একসময় মেডিক্যাল সার্জনরা মনে করতেন হার্ট অপারেশন করা মারাত্মক খারাপ কাজ এবং হার্টের উপর অপারেশন না করার জন্য থিউওডোর বিলরথের (Theodor Billroth, ১৮২৯-১৮৯৪) মত ডাকসাইটে সার্জনরাও উৎসাহিত করেছেন। কিন্তু বিজ্ঞান কোন ব্যাক্তির মতামতের কাছে আবদ্ধ থাকতে পারে না।
সুতরাং ১৮০১ সালের ফ্রান্সিস্কো রোমেরো (Francisco Romero) কতৃক হার্টের পর্দা বা পেরিকার্ডিয়ামের সেলাই করার উপরেই থেমে থাকেনি এই প্রচেষ্টা। ১৮৯৫ সালেই একজন ছুরিকাহত লোকের হার্টের করোনারীর রক্তক্ষরণ বন্ধ করেছিলেন এক্সেল চ্যাপেলেন নামের একজন সার্জন, রোগী যদিও মাত্র ৩ দিন বেঁচে ছিল।
এরপর মহাধমনী এবং হার্টের ভিতরে এবং বাইরে বিভিন্ন ধরনের সার্জারীর সফল-অসফল চেষ্টা চলেছে। ছোট বাচ্চাদের বরফে ঠান্ডা করে হার্টের ত্রুটি সংশোধনের চেষ্টা করা হয়েছে আঙ্গুল দিয়ে। পরবর্তীতে টাবস ডাইলেটরের মাধ্যমে সরু হয়ে যাওয়া ভাল্ভ মেরামতের চেষ্টা করা হয়েছে দীর্ঘদিন।
এই পদ্ধতিগুলোকে আমরা হার্ট-লাংস মেশিন ব্যবহারের পুর্ব পর্যায় বলতে পারি। হার্ট-লাংস মেশিন ব্যবহার করে ডাঃ গিবন ১৯৫৩ সালে প্রথম এএসডি (Atrial Septal defect, ASD) অপারেশন করেন। এবং এরই সাথে সাথে শুরু হয় হার্টকে সাময়িকভাবে বন্ধ রেখে হার্টের অভ্যন্তরের ত্রুটি-বিচ্যুতি সারিয়ে তোলার প্রতিযোগিতা।
এ সম্পর্কিত আরও লেখা
আস্তে আস্তে হার্ট-লাংস মেশিন দিয়ে অপারেশন করতে গেলে বিভিন্ন জটিলতা ধরা পড়লো। কার্ডিওপ্লেজিয়ার (Cardioplegia) বিভিন্ন রকম পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে লাগলো, গবেষণা চলতে লাগলো বিভিন্ন ধরনের কার্ডিওপ্লেজিয়া নিয়ে, হাইপোথারমিয়া (Hypothermia) নিয়ে, হার্টকে বন্ধ না করে হার্টের পৃষ্ঠদেশের উপর অপারেশন করতে (Beating heart surgery), ছোট করে কেটে (Minimally Invasive surgery, MICS) সার্জারী করতে।
আমরা নীচে পর্যায়ক্রমে সংক্ষিপ্তভাবে হার্টের অপারেশনের বিভিন্ন দিক, কার্ডিওপ্লেজিয়া, হাইপোথারমিয়া ইত্যাদির ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করবো।
হার্টের অপারেশন কেন আলাদা?
হার্টের অপারেশন অন্যান্য অপারেশন থেকে বেশ জটিল ও আলাদা, আসুন জেনে নেওয়া যাক সেই সকল বিষয়গুলো।
অপারেশন পুর্ববরতী কেয়ার
অনেক ক্ষেত্রেই রোগী অপারেশনের যোগ্য থাকেন না, তখন তাকে বিভিন্ন চিকিৎসা দিয়ে আগে অপারেশনের যোগ্য করে তোলা হয়। এতে অনেক সময় বেশ কয়েকদিনের প্রস্তুতি লাগে। রোগীর কো-মর্বিডিটি যেমন অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে আনা, থাইরয়েডের চিকিৎসা করা, হার্ট ফেইলিয়োর থাকলে তার চিকিৎসা করা, এনেমিয়া, অপুষ্টি ইত্যাদির চিকিৎসা করা ইত্যাদি। এই চিকিৎসা ঠিকমত না হলে মূল চিকিতসার ফলাফল ভাল হয় না।
হার্টের অপারেশনের পদ্ধতি
হার্ট হচ্ছে সারা শরীরের রক্ত সরবরাহের জন্য কেন্দ্রীয় যন্ত্র, সারা শরীর থেকে আসা দূষিত রক্ত এসে হার্টের ডান দিকের চেম্বারে জমা হয় সেটাকে পাম্প করে ফুস্ফুসের মাধ্যমে শোধিত হয়ে হার্টের বাম দিকের চেম্বারে আসার পর তাকে আবার পাম্প করে মহাধমনীর মাধ্যমে সারা শরীরে রক্ত সঞ্চালিত করা হয়।
ওপেন হার্ট সার্জারীর জন্য শরীরের সমস্ত রক্ত নলের মাধ্যমে একটা কৃত্রিম চেম্বারে নিয়ে আসা হয়, সেখান থেকে অক্সিজেনেটরের (মেশিনের লাংস) মাধ্যমে অক্সিজেন যুক্ত করে এবং কার্বন ডাই অক্সাইড বিযুক্ত করে পাম্প (মেশিনের হার্ট) করে সারা শরীরে সরবরাহ করা হয়।
অক্সিজেনেটর চেম্বারের নীচের আর একটা চেম্বারের মাধ্যমে গরম-ঠান্ডা পানি প্রবাহিত করে রক্তকে প্রয়োজন অনূযায়ী গরম বা ঠান্ডা করা হয় এবং হার্টকে ক্রস ক্ল্যাম্পের মাধ্যমে মূল রক্ত পরিসঞ্চালন পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়।
