যখন কোন প্রাণীর দ্বারা মানুষ হত্যার কথা কল্পনা করা হয় তখন সাধারণতই কোন বড় আকারের প্রাণীর কথাই মনে হয়। যেমন, বাঘ, হাঙ্গর, সাপ বা কুমিরের মত প্রাণী। তবে এগুলোর মধ্যে কোনটিই ততটা ভয়ঙ্কর নয় বা প্রতক্ষ্যভাবে মানুষের মৃত্যূর করন হয়নি, ঠিক যতটা হয়েছে ডেঙ্গু জ্বর (Dengue Fever) বা ব্রেকবোন ফিভারের ভাইরাস বহনকারী এডিস মশা।
এডিস মাশার কামড়ে বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৪০০ মিলিয়ন মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে (ব্রেকবোন ফিভার) আক্রান্ত হয়ে থাকে, যার মধ্যে মারা যান প্রায় ২০ হাজারেরও বেশি মানুষ। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত আমাদের বাংলাদেশেও এডিস মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু জ্বর ও চিকুনগুনিয়ার মত জ্বর গত কয়েক বছরে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।
তবে একদল গবেষকের গত এক দশকের গবেষণা ডেঙ্গু নির্মূলে আশার আলো দেখাচ্ছে। এবং যা ইতোমধ্যে কার্যকরী হিসাবেও প্রতিয়মান হয়েছে। আসুন জেনে নেওয়া যাক বিস্তারিত।
ভাইরাস সম্পর্কিত আরো লেখা.. |
---|
ভাইরাস! বিভিন্ন সময় মানব সভ্যতাকে থমকে দিয়েছে যে পরজীবী |
এডিস মশা; ডেঙ্গু (Dengue) ভাইরাসের বাহক
ডেঙ্গু জ্বরের ভাইরাসের একমাত্র বাহক এডিস মশা অন্যান মশা থেকে দেখতে একেবারেই আলাদা। দেহের ও পায়ের সাদা এবং কালো চিহ্নগুলো অনান্য মশার প্রজাতি থেকে এই প্রজাতিকে আলাদা করেছে।
তবে এসিড মশার আলাদা একটি বৈশিষ্ঠ হচ্ছে এরা অনান্য মশা থেকে বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করে এবং আবদ্ধ পরিষ্কার পানিতে বংশ বিস্তার করে। এরা সাধারণত খুব ভোরে এবং সন্ধ্যা হওয়ার আগে কামড় দেয়।
এডিস মশার মধ্যে যতগুলো প্রজাতি রয়েছে তার মধ্যে মাত্র দুটি প্রজাতি ভাইরাল সংক্রমণের জন্য দায়ী যথাঃ
- এডিস ইজিপ্টি (Aegypti)
- এডিস এলবুপিক্টাস (Albopictus)
আমাদের দেশ সহ এশিয়া অঞ্চলে এডিস ইজিপ্টি মশার আধিক্যই বেশি। এই মশার কামড়ে মানুষের শরীরে ভাইরাস সংক্রমনের ফলে ডেঙ্গু জ্বর, চিকুনগুনিয়া, হলুদ জ্বর, ওয়েস্ট নাইল জ্বর হতে পারে, যা অনেক সময় মৃত্যুর কারন হয়ে দাড়ায়।
এডিস মশার কামড়ে যতগুলো ভাইরাল সংক্রমন হতে পারে তার মধ্যে ডেঙ্গু জ্বর সবথেকে ক্ষতিকর। এডিস মশার মাধ্যমে এই ভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবেশ করে, যার ফলে উচ্চ তাপমাত্রার জ্বর সহ শরীরে যে পরিমান ব্যাথার সৃস্টি হয়। এই রোগের বৈশিষ্ঠের কারনেই এটাকে “ব্রেকবোন ফিভার” নামেও ডাকা হয়।
ডেঙ্গু জ্বর মোকাবেলায় চলমান কার্যক্রম
বিশ্বে জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা ক্রমাগত যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে এই মশাও তার ভৌগোলিক পরিসর দিনে দিনে প্রসারিত করছে। ফলে বর্তমান সময়ে সারা বিশ্বেই ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রায় ১ দশকেরও বেশী সময় ধরে ডেঙ্গু সহ আরো যেসকল মশাবাহিত রোগ রয়েছে সেগুলো মোকাবেলায় কাজ করে যাচ্ছে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান World Mosquitoes Program. এই কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত গবেষকরা আমাদের আশার আলো দেখাচ্ছেন এই ভয়ঙ্কর মশার হাত থেকে বাঁচাতে।
উবাকিয়ার (Wolbachia) মাধ্যমে ডেঙ্গু নির্মূল
গবেষকরা এডিস মশার সাথে অন্যান্য মশা ও কীটপতঙ্গের পার্থক্য খুজতে গিয়ে একটি আশ্চর্যের বিষয় খুজে পান। উবাকিয়া (Wolbachia) নামের একটি খুবই নিরীহ ও ক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়া যেটা ফলের পোকা, মৌমাছি, ফড়িং, প্রজাপতি, মশা সহ প্রকৃতিতে বসবাসকারী প্রায় ৬০ শতাংশ পোকামাকড়ের মধ্যেই পাওয়া যায় এবং পরবর্তি প্রজন্মের মধ্যেও স্থানান্তরিত হয়।
তবে আশ্চর্যের যে বিষয় হচ্ছে, ডেঙ্গু ভাইরাস বহনকারী কোন এডিস মশার মধ্যে উবাকিয়া ব্যাকটেরিয়ার অস্তিত্ব খুজে পাওয়া যায়নি। মুলত এই আবিষ্কারটিই ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজ্ঞানীদের জন্য পথ দেখিয়েছে।
এর পরের প্রচেষ্টাটি ছিলো কিভাবে এই উবাকিয়া ব্যাকটেরিয়াটি এডিস মশার শরীরে ঢোকানো যায়। বিজ্ঞানীরা সূক্ষ্ম একটি সুচের মাধ্যমে প্রথমে উবাকিয়া ব্যাকটেরিয়া সংগ্রহ করেছেন। এর পরে সেই ব্যাকটেরিয়াটি এডিস মশার ডিমের মধ্যে ইনজেক্ট করে ঢুকিয়েছেন।
তবে এটা যে খুব সহজ ছিলো তা কিন্তু না, এটার জন্য হাজার হাজার বারেও বেশি সময় চেষ্টা করতে হয়েছে তাদের। তার জন্য সময় লেগেছে প্রায় এক দশকেরও বেশি সময়। এর পরে বিজ্ঞানীদের আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
ডিম থেকে জন্ম নেওয়া এডিস মশার শরীরে উবাকিয়ার উপস্থিতি পাওয়া যায় যা ডেঙ্গু সংক্রমন রোধ করার সাথে সাথে বংশ বিস্তারের মাধ্যমে প্রকৃতিতে উবাকিয়া ব্যাকটেরিয়া সমৃদ্ধ মশার বিস্তার ঘটাতে সক্ষম।
প্রথমে অস্ট্রেলিয়াতে দশ সপ্তাহ ধরে প্রতি সপ্তাহে ১ বার প্রকৃতিতে উবাকিয়া মশা ছাড়া হয়েছে। এবং এর কয়েক মাস পরে পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, সেখানকার প্রায় ১০০ ভাগ মশাতেই উবাকিয়া ব্যকাটেরিয়ার উপস্তিতি রয়েছে যা এখনও অব্যাহত রয়েছে।
এরই ধারাবাহিকতায় ইন্দোনেশিয়ার যোগকর্তায় ডেঙ্গু নির্মূলে সেটআপ দেওয়া হয়েছিলো একটি ল্যাব। আসুন যেনে নেওয়া যাক তার কার্যক্রম ও সফলতা।
ডেঙ্গু নির্মূলে উবাকিয়া (Wolbachia) সফলতা
ডেঙ্গু এবং অন্যান্য মশাবাহিত যেসব রোগ আছে সেগুলোর বিস্তার বন্ধে ইন্দোনেশিয়ার যোগকার্তায় পরিচালিত হচ্ছে World Mosquitoes Program এর একটি কার্যক্রম। প্রথমে ল্যাব সেটাপের ডেঙ্গু নির্মূল কার্যক্রম সফল হলেও, জরুরী ছিলো প্রকৃতিতে সরাসরি তা পরীক্ষা করে দেখা।
তবে লোকালয়ে উবাকিয়া মশা ছেড়ে দিয়ে পরীক্ষা চালানোটা ছিলো অনেক দুরহ একটি কাজ। গবেষকরা সাধারণ মানুষের বিশ্বাস অর্জনের জন্য নিবীড়ভাবে কাজ করেছেন। হাজারো মানুষের সাথে কথা বলে তাদের কৌতুহলগুলো জেনেছেন তাদের প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এবং কার্যক্রমটি এগিয়ে নিয়েছেন।
এর পরে সেখানকার আশে পাশে মুলত যেখানে ডেঙ্গু জ্বর বা ডেঙ্গু সংক্রমণের প্রকোপ বেশি সেকল স্থানে কিছু উবাকিয়া ব্যাকটেরিয়া বহণকারী মশা ছেড়ে দেওয়া হয়। যদিও জনগনের বিশ্বস অর্জনে প্রায় ১ বছরেরও বেশি সময় লেগেছে, তবে এই প্রচেষ্টা বৃথা যায়নি।
গত জুন মাসে নিউ ইংল্যান্ড জর্নাল অফ মেডিসিন যোগকর্তায় উবাকিয়া ব্যাকটেরিয়া বহনকারী মশা প্রয়োগের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করে। ফলাফলে দেখা যায়, উবাকিয়া ব্যকটেরিয়া বহনকারী মশা কমিউনিটিতে ছেড়ে দেওার পরে ৭৭ শতাংশ ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা কমে গেছে এবং ডেঙ্গু সংক্রমনের ফলে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সংখ্যা কমেছে ৮৪ শতাংশ।
চিকিৎসা সম্পর্কিত আরো লেখা.. |
---|
সিনথেটিক বায়োলজি (Synthetic Biology) একবিংশ শতাব্দীর চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং… |
ডেঙ্গু নির্মূলে ভবিষ্যত কার্যক্রম
বর্তমানে শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম, ব্রাজিল, কলম্বিয়া, মেক্সিকো এবং ফিজির মত যে সকল স্থানে ডেঙ্গু জ্বর বা ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি সেকল স্থানে World Mosquitoes Program টির উবাকিয়া কার্যক্রম প্রসারিত করার কাজ চলছে।
আশা করা হচ্ছে এই উবাকিয়া প্রচেষ্টাটি শুধুমাত্র ডেঙ্গুর ক্ষেত্রেই নয় জিকা ভাইরাস, ইয়েলো ফিভার এবং এডিস মাশা বা এডিস ইজিপ্টি মশা দ্বারা সংক্রমিত অন্যান্য রোগ প্রতিরোধেও সমানভাবে কার্যকর হতে পারে।
ডেঙ্গুর ঝুকিতে থাকা এলাকাগুলোতে এই কর্মসূচীর প্রভাব কতটা তা নির্ধারণ করা দুরহ বিষয়। তবে এটা বলা যায় যে, এই প্রচেষ্টা মানুষের অসুস্থ থাকার সময় হ্রাস করে অনেক কর্মঘন্টার সাশ্রয় করবে যা অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখবে।