড়তে একটা শীর্ষ বিন্দুতে পৌছায়, তারপর মৃত্যু এবং ইমিউনিটির কারনে ধীরে ধীরে আবার রোগীর সংখ্যা কমতে কমতে নিম্নবিন্দুতে নেমে আসে।
এরপর, ভাইরাস বা জীবানুর মিউটেশনের ফলে নতুন ভ্যারিয়ান্ট তৈরি হয়ে লোকজনকে আবার আক্রান্ত করতে থাকে। ফলে আবারও রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে শীর্ষ বিন্দুতে পৌছায় এবং আবার শীর্ষ বিন্দু থেকে ধীরে ধীরে নিম্নবিন্দুতে নেমে আসে এবং এটা পর্যায়ক্রমে চলতে থাকে। ভাইরাস দ্বারা সংক্রমন শুরু, শীর্ষ বিন্দুতে ওঠা তারপর নিম্নবিন্দুতে নেমে আসার যে গ্রাফ তৈরি হয় তা একেকটা ওয়েভ এর মত দেখা যায়।
ইমিউনিটির মেয়াদ, ভাইরাসের সহজ মিউটেশন, ভাইরাস সংক্রমণে মৃত্যুহার, ভ্যাক্সিনের প্রয়োগ এবং কার্যকারিতা, মানব অভিবাসন (Human migration) সহ বেশ কিছু ফ্যাক্টরের উপর নির্ভর করে এই ওয়েভ বা ঢেউ।
এছাড়াও আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে ভাইরাস ছড়ানোর প্রবনতা (k value, k-value যত কম হবে, আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে ভাইরাস ছড়ানোর প্রবনতা তত বেশী থাকবে) এই গ্রাফকে প্রভাবিত করতে পারে।
মৃত্যুহার (CFR, Crude fatality rate, মৃত্যুহারকে জ্ঞাপিত (Reported cases) রোগীর সংখ্যা দ্বারা ভাগ করলে; IFR, Infection fatality rate, মৃত্যুহারকে প্রকৃত ইনফেকশন দ্বারা ভাগ করলে) ১৯১৮-১৯ সালের ইনফ্লুয়েঞ্জায় ( Spanish flu, Influenja A, H1N1) ছিল ২% এর মত, সেখানে কভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে CFR 2%, IFR 0.5% এর মত।
বিভিন্ন জার্নালে এখনও পর্যন্ত যে সমস্ত রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে তার ফলাফল মিশ্র, যার ফলে এখনও নিশ্চিত করে কিছু বলা সম্ভব হচ্ছেনা যে, এই অতিমারী কোন দিকে মোড় নেবে।
করোনা ভাইরাসের মিউটেশন
সময়টা ডিসেম্বর ২০২০, প্রথম করোনাভাইরাসের মিউটেশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হয় এ সময়। এরপর একের পর এক নানা ধরনের ভ্যারিয়ান্টের রিপোর্ট মিলছে বিভিন্ন দেশ থেকে। যেহেতু করোনা ভাইরাস একটি আর এন এ (RNA virus) ভাইরাস, তাই এর মিউটেশন করার প্রবনতা অত্যন্ত বেশী।
যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি (CDC- Center for Disease control) এইসব ভ্যারিয়ান্টগুলোকে তার সংক্রমনতা, ভ্যক্সিনের প্রতি তার সংবেদনশীলতা, এন্টিভাইরাল ঔষধের প্রতি তার প্রতিক্রিয়া, মনোক্লোনাল এন্টিবডি দিয়ে ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করার ক্ষমতা, রোগের মাত্রা এবং তীব্রতা, ইত্যাদি নানা ফ্যাক্টরগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে মোটাদাগে তিনভাবে বিভক্ত করেছে। যেমন-
- ভ্যারিয়ান্ট অফ ইন্টারেস্ট (VOI- Variant of Interest, B.1.427; B.1. 429; B.1.525 ইত্যাদি)
- ভ্যারিয়ান্ট অফ কন্সারন (VOC- Variant of Concern, B.1.1.7; B.1.351 ইত্যাদি)
- ভ্যারিয়ান্ট অফ হাই কন্সীকয়েন্স (VOHC- Variant of High Consequence, এখনও পাওয়া যায়নি, তবে ভবিষ্যতের জন্য সতর্কাবস্থা বিদ্যমান)
এছাড়াও সাধারণ মানুষের বোধগম্য করার জন্য গ্রীক অক্ষর দিয়ে তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে, যেমনঃ
- আলফা
- বেটা
- গামা
- ল্যামডা
- এপসিলন ইত্যাদি।
যেহারে ভ্যারিয়েশন তৈরি হচ্ছে তাতে গ্রীক লেটারে শেষ হবে বলে মনে হচ্ছেনা, হয়ত আলফা-১, আলফা-২, বেটা-১, বেটা-২ ইত্যাদি নাম দেওয়া লাগতে পারে।
বাংলাদেশী বিশেষজ্ঞরা এখন পর্যন্ত জেনোম সিকোয়েন্সিং করে ৩৪ ধরনের ভ্যারিয়ান্ট পেয়েছেন। তবে সারা বিশ্বে প্রায় ৫০০০ বার মিউটেশন ইতোমধ্যে হয়ে গিয়েছে কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে। ভারত-বাংলাদেশ এখন করোনার মুল এপিসেন্টার বা কেন্দ্রবিন্দু।
GISAID, Nextstrain and Pango ইত্যাদি এজেন্সিগুলো সায়েন্টিফিক নামগুলো বজায় রেখেছে গবেষণা, ভ্যাক্সিন উৎপাদন, রোগের চিকিৎসার জন্য বিজ্ঞানীদের জগতে।
বিভিন্ন ধরনের জেনেটিক মিউটেশনের ফলে স্পাইক প্রোটিনে এমাইনো এসিডের পরিবর্তন হয়, এর ফলে এরা বিশেষ ধরনের গুনাগুণ অর্জন করে। এভাবেই প্রকৃতিতে ভাইরাসের টিকে থাকার সম্ভাবনা, এন্টিবডির বিরুদ্ধে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা, সহজে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা, রোগের তীব্রতা বৃদ্ধিসহ নানাবিধ বৈশিষ্ট অর্জন করতে পারে।
এ সম্পর্কিত আরো লেখাঃ |
---|
করোনা ভাইরাস; আপাতঃ সারসংক্ষেপ! COVID 19 থেকে সুরক্ষায় ব্যবহৃত যত ভ্যাকসিন |
কোডিভ-১৯ সমাপ্তির ক্ষেত্রে হার্ড ইমিউনিটি
ভ্যাক্সিনের ফলে গড়ে উঠবে হার্ড বা দলগত ইমিউনিটি। কিন্তু এখানেও অনেকগুলো ফ্যাক্টর কাজ করে, যার উপর নির্ভর করছে হার্ড ইমিউনিটি বিষয়টি, যেমনঃ
- ভ্যাক্সিনের ইমিউনিটি উৎপাদনের ক্ষমতা
- ভ্যারিয়ান্টদের ক্ষেত্রে এর ইমিউনিটি উৎপাদনের ক্ষমতা
- ভ্যাক্সিনের লভ্যতা
- নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহ
- বিভিন্ন দেশের সরকার এবং জনগনের ভ্যাক্সিন দেওয়া এবং নেওয়ার সক্ষমতা
- জনসংখ্যার ঘনত্ব
- এন্টিভাইরাল প্রতিরোধ ক্ষমতার স্থায়ীত্ব এবং সেই অনুযায়ী ত্বরিত গতিতে বুস্টার ডোজ দেওয়া
- দেশের অভ্যন্তরের সার্বিক স্বাস্থ্য কাঠামো, অর্থনৈতিক অবস্থা
- কমবয়সীদের ভ্যাক্সিনের আওতায় নিয়ে আসা
ম্যাকিন্সে এন্ড কোম্পানীর একটা আর্টিকেলে এ সম্বন্ধে আলোকপাত করা হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে এ বছরের শেষ নাগাদ ধনী দেশগুলোতে হার্ড ইমিউনিটি হয়ে যাবে। বাকী দেশগুলোতে পুর্বে উল্লেখিত ফ্যাক্টরগুলো বড় ভূমিকা রাখবে হার্ড ইমিউনিটি তৈরিতে। এছাড়া বিভিন্ন দেশের জনগনের ভিতর প্রাকৃতিক (Natural) ইমিউনিটির পার্থক্য হার্ড ইমিউনিটি তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।
কোভিড-১৯ এর সম্ভাব্য শেষ দৃশ্য
বিভিন্ন দেশ বা অঞ্চল ভেদে কোভিড-১৯ এর সম্ভাব্য শেষ দৃশ্য বিভিন্ন ধরণের হতে পারে। ম্যাকিন্স এন্ড কোম্পানির পুর্বাভাষ [১] থেকে এ ধারনা আরও জোরালো হয়েছে। অপেক্ষাকৃত ছোট দেশ, যার সীমানা সংরক্ষিত, ভিসা এবং প্রবেশাধিকার শক্তভাবে নিয়ন্ত্রিত, সেখানে পর্যাপ্ত হার্ড ইমিউনিটির মাধ্যমে কভিড-১৯ নির্মূল করা হয়ত সম্ভব হবে।
তবে যে কোন ধরনের শিথিলতায় কোভিড-১৯ এর নতুন ভ্যারিয়ান্টের মাধ্যমে পুনরায় মহামারী (Epidemic) অথবা অতিমারীর (Pandemic) বিস্তার ঘটাতে পারে। আবার বড় বড় দেশগুলিতে বিভিন্ন জায়গায় নিম্নমাত্রায় এই রোগ থেকে যেতে পারে (Focal cluster) এবং পরিবেশ পরিস্থিতির কারনে উঠানামা করতে পারে। তবে আস্তে আস্তে এই রোগের তীব্রতা কমে সাধারন সর্দি-কাশির মত একটি রুপ নিতে পারে।
অনেকগুলো সম্ভাবনা রয়েছে তবে এখন দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কি হয়। তবে এ মুহুর্তে আমাদের জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষা নীতি মেনে চলা আর ভ্যাক্সিন নেওয়া সম্ভব সত্তর বুস্টার ডোজ (Booster dose) নেওয়া ছাড়া কোন আর কোন বিকল্প নেই।
রেফারেন্সঃ
[১] When will the COVID-19 pandemic end? (March 26, 2021, Article, McKinsey & Company)