আমাদের দেশে গরমের সাথে সাথে বাড়তে থাকে এয়ার কন্ডিশনার (Air Conditioner) বা এসির চাহিদা। সময়ের সাথে সাথে গরম যেমন বাড়ছে তেমনই বাড়ছে এসির ব্যবহার। বর্তমান সময়ে একটু সামর্থ্য থাকলেই গরমে কেউই কষ্ট করতে চানানা, আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় হুট করে একদিন বাজার থেকে Air Conditioner কিনে বাড়ি ফিরছেন।
তাতেই কি সমাধান হলো গরমের? হ্যা সাময়িকভাবে গরমের হাত থেকে বাচা গেলো কিন্তু আপনার চাহিদা অনুযায়ী যদি এয়ার কন্ডিশনার ঠিকমত কিনতে না পারেন তবে এই যন্ত্রটিই হয়ে উঠতে পারে আপনার মথা ব্যাথার কারন। তাই যারা বাসা অথবা অফিসের জন্য এসি কেনার পরিকল্পনা করছেন তারা এই লেখাটি মনযোগ দিয়ে পড়লে আশা করি সঠিক সিন্ধান্ত নিতে পারবেন।
এয়ার কন্ডিশনার কিনতে যে বিষয়গুলো অবশ্যই গুরুত্ব দেবেন!
বাজারে যত কম্পানির এয়ার কন্ডিশনার রয়েছে আর তার যত অপশন, যে কেউ কিনতে গিয়ে কনফিউশনে পড়বেন এটা খুবই স্বাভাবিক। বিপণনের জন্য সব কোম্পানিই দাবি করে তার এয়ার কন্ডিশনার বাজারের সেরা। আর নিজেদের সেরা প্রমান করতে প্রতিনিয়ত তারা একের পরে এক যোগ করছে নতুন নতুন ফিচার, যেমন আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রন (Humidity Control), বাতাস বিশুদ্ধকরণ (Air purification) অথবা মশা তাড়ানোর মত সুবিধাগুলোও।
তো এয়ার কন্ডিশনার কিনতে গিয়ে কিছুটা হলেও ধাঁধার মধ্যে আপনাকে পড়তেই হবে। তবে এই গোলক ধাঁধা থেকে বার করার জন্য আমরা কিছুটা আপনাকে সাহায্য করতে পারি। আর সেই প্রয়াসে এই লেখাটি। তো আসুন জেনে নেওয়া যাক এয়ার কন্ডিশনার কিনতে আপনাকে কি কি বিষয়গুলো জানতে হবে।
এয়ার কন্ডিশনারের স্টার রেটিং
এয়ার কন্ডিশনার ব্যবহারে যে বিষয়টি প্রতি মাসে একবার করে ভাবাবে তা হচ্ছে, বিদ্যুৎ বিল, আপনাকে কেনার আগেই নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে যে, এসির জন্য বিদুৎ কতটা পুড়বে। এসি ব্যবহারের উপরে কতটুকু বিদুৎ পুড়ছে তার উপর নির্ভর করে Bureau of Energy Efficiency থেকে বাজারের সমস্ত এসিগুলেকে ১ থেকে ৫ পর্যন্ত স্টার রেটিং দেওয়া হয়।
বাজারের ফাইভ স্টার রেটিং প্রাপ্ত এয়ার কন্ডিশনার মানেই বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী। একই ক্যাপাসিটির (টনের) ও ব্র্যান্ডের এসির মধ্যে ফাইভ স্টার প্রাপ্ত এসির দাম তুলনামূলকভাবে বেশি হয়। আপাতদৃষ্টিতে ৫স্টার রেটিং এসির দাম বেশি পড়লেও যে পরিমান বিদুৎ সাশ্রয় করে আপনার প্রতি মাসের খরচ কমাবে তার পরিমানও কিন্তু কম নয়।
ঘরের মাপ অনুযায়ী ঠিক করুন কত টনের এসি কিনবেন
এবার আপনাকে ঘরের মাপ অনুযায়ি মিলিয়ে কত টন এসি প্রয়োজন হবে তা কিনতে হবে। কতটুকু ঘরের জন্য কত টন Air Conditioner প্রয়োজন হবে তারও একটা হিসাব আছে, আপনি যদি মনে করেন ’কিনতে যখন হবেই তখন একটা বড় Air Conditioner কিনেই ঘরে লাগাবো’ তাহলে ভুল ধারনা নিয়ে বসে আছেন। হিসেবটা এত সোজা নয়! আপনাকে অবশ্যই ঘরের মাপ অনুযায়ী AC কিনতে হবে নতুবা ঘর ঠিকমত ঠান্ডাই হবে না। আপনার ঘরের জন্য কত টনের AC প্রয়োজন হবে তা নিচের তালিকা থেকে মিলিয়ে নিন।
ঘরের মাপ (স্কয়ার ফিট) | এসির ক্যাপাসিটি (টন) |
০ থেকে ১২০ পর্যন্ত | ০.৭৫ টন |
১২১ থেকে ১৫০ পর্যন্ত | ০১ টন |
১৫১ থেকে ২৫০ পর্যন্ত | ১.৫ টন |
২৫১ থেকে ৪০০ পর্যন্ত | ২.৫ টন ও তার বেশি |
এয়ার কন্ডিশনারের ক্যাপাসিটি বা টন বিষয়টি কি?
এয়ার কন্ডিশনার এর ক্যাপাসিটিকে বাংলায় আমরা বলে থাকি ১ টন, ১.৫ টন বা ২ টন। কিন্তু সকলের মধ্যে এাকটি কৌতুহল থেকে যায় যে, এই ’টন’ বিষয়টি কি বা এয়ারকন্ডিশনারের সাথে কিভাবে এটা সম্পর্কিত। ঘরের তাপ, বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা, এবং তাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রকাশ করতে এখানে টন বা Tonnage শব্দটি ব্যবহার করা হয়। সহজভাবে বলতে গেলে, এয়ার কন্ডিশনার যন্ত্র একটি ঘর থেকে প্রতি ঘন্টায় কি পরিমাণ তাপ অপসারন করতে পারবে তা নির্দেশিত হয় টন (Tonnage) হিসাবে। সাধারণ হিসাব অনুযায়ী একটি ১ টনের এয়ার কন্ডিশনার যন্ত্র প্রতি ঘন্টায় ১২,০০০ BTU (British thermal unit) তাপ ঘর থেকে অপসারন করতে পারবে।
স্প্লিট না উইন্ডো! কোন টাইপের এয়ার কন্ডিশনার কিনবেন?
স্প্লিট বা উইন্ডো, দুধরনের এসিতেই বিদ্যুৎ খরচ কমবেশি প্রায় সমান। তবে সময় এখন স্প্লিটের! উইন্ডো টাইপের জায়গাগুলো ধীরে ধীরে দখল হয়ে যাচ্ছে স্প্লিটে! যদিও উইন্ডো টাইপ এসির দাম কম তবে সমস্যাও রয়েছে কিছু যেমন, এটা জানালা জুড়ে বসে থাকে, এসির হাওয়া গোটা ঘরে ছড়াতে সময় লাগে। আওয়াজ একটু বেশি হয় ফলে ঘুমাতে সমস্যা হতে পারে বা কখনো এসি থেকে ছিটকে বার হতে পরে পানি বা বরফ।
আর স্প্লিট AC সবদিক থেকে ঠিক থাকলেও যাঁরা ভাড়া বাড়িতে থাকেন বা ঘনঘন বাসা পারিবর্তন করেন তাদের জন্য উইনডো টাইপ AC ভাল কারণ স্প্লিট এসির ইনস্টলেশন ও খরচ উইনডো এসির থেকে সহজ হলেও এর রি-ইনস্টলেশন চার্জ অপেক্ষাকৃত বেশি। তবে পরামর্শ থাকবে ঘর যদি বড় হয় তবে অবশ্যই স্প্লিট এসি কিনুন।
ইনভার্টার প্রযুক্তির বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী এসি কিনুন
বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী হওয়ার কারনে বর্তমান সময়ে Inverter Air Conditioner খুব বেশি ব্যবহার হচ্ছে। সাধারণ এয়ার কন্ডিশনারের কম্প্রেশার সব সময়ের জন্য চালু থাকে এবং রুম পর্যাপ্ত ঠাণ্ডা হলে তখন কম্প্রেশার থেমে যায়। অর্থাৎ একটি সাধারণ প্রযুক্তির এয়ার কন্ডিশনার অন এবং অফ হওয়ার মাধ্যমে রুমের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।
অন্যদিকে Inverter টেকনোলজির Air Conditioner চালূ হওয়ার সময়ে সম্পুর্ণ শক্তি খরচ করে রুমকে ঠান্ডা করে এবং পরে শক্তি খরচ কমিয়ে এনে প্রয়োজন মত রুমের তাপমাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করে। ইনভার্টার প্রযুত্তির এসি এভাবে কম শক্তিতে চলার কারণে বিদুৎ সাশ্রয় করে আপনার খরচ বাচায়।
এয়ার কন্ডিশনার ইন্সটলেশন
সিঙ্গেল ইউনিট হাওয়াতে উইন্ডো এসিতে জায়গা লাগে অনেক কম। অপরদিকে স্প্লিট এসি তে দুটো ইউনিট যার একটি থাকে ঘরের ভেতরে আর একটি থাকে ঘরের বাইরে। ফলে সাধারণ এসি থেকে স্পিলিট এসতে অনেক বেশি জায়গার প্রয়োজন হয়। তাছাড়া স্প্লিট এসি ইন্সটলেশনের উপরে নির্ভর করবে আপনার বিদুৎ খরচ।
আপনি যদি এসির কমপ্রেসর ইউনিট সারাদিন রোদ পড়ে এমন জায়গাতে রাখেন বা কোন একটি বদ্ধ জায়গাতে রাখেন যেখানে বাতাস আসতে পারেনা, সেক্ষেত্রে কমপ্রেশারকে বেশি পরিশ্রম করতে হবে রুম ঠান্ডা করতে ফলে বিদ্যুত খরচ হবে কয়েকগুন বেশি এবং বাড়াবে বিদ্যুতের বিল।
এসি সার্ভিসিং ও রক্ষানাবেক্ষন
স্প্লিট এয়ার কন্ডিশনার কমপ্রেসর ইউনিটের জন্য প্রয়োজন বাড়তি সাবধানতা, বিশেষ করে কমপ্রেসর ইউনিটে যে কোন অস্বাভাবিক কিছু লক্ষ করলে সাথে সাথে সার্ভিসের লোকের সাথে যোগাযোগ করে পরিক্ষা করিয়ে নিন। তাছাড়া একটি নিদৃষ্ট সময় অন্তর অন্তর আপনার ব্যবহৃত Air Conditioner টি সার্ভিসিং করিয়ে নিন নতুবা ঘটতে পারে অগ্নিকান্ডের মত অনাকাংখিত দুর্ঘটনাও। তাছাড়া শীতকালে অধিকাংশ এসি বন্ধ থাকে তাই ধুলাময়লা জমাটা স্বাভাবিক তাই গরমের শুরুতেই একবার এসি সার্ভিসিং করিয়ে নিন।
আফটার সেলস সার্ভিস
যে কোনও বৈদ্যুতিক পণ্যের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় আফটার সেলস সার্ভিস বা বিক্রয় পরবর্তী সেবা। আর Air Conditioner এর ক্ষেত্রে এই বিক্রয় পরবর্তী সেবাটি আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই AC কেনার আগেই আপনার এলকায় খোজ করুন পছন্দের ব্র্যান্ডের আফটার সেলস সার্ভিস কতটা রেসপন্সিভ আর খরচ কেমন। প্রতিটি কম্পানি থেকেই একটি নিদৃষ্ঠ সময় পর্যন্ত বিক্রয়োত্তর সেবা প্রদান করে থাকে তবে জানার বিষয় হলো কোন কম্পানিটি বেশি দ্রুত সার্ভিস প্রদান করে।
অন্যান্য ফিচার
লাইফস্টাইলকে আরো সহজ ও আরমদায়ক করতে বিভিন্ন কোম্পানীগুলো তাদের বাজারজাত করা Air Conditioner এর সাথে প্রতিনিয়ত যুক্ত করছে নতুন নতুন ফিচার। এমনই কিছু ফিচার আপনার পছন্দের এয়ার কন্ডিশনারের সাথে আছে কিনা দেখে নিন।
ডিহিউমিডিফিকেশন
বাতাসের আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ করে ঘরের পরিবেশকে আরও আরামদায়ক করতে ডিহিউমিডিফিকেশন ফিচারটি গুরুত্বপূর্ন। এসি ক্রয়ের আগে অবশ্যই এই ফিচারটি আছে কিনা দেখে নিন।
সাউন্ড
ঘর বা অফিসকে ঠান্ডা করতে আপনার এয়ার কন্ডিশনারটি যদি অযথা শব্দ তৈরি করে তবে তা খুবই বিরক্তিকর একটা বিষয় হবে। তাই কেনার আগে দেখে নিন যন্ত্রটি অযথা বিরক্তিকর শব্দ তৈরি করে কিনা।
স্লিপ মোড
রাত্রে ঘুমের মধ্যে রুম অতিরিক্ত ঠান্ডা হওয়া একটি বিরক্তিকর বিষয়। ফলে আপনার অসুস্থ হওয়ারও সম্ভাবনা থেকে যায়। এই অনাকাংখিত বিষয়টি থেকে বাচতে আপনার এসিতে স্লিপ মোড ফিচারটি থাকা চাই।
অটো পাওয়ার অন
লোড শেডিং বা যে কেন ধরনের বিদ্যুৎ বিভ্রাট হতেই পারে সেক্ষেত্রে পুনরায় এসি চালাতে আপনাকে ঘুম থেকেই যদি উঠতে হয় তাহলে বিষয়টি হবে খুব বিরক্তির! তাই এসি কেনার সময় নিশ্চিত হয়ে নিন অটো পাওয়ার অন অপশনটি/ফিচারটি এসরি সাথে যুক্ত আছে কিনা। বিদ্যুৎ বিভ্রাটের পরে আবার বিদুৎ আসলে এই ফিচারটি আপনার এসিকে পুনরায় নিজে নিজে স্টার্ট হতে সাহায্য করবে।
ব্রান্ড অনুযায়ী বাজারে Air Conditioner -এর দাম
বর্তমানে ২৫ হাজার টাকা থেকে ৩০ হাজার টাকায় মিলবে একটি ১ টন ক্যাপাসিটির সাধারণ এসি আর ১.৫ টন এসির দাম শুরু হয়েছে ৩৫ হাজার টাকা থেকে। আর এই সাধারণ এসির দাম বেড়ে যাবে প্রতি স্টার রেটিংয়ে ২,৫০০ টাকা করে। আর যদি আপনি সাধারণ মানের একটি ইনভার্টার এসি কিনতে চান সেক্ষেত্রে খরচ করতে হবে সাধরণ এসি থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি।
বর্তমানে বাজারে আমাদের দেশী ব্রান্ডের পাশাপাশি রয়েছে অনেক আন্তর্জাতিক ব্রান্ডের এসি। যার মধ্যে GENERAL, PANASONIC, LG, SONY, SINGER, CARRIER, SHARP, GREE,এবং WHIRLPOOL উল্লেখযোগ্য আর দেশী ব্র্যান্ডের মধ্যে রয়েছে WLLTON, MYONE এর মত কম্পানিগুলো।
কোথায় পাবেন ভাল মানের এয়ার কন্ডিশনার?
সারা দেশেই এখন সাধরণ ব্রান্ডের এয়ার কন্ডিশনারগুলো পাওয়া যায়। বিশেষ করে জেলা শহর ও কিছু বড় থানা-শহরে মিলবে ওয়ালটন বা মাই ওয়ানের মত ব্রান্ডের এয়ার কন্ডিশনারগুলো।
আর বিশ্বমানের ব্রান্ডগুলো থেকে এয়ার কন্ডিশনার কিনতে হলে আপনাকে খোজ করতে হবে সংশ্লিষ্ঠ ব্রান্ডের আউটেলেট অথবা বড় ইলেকট্রনিক্স পন্যের দোকানে। যেগুলো মিলবে দেশের সকল বিভাগীয় শহর ও ঢাকার স্টেডিয়াম মার্কেট, বাইতুল মোকাররম মার্কেট, বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্স এর মত মার্কেটগুলোতে।
এছাড়াও আপনি দেশের যে কোন প্রান্ত থেকে যে কোন ব্রান্ডের এয়ার কন্ডিশনারের দাম যাচাই সহ কোথায় পাওয়া যায় তা দেখে নিতে পারবেন বিডিস্টল.কম অনলাইন মার্কেটপ্লেস থেকে।
শেষকথা
আশা করি এই ছোট পরিসরে লেখাটি আপনার এয়ার কন্ডিশনার কেনার অভিজ্ঞতাটিকে কিছুটা হলেও সুখকর করবে। এই অস্বস্তিকর গরমে এয়ার কন্ডিশনারের শীতলতায় ভাল ও স্বস্তিতে কাটুক আপনার অবসর এবং কর্মব্যস্ত সময়টুকু।
আরো পড়তে পারেনঃ অনলাইন শপিং; যে বিষয়গুলো জানা জরুরী।