হার্ট মানবদেহের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি পেশীবহুল অঙ্গ। এটি শরীরের ভেতরে যেসকল রক্তনালী রয়েছে সেগুলিকে একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ২৪ ঘন্টা রক্ত সঞ্চালনের কাজ করে। তবে বিভিন্ন কারনে হার্টের এই রক্ত সঞ্চালনের কাজটি ব্যাহত হতে পারে, এবং তৈরি হতে পারে মৃত্যূ সম্ভাবনা।
এমতাবস্থায় হার্টের রক্ত সঞ্চালনের কাজটি স্বাভাবিক করতে প্রয়োজন হয় চিকিৎসকের তত্বাবধানে মেডিকেশন বা কোন কোন ক্ষেত্রে হার্টের অপারেশন। তবে হার্ট অপারেশন এর ক্ষেত্রে বেশিরভাগ রোগী ঠিক করতে পারেন না যে, ঠিক কখন অপারেশনটি করাবেন, তাদের জন্যই মুলত এই লেখাটি। আসুন জেনে নেওয়া যাক হার্ট সার্জারীর জন্য সঠিক সময়টি কখন।
কেন হার্ট অপারেশন প্রয়োজন হয়?
বর্তমানে আধুনিক চিকৎসা বিজ্ঞানের কল্যাণে হার্টের রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে শধুমাত্র মেডিকেশন ছাড়াও বিভিন্ন ইন্টারভেনশনাল পদ্ধতি এবং সর্বোপরি হার্ট অপারেশন বা শল্য চিকিৎসা রয়েছে। শল্য চিকিৎসায় বুক কম করে কেটে বা ছিদ্র করে (MICS), টেলিস্কোপ বা স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মাধ্যমে করা হয়ে থাকে।
হার্টেরও আবার নানারকম রোগ রয়েছে যেগুলোর কোন কোনটির চিকিৎসার জন্য হার্ট সার্জারীর প্রয়োজন হয়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেঃ
- হার্টের জন্মগত ত্রুটি,
- হার্ট ভাল্ভের রোগ,
- করোনারী ধমনী ব্লক হয়ে যাওয়া,
- হার্টের ভিতরকার টিউমার।
এছাড়াও কিছু ব্যতিক্রমী রোগ রয়েছে সেগুলোর জন্যও হার্ট অপারেশনের প্রয়োজন পড়ে, যেমনঃ
- হার্ট স্ফীত হয়ে যাওয়া (Aneurysm, cardiomyopathy, Heart failure etc.)
- কোন কারনে হার্টের ছন্দপতন।
তাছাড়াও হার্টের রোগ শেষ পর্যায়ে পৌছিয়ে গেলে কৃত্রিম হার্ট জোড়া লাগানো অথবা হার্ট প্রতিস্থাপন, মহাধমনীর (Aorta) রোগ বিভিন্নপ্রকার সার্জিকাল চিকিৎসার আওতায় এসে পড়ে। আমাদের দেশের সাধারন প্রবণতা হচ্ছে হার্টের রোগের শল্যচিকিৎসা নিতে দেরী করা। এর জন্য রোগী, রোগীর আত্মীয়স্বজন, স্থানীয় কোয়াক, ঔষধের দোকানদার, রোগীধরা দালাল, অপরিণামদর্শী বিজ্ঞ ব্যক্তি ছাড়াও কিছু মেডিক্যাল চিকিৎসক দায়ী।
শেষপর্যন্ত রোগী যখন সার্জনের কাছে পৌছয় তখন তা শল্যচিকিৎসার গ্রহণযোগ্য রিস্কের বাইরে চলে যায় এবং মৃত্যুঝুঁকিসহ জটিলতা ঘটার সম্ভাবনা এতটাই বেড়ে যায় যে, হয় সার্জারী বাদ দিতে হয় অথবা হার্ট ট্রান্সপ্লান্টের মত সাধ্যাতিরিক্ত অপারেশনের দ্বারস্থ হতে হয়।
রোগীর ভিতর খুব স্বাভাবিকভাবেই অপারেশন ভীতি কাজ করে সব সময় তবে এটাও জেনে রাখা দরকার যে, অপারেশনের জন্য যত বেশী দেরী করবেন ঠিক ততটাই জটিলতা বেড়ে যাবার সম্ভাবনাও রয়েছে। এবং এর ফলে মৃত্যু ঝুঁকি বেঁড়ে যাবে অনেক গুনে। তাই সময়মত অপারেশনটা করে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
হার্টের অপারেশনের উপযুক্ত সময় কিভাবে নির্ধারন করবেন?
