বর্তমান করোনাভাইরাস মোকবেলায় বাংলাদেশে যে দুটি বিষয় সবথেকে আলোচিত এবং গুরুত্বপূর্ণ তার মধ্যে একটি অক্সিজেন থেরাপি যা আগেই আপনাদের জন্য উপস্থাপন করেছি এবং অন্যটি ভ্যাকসিন বা ভ্যাকসিনেশন। এই প্রবন্ধে ভ্যাকসিন সম্পর্কে বিস্তারিত উপস্থাপন করা চেষ্টা করেছি।
ভ্যাকসিনের শুরুর কথা
ডাঃ এডওয়ার্ড জেনারের (Dr. Edward Jenner, British Physician, 17 May 1749 – 26 January 1823) আগেও বেশ কয়েকজন ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ করেছেন। তবে ১৭৯৬ সালে কাউপক্স থেকে স্মলপক্স বা গুটি বসন্তের টিকা আবিষ্কার ছিলো যুগান্তকারী একটা ঘটনা।
ভ্যারিওলা ভ্যাকসিন অর্থাৎ গরুর পক্স থেকে মূলত ভ্যাকসিন এবং ভ্যাকসিনেশন শব্দের প্রচলন যা ডাঃ এডওয়ার্ড জেনারই প্রথম ব্যবহার করেন। এরপর ১৮৮১ সালে লুই পাস্তুর (Louis Pasteur, born December 27, 1822, Dole, France—died September 28, 1895, Saint-Cloud) আবিষ্কার করলেন অ্যানথ্রাক্স রোগের টিকা।
লুই পাস্তুর তার আবিষ্কৃত এই টিকা ব্যবহার করে ভেড়ার পালকে প্রাণঘাতী অ্যানথ্রাক্স (Anthax) রোগের হত থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হলেন। আর তিনি অ্যানথ্রাক্স রোগের টিকা তৈরিতে ব্যবহার করলেন এই রোগের জন্য দায়ী নিষ্ক্রিয় বা মৃত জীবাণু। পরবর্তীতে লুই পাস্তুর রেবিজ (Rabies) বা জলাতঙ্ক রোগেরও টিকা আবিষ্কার করতে সক্ষম হন।
আরও পড়তে পারেন |
---|
ভাইরাস! বিভিন্ন সময় মানব সভ্যতাকে থমকে দিয়েছে যে পরজীবী। ঔষধ শিল্প; উদ্ভাবন থেকে মান নিয়ন্ত্রণ। |
ভ্যাকসিন কি?
ভ্যাকসিন হচ্ছে কোন রোগের জন্য দায়ী দূর্বল (Weakened), মৃত (Killed), নিস্ক্রিয় (Attenuated) জীবাণু (Micro-organisms) বা এর অংশবিশেষ অথবা জীবানূনিসৃত নিস্ক্রিয় টক্সিন, যাকে আমরা টক্সয়োড (Toxoid) বলে থাকি। অথবা কোন এন্টিবডি (যা এন্টিজেন হিসাবে কাজ করে) বা লিম্ফোসাইট (Lymphocyte) যা শরীরে প্রবেশ করানোর পর ঐ রোগ থেকে সুরক্ষা পেতে শরীরে ইমিউনিটির (Immunity) জন্ম দেয়।
ভ্যাকসিন দিয়ে ব্যক্তির শরীরে প্রত্যক্ষ রোগ প্রতিরোধ (Active Immunity) গড়ে তোলা হয়, অপরদিকে সিরাম বা ইমিউনোগ্লবুলিন দিয়ে তৈরি করা হয় পরোক্ষ ইমিউনিটি (Passive immunity)। যেমন, টিটেনাস টক্সয়েড দিয়ে প্রত্যক্ষ রোগ প্রতিরোধ করা হয়, আর টিটেনাস আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় ব্যবাহার করা হয় টিটেনাস ইমিউনোগ্লবুলিন (Tetanus Immunoglobulin)।
ভ্যাকসিন কত প্রকার?
তৈরি বা আবিষ্করের পদ্ধতি অনুযায়ী এর বেশ কয়েকটি প্রকার রয়েছে। আগে ভ্যাকসিনের যে সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে সেখানে ইতোমধ্যে বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে। নিচের সংক্ষিপ্ত আলোচনাতে সেগুলো আরো জানতে পারবেন।
নিষ্ক্রিয় জীবাণু থেকে তৈরি ভ্যাকসিন (Inactivated vaccine)
এখানে জীবাণু বা ভাইরাসকে তাপ অথবা রাসায়নিক ক্রিয়ার মাধ্যমে নিষ্ক্রিয় করা হয়। তবে এমনভাবে জীবানুকে নিষ্ক্রিয় করা হয় যাতে এর এন্টিজেনিক গুনাগুন অক্ষত থাকবে তবে রোগ তৈরি করার ক্ষমতা থাকবে না।
উদাহরণ হিসাবে বলা যায়ঃ
- রেবিজ (Rabies) বা জলাতংক রোগের টিকা।
- পলিওমাইলাইটিসের টিকা (Salk vaccine)।
- ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকা।
- কলেরা রোগের টিকা।
দূর্বল জীবাণু থেকে ভ্যাকসিন (Attenuated Vaccine)
কালচার করে, অর্থাৎ প্রথমে জীবানু বা ভাইরাসের ক্ষতিকর যে সকল বৈশিষ্ট্য রয়েছে তা নিষ্ক্রিয় বা দুর্বল করে দেওয়া হয় এবং ঐ দুর্বল ভাইরাস বা জীবানু দিয়ে ভ্যাকসিন তৈরি করা হয়।
উদাহরণ হিসাবে বলা যায়ঃ
- হামের টিকা (Measles Vaccine),
- চোয়াল ফুলা রোগের টিকা (Mumps Vaccine)
- পলিওমাইলাইটিসের টিকা (Sabine Vaccine)
- জার্মান মিজল বা রুবেলা টিকা (Rubella Vaccine)
- যক্ষার টিকা (BCG Vaccine)।
- জলাতঙ্ক বা Rabies রোগের ভ্যাকসিন
সাব-ইউনিট ভ্যাকসিন (Sub unit Vaccine)
এই ধরনের ভ্যাকসিনের জন্য রোগের কারনের এন্টিজেনকে আলাদা করে অন্য জীবাণুতে তৈরি করা হয়। তারপর সেটাকে অন্য একটা ভাইরাসের পারটিকেলের (Virus like particle) উপর যুক্ত করে শরীরে প্রবেশ করানো হয়। উদারন হিসাবে ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং হেপাটাইটিস- বি ভ্যাকসিন উল্লেখযোগ্য।
হেপাটাইটিস-বি ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে হেপাটাইটিস বি সারফেস এন্টিজেনকে (HBsAg) আলাদা করে রিকম্বিন্যান্ট টেকনিকের মাধ্যমে ই. কোলাই (Escherecia coli) জীবানুতে প্রবেশ করিয়ে এর কালচার করানো হয়। সেখান থেকে HBsAg কে আলাদা করে ভ্যাকসিন হিসাবে প্রয়োগ করা হয়।
টক্সোয়েড ভ্যাকসিন (Toxoid Vaccine)
টিটেনাস, ডিপথেরিয়া, হুপিং কফ ইত্যাদির টক্সিন নিয়ে তার টক্সিন গুণ গুলোকে নষ্ট করে শুধুমাত্র এন্টিজেনিক গুণাগুণ বজায় রেখে তা শরীরে প্রবেশ করানো হয়। এর ফলে শরীরে তৈরি হয় ইমিউনিটি। এসব রোগের মূল লক্ষনসমূহ প্রকাশ পায় মূলত এইসব টক্সিনের কারনে। আর টক্সিনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারলেই এই রোগগুলি থেকে সুরক্ষা পাওয়া সম্ভব।
জীন কোডেড ভ্যাকসিন (Gene coded Vaccine)
এখানে জেনেটিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে ক্ষতিকর জীন গুলোকে সরিয়ে ফেলা হয়, তারপর এর এন্টিজেন কে প্রচুর পরিমানে তৈরি করে ভ্যাকসিনের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করানো হয়। হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের ক্ষেত্রে এন্টিজেনগুলোকে ভাইরাস লাইক পারটিকেল (Virus like particle, VLP) এ সংযুক্ত করে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়।
জীন প্রযুক্তির অনেকগুলো ধরণ রয়েছে, সেগুলো কোভিড ভ্যাকসিন নিয়ে আলোচনার সময় সামনে আসবে।
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ভ্যাকসিন
উপরের রিপোর্টটি জুলাই ৬, সকাল ৮-১১ মিনিটের তবে এই হিসাবের বাইরেও অনেক রোগী আছে এবং মৃত্যুও আছে। এটা হচ্ছে শুধুমাত্র রেকর্ডকৃত পরিসংখ্যান, যেখানে পরীক্ষা না করা, হাসপাতালে পৌছানোর আগেই মৃত্যুবরণ অথবা নানাবিধ জটিলতায় মৃত্যু বরণ করা রোগীদেরকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
তবে মোটামুটি ভাবে বলা যায়, এখন পর্যন্ত আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় ২০ কোটি, এবং মৃতের সংখ্যা প্রায় অর্ধ কোটি। আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এবং মৃত্যুর সংখ্যা যে আরও বাড়বে তা এখন নির্দ্বিধায় বলা যায়।
ব্যক্তিগত সুরক্ষা নীতি, সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখা, কোয়ারান্টাইন, আইসোলেশন, লকডাউন, গন টিকাদান কর্মসূচী ইত্যাদি সব ধরনের ব্যবস্থায় নেওয়া হচ্ছে করোনাভইরাস (COVID 19) সংক্রমন নিয়ন্ত্রন করার জন্য।
কিন্তু ভাইরাসের জেনেটিক মিউটেশন প্রতিনিয়ত নতুন ধরনের ভ্যারিয়ান্ট তৈরি করছে, যার ফলে কার্যকর প্রতিরোধ এখনও গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। ভবিষ্যতে এইরোগের নিয়ন্ত্রণ নির্ভর করছে কয়েকটা সম্ভাবনার উপর। যথাঃ
- ভাইরাসের মিউটেশন হতে হতে এটা অকার্যকর হয়ে যাওয়া
- গন টিকাদান কর্মসুচীর ফলে দলগত অনাক্রমনতা (Herd immunity) তৈরি হওয়া
- রোগের ফলে মৃত্যু আর অনাক্রমনতা দুটোই তৈরি হয়ে একজাতীয় ভারসাম্য তৈরি হওয়া
- কার্যকর এন্টিভাইরাল ড্রাগ খুঁজে পাওয়া ইত্যাদি।
তবে মিউটেশনের ফলে একের পর এক ওয়েভ আসতেই থাকবে, এরকমও হতে পারে যে, ভাইরাসের সাথেই মানুষকে মিলে মিশে বসবাস (Symbiosis) করতে হবে।
কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে ব্যবহৃত ভ্যাকসিন
এই পর্যায়ে করোনাভাইরাস (COVID 19) প্রতিরোধে সরাবিশ্বে যে ভ্যাকসিনগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে বা হওয়ার পথে সেগুলো নিয়ে আলাচনা করবো।
মেসেঞ্জার আর এন এ ভ্যাকসিন (m-RNA vaccine)
ফাইজার-বায়োন্টেক এবং মডার্নার ভ্যাকসিন এই ক্যাটেগরির অন্তর্ভুক্ত। ইতোপুর্বে ফ্লু, জিকা ভাইরাস (Zika Virus), র্যাবিস (Rabies) বা সাইটোমেগালোভাইরাস (Cytomegalovirus, CMV) নিয়ন্ত্রণে m-RNA ভ্যাকসিন সফলতার সাথে ব্যবহৃত হচ্ছে।
ফাইজারের তৈরি ভ্যাকসিন
এই ভ্যাকসিনটি লিপিড বা চর্বিজাতীয় ন্যানোপারটিকেল দ্বারা আবৃত m-RNA, এই m-RNA গ্রহিতার কোষের ভিতর প্রবেশ করে এর সাইটোপ্লাজমে থাকা মেশিনারি দিয়ে প্রচুর পরিমানে স্পাইক প্রোটিন (S- Protein, spike protein) তৈরি করে।
একসময় এগুলো ইমিউনোকম্পিটেন্ট সেল (Immunocompetent cell) এর সান্নিধ্যে আসে এবং করোনা ভাইরাস বিরোধী এন্টিবডি (Antibody) এবং সাইটোটক্সিক টি-লিম্ফোসাইট (Cytotoxic T-Lymphocyte) তৈরি করে। এর ফলে শরীরে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ জন্মায়। m-RNA গ্রহীতার কোষের নিউক্লিয়াসে প্রবেশ করতে পারে না, তাই DNA নষ্ট করার কোন সম্ভাবনা নেই।
প্রথমবার ইনজেকশনের পর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া কম থাকলেও, দ্বিতীয় ডোজ নেবার পর একটু বেশী প্রতিক্রিয়া দেখা যেতে পারে, কিন্তু কোনটাই সে রকম মারাত্মক নয়। এই ভ্যাকসিনে কোন ভাইরাস পারটিকেল থাকে না, তাই কোভিড হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই।
পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার ভিতর এলার্জিক রিয়াকশন, মাথা ব্যাথা, মাংসপেশীতে ব্যাথা, জ্বর, কাপুনি, ইঞ্জেকশনের স্থানে ব্যাথা, লাল হয়ে যাওয়া, ফুলে যাওয়া, বমি, ডাইরিয়া ইত্যাদি হতে পারে। মারাত্মক ধরনের মায়োকার্ডাইটিসের উল্লেখযোগ্য প্রমান পাওয়া যায়নি।
সাধারণত ১২ বছরের উর্ধের যে কোন মানুষের জন্য এই ভ্যাকসিনের (authorized for emergency use by FDA under an Emergency Use Authorization (EUA) to prevent Coronavirus Disease 2019 (COVID-19) ) ইমারজেন্সী ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। প্রেগ্ন্যান্সিতে এই ভ্যাকসিন নিরাপদ বলে এখনও প্রমানিত হয়নি।
এই ভ্যাকসিনের কনটেইনারগুলি সাধারনত -৮০০ সেন্টিগ্রেড থেকে -৬০০ সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় মেয়াদ পর্যন্ত সংরক্ষন করা যায়। ইঞ্জেকশনের ভায়াল -২৫০ থেকে -১৫০ সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় ১৪ দিন পর্যন্ত সংরক্ষন করা যায়। সাধারণত ৬ সপ্তাহ বিরতিতে ২ টা ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে ভ্যাকসিন কার্যকরী হয়।
ফাইজার-বায়োএনটেকের ভ্যাক্সিন প্রথম ডোজ গ্রহণের ১৪ দিনের মাথায় যে ইমিউনিটি তৈরি হয় যা প্রায় ৬০%, আর ২য় ডোজের পর সেটা গিয়ে দাড়ায় ৯০% পর্যন্ত। ভ্যাকসিনের সরবরাহের স্বল্পতা থাকলে ২ টা ডোজের পার্থক্য ২৪ সপ্তাহ পর্যন্ত করা যেতে পারে।
ভ্যাকসিন গ্রহনের ৬মাস পর্যন্ত সবথেকে বেশি সুরক্ষা পাওয়া যায় এবং এর পর থেকে সময়ের সাথে সাথে কার্যক্ষমতা কমতে থাকে। তাই নতুন করে গবেষণার প্রেক্ষিতে ৩য় একটি ডোজের জন্য ঘোষনা দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। ফাইজার-বায়োএনটেকের ১ম দুটি ডোজ টিকা শরীরে যে পরিমান এন্ডিবডি তৈরি করে তৃতীয় ডোজটি তার চেয়েও ৫ থেকে ১০ গুন বেশি এন্টিবডি তৈরি করতে সক্ষম।
মডার্নার তৈরি ভ্যাকসিন
এই ভ্যাকসিনটি ব্যবহারের ফলাফল ফাইজার-বায়োন্টেকের ভ্যাকসিনের মত প্রায় একই ধরনের। এখানে লিপিড কভারের ভিতর m-RNA 1273 ব্যবহার করা হয়েছে। এটা সামান্য পরিবর্তিত স্পাইক প্রোটিন তৈরি করে যার বিরুদ্ধে এন্টিবডি তৈরি হয়। এই ভ্যাকসিন করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রায় ৯০% কার্যকর এবং এর ভ্যারিয়ান্টের বিরুদ্ধেও ভাল কাজ করে। আর এই ভ্যাকসিনটি -২০০ সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় সংরক্ষন করতে হয়।
ভাইরাল ভেক্টর ভ্যাকসিন (Viral Vector Vaccine)
এই ক্যাটাগরীভুক্ত ভ্যাকসিনের মধ্যে রয়েছেঃ
- অক্সফোর্ড- এস্ট্রাজেনেকা
- জনসন এন্ড জনসন/ জ্যান্সেন
- Sputnik V
বিজ্ঞানীরা এই পদ্ধতির মাধ্যমে করোনা ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের জীন নিয়ে এটা শিম্পাঞ্জীর শরীর থেকে প্রাপ্ত এডেনোভাইরাসের (Adenovirus) মধ্যে প্রবেশ করিয়েছে। এই জেনেটিকালি পরিবর্তীত এডেনোভাইরাস শরীরে প্রবেশের পর স্পাইক প্রোটিন তৈরি করতে থাকে, ফলে শরীর এই স্পাইক প্রটিনের বিরুদ্ধে এন্টিবডি তৈরি করে। আর এই এন্ডিবডিই করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষা তৈরি করে।
অক্সফোর্ড- এস্ট্রাজেনেকা ও জনসন এন্ড জনসনের ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে ৮ থেকে ১২ সপ্তাহ বিরতিতে দুইটি ডোজের মাধ্যমে এই টিকা কার্যকর করা হয়। সাধারন ফ্রিজে ২০ থেকে ৮ ০ সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় এই টিকা সংরক্ষন করা যায়। রোগ প্রতিরোধের হার প্রায় ৬০ শতাংশ থেকে ৭০ শতাংশ। তবে কোরোনাভাইরাস আক্রমন করলেও সেটা সাধারনত মৃদু আক্রমনের ভিতরই সীমাবদ্ধ থাকে। করোনাভাইরাসের অন্য ভ্যারিয়ান্টের বিরুদ্ধেও ভ্যাকসিনগুলো মোটামুটি ভাল কার্যকর।
রাশিয়ান Sputnik V ভ্যাক্সিনও ভাইরাল ভেক্টর ভ্যাকসিন ক্যাটাগরীভুক্ত। এটা লায়োফাইলাইজড (Lyophilized) করা এবং ২০ থেকে ৮০ সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় সংরক্ষন করা যায়। তবে ভ্যাকসিন দেবার পদ্ধতি কিছু আলাদা। ভ্যাকসিনটি শরীরে পুশ করার সময় দ্রবনে গুলিয়ে নিয়ে তারপরে ইঞ্জেকশন করা হয়।
এখন চেষ্টা করা হচ্ছে একডোজ এস্ট্রাজেনেকা এবং পরের ডোজ স্পুটনিক দিয়ে ইমিউনিটি আরও বাড়ানো যায় কিনা। এখনও পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে গবেষণা চলছে।
প্রোটিন সাব-ইউনিট ভ্যাকসিন (Protein Sub-unit vaccine)
এই ভ্যাকসিনের Phase-3 ট্রায়াল চলছে। এর ভিতর কোন জেনেটিক পদার্থ নেই, রয়েছে ন্যানোপারটিকেলে আটকিয়ে থাকা পুর্ন দৈর্ঘ স্পাইক প্রোটিনটাই। মাত্র ২১ দিনের বিরতিতে দুইটি ডোজ প্রায় ৯০% প্রতিরক্ষা দেয় এবং করোনাভাইরাসের ভ্যারিয়ান্টের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা দেয় ৮৫% – ৯৫%। আর এই ভ্যাকসিনটির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তুলনামূলকভাবে কম।
ট্রাডিশনাল ভ্যাকসিন (Traditional Vaccine)
চীনের Sinovac, Cansino, Sinopharma এই পদ্ধতিতে ভ্যাকসিন তৈরী করেছে। চীনের এই প্রতিষ্ঠানগুলো তৈরি ভ্যাকসিন নিজ দেশে ব্যবাহর করা ছাড়া দেশের বাইরেও রপ্তানী করছে। এগুলো মৃত ভাইরাস পারটিকেল থেকে তৈরি করা হচ্ছে যা, ৬০% থেকে ৯০% পর্যন্ত কার্যকর। ভ্যাকসিনগুলো সাধারন ফ্রিজে ২০-৮০ সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা যায়।
থাইল্যান্ডে চীনের তৈরি সিনোভ্যাকের দুই ডোজ ভ্যাকসিন নেওয়ার পরেও কোভিড আক্রান্ত হয়েছেন কয়েক-শ স্বাস্থ্যকর্মী। এরই প্রেক্ষিতে সিনোভ্যাকের দুই ডোজ ভ্যাকসিন গ্রহনের ৩ থেকে ৪ সপ্তাহ পরে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা বা ফাইজার–বায়োএনটেকের একটি ভ্যাকসিনকে বুস্টার ডোজ হিসেবে গ্রহণ করার সিন্ধান্ত নিয়েছে দেশটি।
তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানাচ্ছে সব কোম্পানির টিকার মিক্স এন্ড ম্যাচ এখনও সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি তাই এটা এখনও বিপজ্জনক। তবে ফাইজার এবং অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার মিক্স এন্ড ম্যাচ প্রমানিত হওয়া তা মিলিয়ে গ্রহণ করতে কোন বাধা নেই।
ডিএনএ ভ্যাকসিন (DNA Vaccine)
ডিএনএ (DNA) ভ্যাকসিনে প্লাজমিড অথবা রিং ডিএনএ -র মাধ্যমে ভাইরাল ডিএনএ প্রবেশ করানো হয়। করোনা প্রতিরোধে এখন পর্যন্ত এই ধরনের ভ্যাকসিন কেউ তৈরি করেনি। কারন, এই পদ্ধতিতে মানুষের জেনেটিক পরিবর্তনের সমুহ সম্ভাবনা থাকে।
সময় বাঁচাতে প্লাটফরম টেকনোলজি
আগে যে ভ্যাকসিন তৈরি করতে ১০ বছরের ও বেশী সময় লাগতো। কিন্তু এখন জরুরী প্রয়োজনে মাত্র কয়েক মাসের ভিতর তা তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে! কিন্তু কিভাবে?
আগে ভ্যাকসিন তৈরি করার সময় সবকিছু একেবারে গোড়া থেকে শুরু করতে হতো। কিন্তু এখন প্লাটফর্ম টেকনোলোজী ব্যবহার করার ফলে, এখন আর সব কিছু গোড়া থেকে করা লাগেনা। যেমন m-RNA, DNA-Plasmid, Viral vector এগুলো সব আগে থেকেই তৈরি করা আছে যা প্লাটফরম হিসাবে ব্যবহার করা যায়।
এখন শুধু প্রয়োজন উপযুক্ত জেনেটিক তথ্য, প্রোটিন অথবা এন্টিজেন তৈরি করা। এবং এরপর এগুলো প্লাটফর্মের সাথে যুক্ত করে শরীরে প্রবেশ করানো, ব্যাস হয়ে গোলো ভ্যাকসিন তৈরি। আর এই প্লাটফরম ব্যবহার করে ভ্যাকসিন উদ্ভাবন করার প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় প্লাটফরম টেকনোলজি।
ভ্যাকসিন নিয়ে বাণিজ্যঃ
বর্তমান সময়ে তথ্যপ্রবাহ যারা নিয়ন্ত্রন করছে, ভ্যাকসিনের বিশাল বাণিজ্যও তারাই নিয়ন্ত্রন করবে। বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোও এ ব্যাপারে পক্ষপাতদুষ্ট। ফলে চীন বা রাশিয়ার ভ্যাকসিন নিয়ে তথ্য কম। আর ব্রাজিল কিম্বা বাংলাদেশের তথ্যপ্রবাহ আরও কম। বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর জন্য শুধু অবাধ তথ্য প্রবাহই নয়, প্রয়োজন তথ্যের নায্য হিস্যা বুঝে নেওয়া।
ভ্যাক্সিন নিয়ে প্রতিনিয়তই নতুন তথ্য আসছে, ক্ষনে ক্ষনেই পরিবর্তিত হচ্ছে পরিসংখ্যান। সুতরাং শেষ কথা বলার সময় এখনো আসেনি।