মূলত স্টীম ইঞ্জিন আবিষ্কারের পর থেকেই তাপগতিবিদ্যা (থার্মোডাইনামিক্স) নিয়ে নাড়াচাড়া বিশেষভাবে শুরু হয়, যদিও এ সম্বন্ধে কনসেপ্ট ১৭৯৮ সালের পর থেকেই স্যার বেঞ্জামিন থমসনের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল। ফরাসী বৈজ্ঞানিক সাদী কার্নোট তাপগতিবিদ্যা নিয়ে কাজ করেন যা পরবর্তীতে রূডলফ ক্লসিয়াস সুত্র আকারে প্রকাশ করেন, যিনি ছিলেন একাধারে একজন জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী এবং অঙ্কশাস্ত্রবিদ।
তাপগতিবিদ্যা (Thermodynamics)
থার্মোডাইনামিক্স হচ্ছে তাপ, শক্তি, তাপমাত্রা এবং কাজের ভিতরকার অন্তর্হিত সম্পর্ক। আগে তাপ কে কোন শক্তি হিসাবে মনে করা হতোনা, কিন্তু থার্মোডাইনামিক্স আবিষ্কারের পর দেখা যায় প্রত্যেক কাজ সম্পন্ন হওয়ার সময় কিছু না কিছু তাপ উৎপাদিত হয় এবং এটাকে সুত্রায়িত করা যায়। বিভিন্ন ধরনের সিস্টেমের মধ্যে তাপের আদান-প্রদান থার্মোডিনামিক্সের মূল বিষয়। পরবর্তীতে থার্মোডাইনামিক্স সুত্রের প্রয়োগ শুধু পদার্থবিদ্যা বা প্রকৌশ্যল বিদ্যায় থেমে থাকেনি, মহাবিশ্ব, রসায়নবিদ্যা এবং বিভিন্ন বায়োলজিক্যাল সিসটেম ব্যাখ্যায়ও এর ব্যবহার হয়েছে এবং হচ্ছে।
তাপগতিবিদ্যার সিস্টেমসমূহ (Types of Thermodynamic System)
মহাবিশ্বের কোন একটা অংশ বা মহাবিশ্বের পুরোটাই সিস্টেম (System) হিসাবে কাজ করতে পারে। একটা ফ্রিজের ভিতরের অংশটাও একটা সিস্টেম হতে পারে। সিস্টেম এর বাউন্ডারী (Boundary) থাকে আর এই বাউন্ডারীর বাইরে যা কিছু আছে, যার প্রভাব সিস্টেম উপর পড়তে পারে সেটাই হচ্ছে সিস্টেমের সারাউন্ডিংস (Surroundings).
সাধারনত তিন ধরনের সিস্টেম আমরা কল্পনা করতে পারি।

১। আইসোলেটেড সিস্টেম (Isolated system)– এখানে সিস্টেম এবং তার পারিপার্শিকতা সম্পুর্ন আলাদা থাকে। কোন ধরনের শক্তি, পদার্থ ইত্যাদির বিনিময় এদের ভিতর হয়না। আমাদের মহাবিশ্বকে একধরনের আইসোলেটেড সিস্টেম হিসাবে বিবেচনা করতে পারি। এখন পর্যন্ত জানা যায়নি যে আমাদের মহাবিশ্ব অন্য কোন মহাবিশ্বের সাথে শক্তি বা বস্তুর আদান প্রদান করছে বা করেছে।
২। ক্লোজড বা আবদ্ধ সিস্টেম (Closed system)– যখন সিস্টেমের ভিতর বাইরে থেকে শুধুমাত্র শক্তি ঢুকতে পারে, কিন্তু কোন পদার্থ ঢুকতে পারে না।
৩। ওপেন বা উন্মুক্ত সিস্টেম (Open system)– যখন সিস্টেমের ভিতর বাইরে থেকে শক্তি আর পদার্থ দুটোই ঢুকতে অথবা বের হতে পারে।
তাপগতিবিদ্যার সুত্র সমূহ (Law of Thermodynamics)
জিরো সুত্রঃ
এখানে বলা হচ্ছে যে বিভিন্ন মাধ্যমের মধ্যে শক্তির আদান প্রদান হতে পারে তাপ, কাজ অথবা পদার্থের আদান প্রদানের মাধ্যমে। এই সুত্র আরও বলছে যে, যদি দুইটা সিস্টেম অন্য একটা সিস্টেমের সঙ্গে সাম্যাবস্থায় থাকে, তবে পুর্বোক্ত দুইটি সিস্টেমও পরষ্পরের সঙ্গে সাম্যাবস্থায় থাকবে।

প্রথম সুত্রঃ
প্রথম সুত্রটি মূলত শক্তির অবিনাশীবাদ সুত্র (Law of Conservation of Energy)। শক্তি তৈরীও হয়না, ধ্বংসও হয়না, শুধুমাত্র রূপান্তরিত হয়। যেমন বিদ্যুৎ থেকে চুম্বক তৈরী করা আবার চুম্বক থেকে বিদ্যুৎ তৈরী করা।
দ্বিতীয় সুত্রঃ
যে কোন আইসোলেটেড সিস্টেম এর এন্ট্রোপি (Entropy- Disorderliness) বা অগোছালোভাব আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে, এবং একটা সাম্যাবস্থায় (Equilibrium) না পৌছানো পর্যন্ত এটা চলতেই থাকে।
তৃতীয় সুত্রঃ
চরম শূন্য তাপমাত্রায় এন্ট্রোপির পরিমান স্থির মানে পৌঁছয়।
সুস্থিতি (Homeostasis):
পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে চলা (Adaptation) আমাদেরকে টিকে থাকতে সাহায্য করে, আর প্রতিদিনকার, প্রতি মূহুর্তের যে প্রচেষ্টা আমাদেরকে পরিবর্তিত পরিস্থিতির বিপরীতে সুরক্ষা দেয় সেটাকে আমরা সুস্থিতি বা হোমিওস্টাসিস বলতে পারি।
সুস্থিতি ঠান্ডা আবহাওয়ায় উষ্ণ রক্তের প্রানীদের তাপমাত্রা গ্রহনযোগ্য মাত্রায় রাখে, আমাদের রক্তের অম্লত্ব খারত্ব, জলীয় পদার্থের হ্রাসবৃদ্ধি, ইলেক্ট্রলাইট ব্যালাঞ্চ, পুষ্টি, হরমোন ইত্যাদি নানারকম ভারসাম্য রক্ষা করে। এই সুস্থিতি বজায় রাখার জন্য আমাদের মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ যেমন হাইপোথালামাস (Hypothalamus), পুরো স্নায়ুতন্ত্র (Nervous System), অন্তক্ষরা গ্রন্থিসমূহ (Endocrine Glands) ইত্যাদি মূল দায়িত্ব পালন করে থাকে, তার সাথে সহযোগিতা করে থাকে অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গ, তন্ত্র সমূহ।
বিপাক প্রক্রিয়ায় খাদ্য পুড়ে শক্তি তৈরী হয়, তা মজুদ থাকে বিভিন্ন রাসায়নিক বস্তুর আকারে। এখানে তাপগতিবিদ্যার (থার্মোডাইনামিক্সের) প্রথম সুত্র নিবিড়ভাবে কাজ করে। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রন, বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়ার ব্যাখ্যায় থার্মোডাইনামিক্সের সুত্রসমূহ নিবিড়ভাবে জড়িত। থার্মোডাইনামিক্সের প্রভাব জীব-জড় উভয়ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্যভাবে প্রযোজ্য। জীবন তার বিভিন্ন ধরনের সুস্থিতি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখে তার বিকাশ এবং প্রজনন ঘটায়।
বিবর্তন এবং তাপগতিবিদ্যার (Evolutions and Thermodynamics)
বিবর্তন জীবন ধারণ এবং বিকাশের জন্য অপরিহার্য। বিবর্তনবাদ এখন বিজ্ঞানের সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। কেউ কেউ বলে থাকেন, বিবর্তনবাদ থার্মোডাইনামিক্সের দ্বিতীয় সুত্রকে অস্বীকার করে। এখানে বঝার একটু সমস্যা রয়েছে।

আসলে বায়োলজিক্যাল ইভুলুশ্যন একটা জটিল প্রক্রিয়া আর বায়োলজিক্যাল সিস্টেম অনেকগুলো ছোট ছোট অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সমষ্টি শুধু নয়, বরং তার থেকে উত্তরণ। তাছাড়া বিবর্তন কাজ করছে পৃথিবীর প্রেক্ষিতে, আর পৃথিবী কোন আইসোলেটেড বা বিচ্ছিন্ন সিস্টেম নয়, সুর্যের আলোর বিরাট প্রভাব রয়েছে প্রানের বিস্তারে, যা প্রানের বিস্তার এবং বিকাশ লাভে প্রচুর প্রভাব ফেলে থাকে।
সুতরাং দ্বিতীয় সুত্র যেমন বলে থাকে আইসোলেটেড সিস্টেমে ক্রমশঃ এন্ট্রোপি বাড়তে থাকে এবং প্রানের সৃষ্টির মত জটিল প্রক্রিয়া সেখানে চলতে পারেনা। কিন্তু পৃথিবী যেহেতু সম্পুর্নভাবে আইসোলেটেড সিস্টেম নয়, সুতরাং বিবর্তনবাদের সঙ্গে বিরোধের প্রশ্ন এখানে কার্যকর নয়।
উপসংহারঃ
উষ্ণ এবং শীতল রক্তের প্রানীদের বেঁচে থাকতে হয় অনবরত সুস্থিতি কায়েম করে। সুস্থিতি আপাত দৃষ্টিতে থার্মোডাইনামিক্সের বিরোধিতা করলেও সুক্ষভাবে বিচার করলে দেখা যায় এটা থার্মোডাইনামিক্স নিয়ম মেনেই চলে। এভাবেই চলতে থাকে জীবনের পরিব্যাপ্তি আর তাপগতিবিদ্যার অবিমিশ্র প্রয়োগ।