হার্টের রোগের জন্য অপারেশনের সঠিক সময় নির্ধারণ করতে বেশ কিছু কারন ও অবস্থার উপর নির্ভর করতে হয় যেমনঃ
- হার্টের রোগের প্রকারভেদ
- হার্টের রোগের লক্ষন ও লক্ষন প্রকাশের তীব্রতা
- অপারেশেনের জন্য রোগী শারীরিকভাবে উপযুক্ত কিনা
- হার্টের চিকিৎসার জন্য যে সকল সুবিধাদি থাকা প্রয়োজন তা সহজলভ্য কিনা
- অর্থনৈতিক অবস্থাসহ আরো কিছু বিষয়।
এত কিছুর পরেও সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তের উপর সর্বোপরি ফলাফল নির্ভর করে। কিছু কিছু হার্টের রোগ রয়েছে, যেমন: TGA, TAPVC, Tricuspid Atresia । এই ধরনের রোগের ক্ষেত্রে জন্মের সাথে সথেই মারাত্মক ধরনের অক্সিজেন শুন্যতাই আক্রান্ত হয়ে শিশুর শরীর পুরাপুরি নীল হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে প্রথমে ছোট একটি অপারেশনের মাধ্যমে আক্রান্ত শিশুর জীবন বাঁচানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর পরে শিশুটি যখন একটু বড় হয়, তখন মুল অপারেশনটি সম্পন্ন করা হয়।
আবার কোন কোন ক্ষেত্রে যদি একটু অপেক্ষা করার সুযোগ থাকে তবে, প্রথমের অপারেশনটি না করে একটু অপেক্ষা করে একবারেই মুল অপারেশনটি সম্পন্ন করা হয়। তাই এসকল ক্ষেত্রে ডাক্তারের দেওয়া বিজ্ঞানভিত্তিক সিদ্ধান্ত অবশ্যই গ্রহন করা উচিৎ।
কোন কোন জন্মগত ত্রুটির ক্ষেত্রে (যেমন ASD এর অপারেশন) জটিলতা ধারণ না করলে পূর্ণবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা যায়। তবে এক্ষেত্রে নিয়মিতভাবে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকতে হবে।
হার্টের রোগের অপারেশন সঠিক সময় ও কিভাবে হার্টের অপারেশন করলে সবচেয়ে ভাল ফল পাওয়া যাবে, এ বিষয়টি নিয়ে প্রতিনিয়ত গবেষণা চলছে। এবং গবেষনার ফলাফল নিয়মিতভাবে গাইডলাইন আকারে প্রকাশ করা হয়। এবং নতুন নতুন গবেষনার উপর ভিত্তি করে এসব গাইডলাইন নিয়মিত পরিবর্তিত, পরিমার্জিত এবং পরিশীলিত করা হয়।
আর এই গবেষনালদ্ধ গাইডলাইনগুলো প্রকাশ ও প্রচার করে আমেরিকান কলেজ অব কার্ডিওলজী, ইউরোপিয়ান সোসাইটি অব কার্ডিওলজির মত সংস্থাগুলো। যদিও প্রত্যেক রোগীর চিকিৎসা ভিন্ন, তবুও এসব গাইডলাইন বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য দিয়ে সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতি বেছে নিতে সহায়তা করে।
শেষ কথা
আপনি একাধিক চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহন করতে পারেন, যদি একাধিক মতামত পেয়ে থাকেন তবে সবচেয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক মতামতটি গ্রহণ করুন, প্রয়োজনে তৃতীয়পক্ষের মতামত জানুন কিন্তু কালক্ষেপণ করবেন না। সবসময় মনে রাখবেন সুস্থ হওয়ার জন্য প্রয়োজন সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা।