সাম্প্রতিক সময়ে ব্রিটিশ চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বাচ্চার জন্মগত হার্টের ত্রুটি সারানোর জন্য নাভিরজ্জুর স্টেম সেল ব্যবহার করেছেন। ফলে আবার নতুন করে আলোচনায় উঠে এসেছে অ্যাম্বিলিক্যাল কর্ডের রক্ত বা ইউ সি বি এবং এতদসংক্রান্ত যাবতীয় গবেষণা।
ব্রিটিশ চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা অপারেশন করে একটা হার্টের ছিদ্রকে সারিয়ে তুলেছেন স্টেম সেল ব্যবহার করে, এবং তাদের এই সাফল্য মিডিয়াতে ব্যাপক প্রচার পেয়েছে। আশা করা হচ্ছে ভবিষ্যতে আরও বেশী স্টেম সেল ব্যবহৃত হবে আরও নানা ধরনের চিকিৎসায় এটা নিশ্চিত।
১৯৮৯ সালে স্টেম সেল ব্যবহারের প্রথম রিপোর্ট প্রকাশের পরে বিষয়টি নিয়ে বেশ উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। এবং ১৯৯৩ সালের ভিতর প্রায় ৪০ হাজার স্টেম সেল বিভিন্ন কারনে প্রতিস্থাপন করা হয়। এবং ২০২০ সাল নাগাদ ব্যাংকে সংরক্ষিত ইউসিবির সংখ্যা গিয়ে দাড়ায় প্রায় ৫০ লক্ষের উপরে।
বিভিন্ন পাবলিক বা প্রাইভেট ব্যাংকে এই ব্লাড সংগ্রহ করা হচ্ছে। পাবলিক ব্যাংকে রাখলে ডিজিট্যাল ম্যাচিং এর মাধ্যমে আমজনতা ব্যবহার করতে পারে, আর প্রাইভেট ব্যাংকে জমা রাখলে তা সেই বাচ্চা বা নিকট আত্মীয়স্বজন ব্যবহার করতে পারে।
ব্লাড ব্যাংকে সংরক্ষিত নিম্ন তাপমাত্রায় ২০ বছরের অধিক সময় মজুদ রাখা যাচ্ছে এবং তা কার্যকরভাবে ব্যবহার করাও যাচ্ছে। আগে যেখানে ৩ থেকে ৪ মাস সময় লাগতো অস্থিমজ্জা (Bone marrow) অথবা ব্লাড (Peripheral blood) থেকে রক্ত সংগ্রহ করে পুর্নবয়ষ্ক স্টেম সেল সংগ্রহ করতে এখন ব্যাংকিং এবং ডিজিট্যাল ম্যাচিং (Matching) পদ্ধতি ব্যবহার করে তা ৩-৪ সপ্তাহে নামিয়ে নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে।
বিভিন্ন দুরারোগ্য ব্যাধিতে এখন এই স্টেম সেল ব্যবহার করা হচ্ছে, যেগুলো নিয়ে আমরা নিচে সংক্ষেপে আলোচনা করবো।
নাভিরজ্জুর রক্ত কিভাবে সংগ্রহ করা হয়?
সাধারণত জন্মের সাথে সাথেই বাচ্চার নাভিরজ্জুর শিরা থেকে সিরিঞ্জ দিয়ে টেনে অথবা সাধারণভাবে যেভাবে ব্লাড সংগ্রহ করা হয় এমন পদ্ধতিতে শিরাকে সূচ দিয়ে পাংচার করে ব্লাডের ব্যাগকে নীচুতে রেখে গ্রাভিটি ড্রেইনেজের মাধ্যমে তা সংগ্রহ করা হয়।
বাচ্চার নাভিরজ্জু বাঁধার পরেই তা সংগ্রহ করা হয়, যার ফলে বাচ্চার কোন ক্ষতি হয়না। আবার প্লাসেন্টা বা ফুল নির্গত হওয়ার আগেও কর্ড থেকে ব্লাড সংগ্রহ করা যেতে পারে।
মূলত, যে জিনিসটা আমরা সচরাচর ফেলে দিই, সেখান থেকেই এই কর্ড ব্লাড সংগ্রহ করা হয়, যার ফলে বাচ্চা বা মায়ের শারীরিক কোন ক্ষতি হবার সম্ভাবনা থাকে না। এটা সংগ্রহের জন্য সাধারন রক্তজমাট বাঁধা (Anticoagulant drug) প্রতিরোধকারী ব্যবহার করলেই চলে।
বিভিন্ন রোগে নাভিরজ্জুর ব্লাডের ব্যবহার
কর্ড ব্লাড মূলত দুই ধরনের, ১. এলোজেনিক কর্ড ব্লাড (Allogeneic cord blood): -এখানে অন্য মানুষের একই গ্রুপের ব্লাড ব্যবহার করা হয়। এবং ২. অটোলোগাস কর্ড ব্লাড (Autologous cord blood) – এখানে নিজের সংরক্ষিত ব্লাড নিজের শরীরে ব্যবহার করা হয়। চিকিৎসাও করা হয় তিন গ্রুপের ব্যক্তিদেরকে।
- প্রমানিত চিকিৎসা (Standard treatment): এখানে চিকিৎসা পদ্ধতি বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরিক্ষার মাধ্যমে প্রমানিত হবার পর বেশ কিছুদিন ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
- মানুষের উপর পরীক্ষণ প্রক্রিয়ায় (Clinical trial) আছে এমন চিকিৎসা, এবং
- এখনও পরীক্ষাগারে পরীক্ষন প্রক্রিয়ায় (Experimental trial) আছে এমন চিকিৎসা।
মোটাকথা যেসব রোগের চিকিৎসায় নাভিরজ্জুর ব্লাডের ব্যবহা করা হয়ে থাকে তা নিম্নরুপঃ
- বিভিন্ন ধরনের ব্লাড বা লিম্ফয়েড টিস্যুর ক্যান্সার (Leukaemia, Lymphoma)।
- বিভিন্ন ধরনের রক্ততৈরির অসুবিধাজনিত রক্তশুন্যতা (Bone marrow failure, Myeloproliferative disorder)।
- বিভিন্ন ধরনের ইমিউন ডিসঅর্ডার।
- স্ট্রোক বা বিভিন্ন ধরনের স্নায়বিক রোগ।
- চুল উঠে যাওয়া।
- লিভার, কিডনি ও প্যানকৃয়াসের রোগ।
এছাড়াও জীনগত কারনে বিভিন্ন স্টোরেজ রোগ (Glycogen storage disease, Lipid storage disease etc.) হলে এর চিকিৎসায় নাভীরজ্জুর ব্লাড অথবা নাভিরজ্জুর টিস্যু ব্যবহার করা হচ্ছে।
নাভীরজ্জুর টিস্যুও সংগৃহীত হচ্ছে নাভীর হোয়ার্টন জেলীর টিস্যু থেকে। একসময় এসব রোগের কোন চিকিৎসা ছিলনা, তবে এখন এসব রোগীরা কিছুটা আসার আলো দেখতে পারছেন।
এছাড়া বিভিন্ন ধরনের নিউরোলজিক্যাল ডিজিস যেমন এলঝেইমার ডিজিস, সেরিব্রাল পলসি, স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি, ডায়াবেটিস, হার্ট ফেইলিওর, হাত-পায়ের রক্তনালীর রোগ ইত্যাদির চিকিৎসায় পরীক্ষামূলকভাবে এর ব্যবহার চলছে। এবং দিনে দিনে এই তালিকা আরও বড় হচ্ছে। সবার সুবিধার জন্য একটি তালিকাটা নিচে দেওয়া হলো।
কর্ড ব্লাডের সমস্যা
মূলত আইনগত দিক, যেমন অবহিত সম্মতিপত্র (Informed consent), কর্ড ব্লাডের মালিকানা এবং এর বিতরণ, বিভিন্ন ধরনের রিজেকশন, ইমিউন রেসপন্স ইত্যাদি। তাছাড়াও পুর্নবয়ষ্ক মানুষের জন্য অনেক স্টেম সেলের প্রয়োজন হয়, যার জন্য কয়েকজনের কাছ থেকে কর্ড ব্লাড নিতে হয়।
এর বদলে এডাল্ট বোন ম্যারো স্টেম সেল নেওয়া যেতে পারে, কিন্তু সেখানে কিছুটা হলেও সংগ্রহের সময় ব্যাথা বেদনার একটা ব্যাপার থেকেই যায়, তাছাড়াও রয়েছে রিজেকশনের ভয়। দেশে কর্ড ব্লাড সংগ্রহের ব্যবস্থা এবং এব্যাপারে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষন দিলে কর্ড ব্লাড একটা বিশেষ চিকিৎসা পদ্ধতি হয়ে উঠতে পারে।