হার্টকে তখন বাঁচিয়ে রাখার জন্য ঠান্ডা করে রাখা হয় এবং কার্ডিয়োপ্লেজিয়া সলুশ্যনের মাধ্যমে হার্টকে থামিয়ে রেখে হার্টের অভ্যন্তরের ত্রুটি-বিচ্যুতি সারিয়ে তোলা হয়। হার্টের ভিতর আটকে থাকা বাতাস বের করার পর হার্টকে আবার চালু করা হয় এবং ধীরে ধীরে হার্ট-লাংস মেশিনের কাজ কমিয়ে নিয়ে আসা হয় এবং দেহের হার্ট- লাংস কাজ শুরু করার পর মেশিন বন্ধ করা হয়।
কোন কোন ক্ষেত্রে আগে অক্সিজেনেটর পরে পাম্প, আবার কোন কোন ক্ষেত্রে আগে পাম্প পরে অক্সিজেনেটর ব্যবহার করা হয়, এর ভিতর আরও অনেক পদক্ষেপ রয়েছে কিন্তু বুঝার সুবিধার জন্য সেগুলো বাদ দেওয়া হলো।
ক্লোজড হার্ট সার্জারী ক্ষেত্রে হার্টকে বন্ধ না করে হার্টের ভিতরকার অপারেশন (যেমন সিএমসি অপারেশন, পিডিএ অপারেশন) ইত্যাদি করা হয় এবং বিটিং হার্ট পদ্ধতিতে হার্টকে চালু রেখে হার্টের গাত্রদেশের উপর অপারেশন (যেমন Beating heart CABG) করা হয়। দেহের অন্য কোন অর্গানের অপারেশনে হার্টকে এইভাবে বন্ধ করে অপারেশন করা হয় না।
হার্ট লাংস মেশিনের সমস্যা হলো কোন কোন রোগীর ক্ষেত্রে সারা শরীরে একজাতীয় প্রদাহের সৃষ্টি করা, যার ফলস্রুতিতে নানাধরনের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের কর্মক্ষমতা বিঘ্নিত হতে পারে। হাইপোথারমিয়া বা ঠান্ডা করার মূল সমস্যা অপারেশন পরবর্তী রক্তক্ষরন, আর কার্ডিওপ্লেজিয়ার মূল সমস্যা হার্টের কর্মক্ষমতা সঠিকভাবে রক্ষা করতে না পারা। এখানেই হচ্ছে অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞানের প্রশ্ন। এই সব কিছুর উপযুক্ত এবং পরিমিত কম্বিনেশনই সবচেয়ে ভালো ফলাফল দিতে পারে।
হার্টের অপারেশনের আরেকটি বৈশিষ্ট হলো হার্টকে অপারেশনের অব্যবহিত পরেই পুরো কার্যক্ষমতা নিয়ে কাজ করতে হয়। যেমন, রোগীর হাড় ভেঙ্গে গেলে প্লাস্টার করে শুইয়ে রাখতে পারবেন, পাকস্থলী বা পরিপাকতন্ত্রের অসুবিধায় না খাইয়ে, স্যালাইনের মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখতে পারবেন।
কিন্তু হার্ট অপারেশনের অব্যবহিত পরেই হার্টের কাজ ফেরানো না গেলে সে রোগীকে বাঁচিয়ে রাখা কঠিন হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে নানারকম এসিস্ট ডিভাইস, কৃত্রিম হার্ট অথবা ট্রান্সপ্লান্টেশন ছাড়া বিকল্প থাকে না।
অপারেশন পরবর্তী কেয়ার
হার্ট অপারেশনের পর রোগীকে ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিটে স্থানান্তর করা হয়। ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিটে বিভিন্ন ধরনের ক্লোজ মনিটরিং এর ভিতরে রোগীকে রাখা হয়।
এখানে বিভিন্ন ভাইটাল সাইন ছাড়াও রোগীর রক্তক্ষরন, প্রসাবের পরিমান, শরীরে পানির ব্যালান্স, লবনের ব্যালান্স, এসিড-বেসের ব্যালান্স, রোগীর খাদ্য ও পুষ্টির ব্যাপারে তদারকি, হার্টের ছন্দপতন, হার্ট ব্লক, ইনফেকশন প্রতিরোধ ও প্রতিকার ইত্যাদি নিবিড় পর্যবেক্ষনের মধ্যে রাখা হয়।
রোগীর অবস্থার উন্নতি হলে তাকে এইচ ডি ইউ (HDU- High dependency unit) তে স্থানান্তর করা হয় এবং রোগীর ছুটির ব্যবস্থা করা হয়।
রোগীর ফলো-আপ
রোগীর ফলো-আপ রোগ অনূযায়ী ভিন্ন ভিন্ন হয়, এবং এর সময়ক্রমও আলাদা হয়। রোগীর ছুটি তাড়াতাড়ি হলে সেলাই কাটার সময়, ১মাস, ৩ মাস, ৬ মাস তারপর প্রতিবছর ফলো আপ করা হয়।
কৃত্রিম মেকানিক্যাল ভাল্ভের ক্ষেত্রে প্রতি ৩ মাস অন্তর PT with INR পরীক্ষা করে রোগীর ওয়ারফেরিনের ডোজ নির্ধারন করা লাগে। ফলোআপের এই সময়ক্রম পরিস্থিতি অনূযায়ী পরিবর্তিত হতে পারে।