২০২১ সালের নভেম্বর, আর ২০২২ সালের শুরুতে চিকিৎসা বিজ্ঞান জগতে দুটো যুগান্তকারী ঘটনা ঘটেছে।জেনোট্রান্সপ্লান্টেশন পদ্ধতিতে শূকরের দেহ থেকে সংগৃহীত কিডনী এবং হৃৎপিণ্ড মানবদেহে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হয়েছে এবং তা এখনও পর্যন্ত ভালো ভাবেই কাজ করছে। তবে ট্রান্সপ্লানটেশনের আগে কিডনী এবং হৃৎপিন্ডকে জেনেটিক পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রতিস্থাপনের উপযোগী করে তোলা হয়েছে।
যুগান্তকারী ঘটনা বলা হচ্ছে এই জন্য যে, অসংখ্য মানুষ যারা অঙ্গহানির জন্য নিশ্চিত মৃত্যর জন্য অপেক্ষা করছেন তারা আবার নতুন করে জীবন ফিরে পাবেন। আসুন জেনে নেওয়া যাক আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের বর্তমান সময়ের বহুল আলোচিত বিষয় জেনোট্রান্সপ্লান্টেশন সম্পর্কে।
জেনোট্রান্সপ্লান্টেশনের প্রয়োজনীয়তাঃ
বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের রোগ যখন শেষ পর্যায়ে এসে পড়ে, তখন অংগ প্রতিস্থাপনের জন্য অপেক্ষা করতে করতেই প্রতিবছর অসংখ্য মানুষ মারা যায়। আর এই মারা যাওয়ার পেছনে অন্যতম যে কারনটি রয়েছ তা হচ্ছে, সঠিক ধরনের অংগের দুষ্প্রাপ্যতা।
আমাদের দেশে বিভিন্ন কারনে মানুষ অংগ প্রদানে নিরুৎসাহিত হয়। এর ভিতরে সাংস্কৃতিক, সামাজিক, ধর্মীয়, পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত কারন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শারীরিক কারনেও অনেক সময় একজনের অঙ্গের সাথে আর একজনের অঙ্গ ম্যাচিং হয়না।
যেমন, শিশুদের শরীরে হার্ট এবং লাংস ট্রান্সপ্লান্টেশনের ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়ষ্ক মানুষের শরীর থেকে সংগ্রহ করা হার্ট বা লাংস কাজ করবে না। কারন শিশুদের শরীর ছোট হওয়ার কারনে প্রাপ্তবয়ষ্ক মানুষের হার্ট বা লাংস তাদের বুকের ভিতর ধরবে না। আর তাই শিশুদের জন্য হার্ট, লাংস বা অন্য কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাওয়া অনেক কঠিন।
কোন কোন ক্ষেত্রে একটা মধ্যবর্তী অপারেশন (Bridge to Transplantation) করে রোগীকে বাঁচিয়ে রাখা হয় এবং সুবিধাজনক সময়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তাদের অংগ প্রতিস্থাপন করা হয়।
জেনোট্রান্সপ্লান্টেশনের ইতিহাসঃ
প্রাচীন গ্রীক এবং হিন্দু মাইথোলজীতে এ জাতীয় ট্রান্সপ্লান্টেশনের উল্লেখ থাকলেও বাস্তব ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ করা হয় ১৯৬৩ সালে। সে সময় নিউইয়র্ক শহরে প্রথম শূকরের কিডনী একটি শিশুর শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়। প্রতিস্থাপিত কিডনীটি শিশুটি মারা যাবার আগ পর্যন্ত কার্যক্ষম ছিল। কিডনী প্রতিস্থাপনের ৯ মাস পরে শিশুটির মৃত্যূ হয় তবে তার মৃত্যুর কারন ছিলো অন্য।
এর পুর্বে ১৯০৫ সালে খরগোশের কিডনীর কিছু অংশ নিয়ে একটি শিশুর শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়, এরপর বেবুনের হার্ট মানুষের শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয় ১৯৮৪ সালে। তবে রক্তের গ্রুপের মিল না থাকায় হার্ট প্রতিস্থপনের ২১ দিন পরে রোগীটি মারা যায়।
এই পদক্ষেপগুলো ধরা যায় একরকম অসফলই ছিলো, তবে এর থেকে বিজ্ঞানিদের প্রাপ্তিও খুব একটা কম নয়। এই অসফল পদক্ষেপগুলো থেকে বিজ্ঞানিরা জেনোট্রান্সপ্লান্টেশনের প্রধান বাঁধাগুলো সম্পর্কে ধারণা পেয়েছেন এবং সেগুলো দুর করার জন্য যে সকল পদক্ষেপগুলো নেওয়া দরাকার তা নিয়েছেন। যার ফলাফল চিকিৎসাবিজ্ঞান তথা সাধারণ মানুষ এখন পাচ্ছে।
ট্রান্সপ্লান্টেশনের প্রকারভেদঃ
বিভিন্ন ধরনের ট্রান্সপ্লান্টেশন পদ্ধতি রয়েছে যেগুলোকে মোটাদাগে তিনভাগে ভাগ করা হয়। এই তিনভাগেরই একটি জেনোট্রান্সপ্লানটেশন। আসুন জেনে নেওয়া যাক ট্রান্সপ্লানটেশনের পদ্ধতিগুলো সম্পর্কে।
- অটোলোগাস ট্রান্সপ্লান্টেশন (Autologous Transplantation)– নিজের শরীর থেকে যখন কোন অংগ প্রত্যঙ্গ নিয়ে নিজের শরীরেই স্থাপন করা হয় তখন তাকে আটোলোগাস ট্রান্সপ্লান্টেশন বলে। যেমন, চামড়া, বিভিন্ন ধরনের কম্পোজিট ফ্ল্যাপ, হার্টের ভাল্ভ (Ross procedure) ইত্যাদি। আবার শরীরের কোন কোন অংশ সংরক্ষন করে রেখে পরবর্তীতে আবার নিজের শরীরেই সেটা প্রতিস্থাপন করা যায়।
- আলোজেনেয়িক ট্রান্সপ্লান্ট (Allogeneic Transplant)– একজন মানুষের শরীর থেকে আর একজন মানুষের শরীরে যখন কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ট্রান্সপ্লান্ট করা হয় তাকে আলোজেনেয়িক ট্রান্সপ্লানট বলে। আবার একই জেনেটিক প্রকৃতিসম্পন্ন অর্থাৎ জমজ বাচ্চাদের ভিতর ট্রান্সপ্লান্ট হলে তাকে সিনজেনেয়িক আলোজেনেয়িক ট্রান্সপ্লান্ট (Syngeneic Allogenic Transplant) বলা হয়।
- জেনোট্রান্সপ্লান্টেশন (Xenotransplantation)– যখন মানুষ ব্যতীত অন্য কোন প্রাণীর শরীর থকে অংগ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে মানুষের শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়, তখন তাকে জেনোট্রান্সপ্লান্টেশন বলে।
জেনোট্রান্সপ্লান্টেশনের বাধাগুলো কি কি এবং তা দূর করার উপায়ঃ
প্রকৃতিগত নিয়মেই একটা প্রানী থেকে অন্য প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য থাকে। ফাইলোজেনেটিকালি (Phylogenetically) এরা যত কাছের হবে (Concordant) ততো রিজেকশন বা পরিবর্জনের সম্ভাবনা কম হবে। আর ফাইলোজেনেটিকালি যত দুরের হবে (Discordant) পরিবর্জনের সম্ভাবনা ততো বেশি হবে।
ইমিউন প্রক্রিয়া প্রকৃতিগতভাবে অন্য প্রাণী থেকে আসা এন্টিজেনগুলিকে পরিবর্জন করে। এগুলোর ভিতরে রক্তের গ্রুপের এন্টিজেন, কোষের প্রাচীরে লেগে থাকা আলফা-গ্যাল (Alpha Gal Epitope) এপিটোপ প্রধান। এই এন্টিজেনগুলিকে গ্রহীতার শরীরে অবস্থিত জেনোরিয়াক্টিভ ন্যাচারাল এন্টিবডি (Xenoreactive Natural Antibody, XNA) কমপ্লিমেন্ট সিস্টেম চিহ্নিত করে ধ্বংস করে ফেলে।
এখন যদি একই রক্তের গ্রুপের Donor এবং Recipient হয়, বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যদি আলফা গ্যাল এপিটোপ তৈরি না হতে দেওয়া হয়, কমপ্লিমেন্টগুলিকে গ্রহীতার প্লাজমা পরিষ্কার করে (Plasmapheresis) কমিয়ে দেওয়া হয় তাহলে জেনোট্রান্সপ্লান্টেশন হয়ত সফল হতে পারে।
কিন্তু এই প্রক্রিয়া সাময়িকভাবে সফল হলেও গ্রহীতার শরীরে একটা দীর্ঘস্থায়ী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। গ্রহীতার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা একেবারেই নষ্ট হয়ে যায়। তাছাড়া এই প্রক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদী কোন সমাধানও দিতে পারে না।
গ্রহীতার শরীরে প্রদত্ত অঙ্গ যেমন কিডনী, লিভার ইত্যাদির সাথে যদি বোন ম্যারো, থাইমাস গ্ল্যান্ড ইত্যাদি প্রতিস্থাপন করা যায়, তাহলে সংবেদনশীল কোষগুলি যেমন T-Lymphocyte, এন্টিবডি উৎপাদনকারী B-Lymphocyte তৈরী হতে পারবে না, এবং প্রতিস্থাপিত কোষগুলিও ধ্বংস হবেনা।
কারন গ্রহীতার শরীরে এই কোষগুলি উৎপাদিত হলেও প্রতিস্থাপিত থাইমাস গ্ল্যান্ড অথবা বোন ম্যারো এগুলোকে ফরেন (Foreign) বা অপরের বলে চিহ্নিত করবে এবং এইসব প্রতিক্রিয়াশীল কোষগুলিকে ধ্বংস করে দেবে যার ফলে গ্রাফট রিজেকশন হতে পারবে না। কিন্তু এই সকল প্রক্রিয়া পুরো ট্রান্সপ্লান্টেশন পদ্ধতিটিকেই আরও জটিল করে তোলে।
অপেক্ষাকৃত সহজ এবং ফলপ্রসূ পদ্ধতি হচ্ছে জীন নক-আউট (Gene knock-out and Gene knock-in) পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে অন্য প্রানীর ভ্রুণ থেকে বিভেদকারী জীনকে অপসারন করে মানুষের জীন দিয়ে তাকে প্রতিস্থাপিত করা হয়।
পরবর্তীতে প্রাণীটি বড় হওয়ার পর তার শরীর থেকে কিডনী, হৃদপিন্ড ইত্যাদি নিয়ে মানুষের শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়। এতে রিজেকশনের সম্ভাবনা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়, আর বাকী পরিবর্জন সম্ভাবনাটুকু বিভিন্ন ঔষধ প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিহত করা হয়।
এই পদ্ধতি কার্যকর প্রমানিত হলে অংগ প্রতিস্থাপন অনেক সহজসাধ্য এবং সহজলভ্য হয়ে আসবে। আর আশার কথা হচ্ছে যে, এই পদ্ধতিতে ট্রান্সপ্লান্টেশন ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে, যার তথ্য আমরা প্রবন্ধের শুরুতেই আপনাদের জানিয়েছি।
জেনোট্রান্সপ্লান্টেশনের অন্যান্য সমস্যাঃ
আশার কথা যেমন রয়েছে ঠিক তেমনই জেনোট্রান্সপ্লান্টেশনের রয়েছে কিছু সমস্য। তার মধ্যে বড় যে সমস্যা তা হচ্ছে এইসব প্রাণী থেকে ভাইরাস বা অন্যান্য জীবানুঘটিত রোগ মানবদেহে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা। কারন, ফাইলোজেনেটিকালি প্রাণীগুলি যত কাছাকাছি হবে, এইসব জুওনোটিক রোগ (Zoonotic disease) ছড়ানোর সম্ভাবনাও ঠিক ততটাই বেশি হবে।
উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, শূকরের তুলনায় শিম্পানজী থেকে মানুষের শরীরে জুওনোটিক রোগ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা অনেক বেশী। আর তাই জেনোট্রান্সপ্লানটেশনের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র সাইজই বিবেচ্য বিষয় নয়, জুওনোটিক রোগ যাতে না ছড়িয়ে পড়তে পারে সে বিষয়টিকেও গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়।
তাছাড়া শূকর অল্পদিনের ভিতরে পুর্নবয়ষ্ক হয় এবং এদেরকে জীবাণুমুক্ত পরিবেশে কম খরচে বড় করে তোলা যায়। আর এই কারনগুলোর জন্যই জেনোট্রান্সপ্লানটেশনের জন্য শূকরকেই বেছে নেওয়া হয়।
জেনোট্রান্সপ্লানটেশন যেহেতু শূকরের থেকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে করা হয়, এ ক্ষেত্রে আমাদের দেশে ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে চিন্তা করে হয়তো অনেকে নিরুৎসাহিত হতে পারেন। তবে যেহেতু এই প্রাণীটিকে শুধুমাত্র মানুষের প্রাণ বাচাতে বা চিকিৎসা কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে তাই এখানে ধর্মীয় দৃষ্টিকোন আশা করি কোন বাঁধার কারন হয়ে দাড়াবে না। তাছাড়া ইতোমধ্যেই, শূকরের হার্ট ভাল্ভকে মানুষের হার্টের ভাল্ভ হিসাবে প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে।
চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্পর্কিত আরো লেখাঃ |
---|
সিনথেটিক বায়োলজি (Synthetic Biology) আয়ু বৃদ্ধি ও অমরত্বের সন্ধানে বিজ্ঞান! আবিষ্কারের কাহিনী-কৃত্রিম হার্ট ভাল্ব |
উপসংহারঃ
যদিও এখন পর্যন্ত মস্তিষ্ক এবং স্পাইনাল কর্ডের মত স্পর্শকাতর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ট্রান্সপ্লান্টেশন করা সম্ভব হয়নি। এগুলো ছাড়া বর্তমান সময়ে প্রায় সমস্ত অঙ্গেরই ট্রান্সপ্লান্টেশন সম্ভব। চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে জেনোট্রান্সপ্লান্টেশন এখন চুড়ান্ত বাস্তবতা এবং ভবিষ্যত চিকিৎসা পদ্ধতি। এটা ধরে নেওয়া যায় যে, কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজন আর জেনোট্রান্সপ্লান্টেশন একই সাথে চলবে মানুষের কল্যানে এবং মানুষের প্রয়োজনে।