ধারণা করা হয় চুয়াডাঙ্গা জেলার অর্ন্তগত আলমডাঙ্গা উপজেলার ঘোলদাড়ি গ্রামের প্রাচীন মসজিদটিই বৃহত্তর কুষ্টিয়া অঞ্চলের প্রথম মসজিদ। এর আগে আর কোন মসজিদ ছিল কিনা তা এখন আর জানা যায় না। তিন গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদটি শুধুমাত্র আলমডাঙ্গা, চুয়াডাঙ্গা তথা বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলার প্রাচীনতম মুসলিম নিদর্শনই নয়, প্রাচীন বাংলার স্থাপত্য কলার এক অনন্য নিদর্শণও বটে।
ঘোলদাড়ি মসজিদ স্থাপনের সময় বিশ্লেষন
বারবার সংস্কার এবং অন্যান্য কারণে মসজিদটির শিলালিপি নষ্ট হয়ে গেছে। তাই ঠিক কবে এবং কে বা কারা এটি তৈরি করেছিলেন তা নিয়ে বেশ কিছু প্রতিদ্বন্দ্বী তথ্য পাওয়া যায়। প্রচলিত একটি জনশ্রুতি থেকে জানা যায়, হযরত খায়রুল বাশার ওমজ নামীয় একজন ইসলাম প্রচারক বাংলা ৪১৩ সালে (১০০৬ খ্রিস্টাব্দ) মসজিদটি প্রতিষ্ঠিত করেন। হযরত খায়রুল বাশার ওমজ এবং তাঁর অনুসারীদের নিয়ে তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায় না।
এই তথ্যের উপর নির্ভর করাটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ এই অঞ্চলে পাল আমলে নির্মিত কোন স্থাপনার নিদর্শন পাওয়া যায়নি। আর তুর্কি আক্রমণের ভয়ে ভীত সেন বংশের শেষ রাজা লক্ষন সেন বিদেশি মুসলমানদের ‘দেখা মাত্র হত্যা’র নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাই ঐ সময় রাজধানী নদিয়া থেকে অল্প কিছু দূরে কোন স্থায়ী মসজিদ অথবা খানকার অস্তিত্ব থাকবে, এমনটা মেনে নেওয়া বেশ কঠিন।
প্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহনের ভিত্তিতে
শ ম শওকত আলী তাঁর ‘কুষ্টিয়া জেলায় ইসলাম’ বইতে ঘোলদাড়ি মসজিদটিকে হযরত খান জাহান আলীর সমসাময়িক বলে মন্তব্য করেছে। কিন্তু আলাউদ্দিন ঘোরী এস্টেটের উত্তরসূরিদের বয়ানের সাথে সময়ের ফারাক থেকে যায় প্রায় ২০০ বছর। হযরত খান জাহান আলীর ষাট গম্বুজ মসজিদটি নির্মিত হয় ১৫শ শতাব্দীতে, সুলতান নসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহের (১৪৩৫-৫৯) আমলে।
ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি ঝাড়খণ্ডের অপ্রচলিত অরণ্যপথ মাড়িয়ে সেন গুপ্তচরদের চোখে ধুলো দিয়ে এক মধ্যাহ্নে অকস্মাৎ নদীয়ার দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হন (১০ মে, ১২০৫)। বৃদ্ধ রাজা লক্ষন সেন পালিয়ে গেলে এই অঞ্চল মুসলমান শাসকদের আওতায় আসে এবং বিন বখতিয়ার সুলতান মুহাম্মদ ঘোরির নামে স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন করেন।
নদীয়া জয়ের পরপরই ম্লেচ সর্দার আলী তাঁর দলবল নিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেন এবং বখতিয়ার খলজির সৈন্যদলে যোগদান করেন। সেটাই ছিল এই অঞ্চলে ইসলাম ধর্ম গ্রহনের প্রথম ঐতিহাসিক বিবরণ। এরপর আস্তে আস্তে এ অঞ্চলে ইসলাম ধর্মের প্রসার ঘটতে থাকে। বিন বখতিয়ার খলজির মৃত্যুর পরে খলজি বংশের আভ্যন্তরীণ সংকট প্রবল হয়ে ওঠে।
ঘোলদাড়ি মসজিদ নামকরণ পর্যালোচনা
জনশ্রুতি আছে, এর কাছাকাছি সময়ে শাহ সুফি আলাউদ্দীন ঘোরী নৌকাযোগে ভাটুই নদী দিয়ে রাজধানীর দিকে যাচ্ছিলেন। তাঁর নৌবহরের যুদ্ধে নিহত কিছু সৈনিকের মৃতদেহ ছিল। তাঁরা ঘোলদাড়ি গ্রামে (তখন ছিল জঙ্গলাকীর্ণ এবং জনমানব শূন্য) বিশ্রামের জন্য থামেন এবং সেখানে সৈনিকদের মৃতদেহগুলো দাফন করেন। কিছু দিন পরে তাঁদের সাথে থাকা কিছু মানুষ রাজধানীতে চলে গেলেও বাকিরা থেকে যান এবং বসতি স্থাপন শুরু করেন।
বলা হয়ে থাকে ‘ঘোরীর দাড়ি’ থেকে ‘ঘোলদাড়ি’ কথাটা এসেছে। সুফি আলাউদ্দীন ঘোরী মৃত সৈনিকদের কবরগুলোর পাশে একটি মসজিদ এবং মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরে আলাউদ্দিন ঘোরী এস্টেট নামে অধিভুক্ত হয়। এই এস্টেটের ৫০০ (পাঁচশত) একর লাখেরাজ জমি ছিল।
বিস্মৃতির আড়াল থেকে ঘোলদাড়ি মসজিদ পুরুদ্ধার
ফজিলাতুন্নেছা চৌধুরানী ছিলেন আলাউদ্দিন ঘোরী এস্টেটের সর্বশেষ কর্ণধর। পরে ইংরেজরা এস্টেটটি অধিগ্রহণ করলে লাখেরাজ ভুমিগুলো বেদখল হতে থাকে এবং একসময় প্রায় নেই হয়ে যায়। শোনা যায় আজ থেকে প্রায় একশ বছর আগে মসজিদের আশে পাশের এলাকায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে, মানুষজন তাঁদের বসতি অন্যত্র সরিয়ে নেয়। মসজিদটি গভীর জঙ্গলে ঢেকে যায় এবং আস্তে আস্তে বিস্মৃতির আড়ালে চলে যায়।
সম্ভবত এই কারণে কুষ্টিয়া জেলা গেজেটিয়ারে এই মসজিদটির নাম অনুল্লিখিত থেকে যায়। গত শতকের পাঁচের দশকে জঙ্গল পরিষ্কার করে মসজিদটিকে উদ্ধার করে আবার নামাজযোগ্য করা হয়। এখন এখানে নিয়মিত মুসল্লিরা জামাতে নামাজ আদায় করেন। ঘোলাদড়ি গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক চৌধুরী ৮৫ শতক জমি মসজিদের নামে ওয়াকফ করেন। শাহ সুফি আলাউদ্দীন ঘোরীর কিছু বংশধর এখনও ছয়ঘোরিয়া গ্রামে বসবাস করছেন।
আরো পড়ুনঃ |
---|
কুমার নদ নামকরণের ইতিহাস! |
(মসজিদটি সম্পর্কে আরো কোন তথ্য যদি কারো জানা থাকে তাহলে কমেন্টস বক্সে উল্লেখ করতে পারেন। আমার দেওয়া তথ্যে যদি কোন ভুল থেকে থাকে সেটাও কমেন্টস বক্সে উল্লেখ করতে পারেন, যাতে আমি সেই ভুল তথ্যটি সংশোধন করতে পারি। ধন্যবাদ)
তথ্যসুত্রঃ
*গঙ্গাঋদ্ধি থেকে বাংলাদেশ, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান
*বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালাঃ চুয়াডাঙ্গা, বাংলা একাডেমী
*জেলা গেজেটিয়ার, কুষ্টিয়া
*উইকিপিডিয়া
*কিছু প্রবীণ ব্যক্তির সাক্ষাৎকার।