গর্ভধারন প্রক্রিয়াটি একজন নারীর জীবনে পরিপূর্ণতা নিয়ে আসে, কিন্তু কখনও কখনও জটিলতার কারনে গর্ভধারণ প্রক্রিয়াটি নীরবে একজন নারীর জন্য জীবন সংশয়ের কারন হয়ে দাড়ায়। একটোপিক প্রেগনেন্সি (Ectopic pregnancy) বা টিউবাল প্রেগনেন্সি যা নারীর জীবনে গর্ভধারণ সংক্রান্ত একটি গুরুত্বর জটিলতা।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী একটোপিক প্রেগনেন্সি ঘটনা প্রতি ১০০০ জনে ১১ জন। এই অস্বাভাবিক প্রেগনেন্সি একদিকে যেমন বিরল আবার ঠিক একই সাথে অত্যন্ত বিপদজনক। সঠিক সময়ে চিহ্নিত করে সঠিক চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব না হলে ঘটে যেতে পারে প্রানহানির মত ঘটনা।
একটোপিক প্রেগনেন্সি (Ectopic Pregnancy) কি?
স্বাভাবিক ঋতুচক্রের (Menstruation) ফলে ডিম্বাশয় (Overy) থেকে প্রতি মাসে একবার ডিম্বানু ১২ থেকে ২৪ ঘন্টার জন্য ফ্যালোপিয়ান টিউবে (fallopian tube) এসে অবস্থান করে এই সময়ের মধ্যে ডিম্বানু শুক্রাণু (Sperm) দ্বারা নিষিক্ত হলে ভ্রূণ (Zygote) সৃষ্টি হয়। এর পর ভ্রূণটি ক্রমাগত বিভক্ত হতে হতে পরিস্ফুটনের মাধ্যমে পরবর্তি ৬ থেকে ১০ দিনের মধ্যে জরায়ুতে (womb) এসে প্রতিস্থাপিত হয় এবং ধিরে ধিরে বড় হতে থাকে। যা গর্ভধারণ প্রক্রিয়ার একটি স্বাভাবিক অংশ।
এখন যদি কোনো জটিলতার কারনে ভ্রূণটি জরায়ুতে প্রতিস্থাপিত না হয়ে অন্য কোথাও প্রতিস্থাপিত হয়ে বেড়ে উঠতে থাকে তাকে বলা হয় একটোপিক প্রেগনেন্সি। সাধারনত একটোপিক প্রেগনেন্সির ৯০ ভাগ ক্ষেত্রেই ভ্রূণ ফ্যালোপিয়ান টিউবেই প্রতিস্থাপিত হয়ে থাকে। তবে এটি ফ্যালোপিয়ান টিউব ছাড়াও ডিম্বাশয়, সারভিক্স বা পেটের ভিতরস্থ যেকোনো স্থানে বেড়ে উঠতে পারে।
ভ্রূণ যখন ফেলোপিয়ান টিউবে প্রতিস্থাপিত হয়ে যায় তখন থেকেই জটিলতার ঠিক শুরু। কারণ বাড়ন্ত ভ্রূণকে ধারন করার পর্যাপ্ত জায়গা এবং প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবারহ করার মতো ব্যাবস্থা ফেলোপিয়ান টিউবে নাই যা আছে শুধুমাত্র জরায়ুতে। ফলে ভ্রূণকে ধারণ করতে না পেরে ফেলোপিয়ান টিউব ফেঁটে তীব্র ব্যাথাসহ প্রচুর রক্তক্ষরণে মায়ের মৃত্যূ পর্যন্ত ঘটতে পারে।
একটোপিক প্রেগনেন্সির কারন
- ইতোমধ্যে যাদের একবার একটোপিক প্রেগনেন্সি হয়েছে তাদের বাবারও আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা ১০ গুন বেড়ে যায়।
- কোনো সংক্রমণ, প্রদাহ অথবা যে কোন কারনে ফ্যালোপিয়ান টিউব যদি আংশিক অথবা পুরোপুরিভাবে বন্ধ হয়ে যায়।
- ফ্যালোপিয়ান টিউব অথবা পেলভিক এরিয়াতে যদি আগে কোনো অপারেশান করা হয়ে থাকে তবে একটোপিক প্রেগনেন্সি হবার সম্ভাবনা থেকে যায়।
- ফ্যালোপিয়ান টিউব এর আকার জন্মগতভাবে স্বাভাবিক এর চেয়ে ছোট হয়ে থাকলে টিউবাল প্রেগন্যান্সি হবার আশংকা থাকে।
- টেস্ট টিউব বেবি নেবার ক্ষেত্রে অথবা ফার্টিলিটি বৃদ্ধির ঔষধ খেলে একটোপিক প্রেগনেন্সি হবার সম্ভাবনা থাকে।
- গর্ভধারণের সময় কপার-টি পরা অবস্থায় থাকলে একটোপিক প্রেগনেন্সি হতে পরে।
- যাদি পেলভিক ইনফ্ল্যামেটরি ডিজিজ বা PID থাকে তবে একটোপিক প্রেগনেন্সির সম্ভাবনা বেড়ে যেতে পারে।
- যৌনবাহিত রোগ যেমন, গনোরিয়া তে আক্রান্ত হলে একটোপিক প্রেগনেন্সি হবার সম্ভাবনা রয়েছে।
- ইমারজেন্সি কন্ট্রাসেপটিভ ব্যবহারের ফলে একটোপিক প্রেগনেন্সির সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।
একটোপিক প্রেগনেন্সির লক্ষণ
একটোপিক প্রেগনেন্সিতে রাপচার বা ডিম্বনালী ফেটে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তেমন উল্লেখযোগ্য কোন লক্ষণ প্রাকাশ পায় না, যার কারনে এই গর্ভাবস্থা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটু বেশি বিপজ্জনক। গর্ভধারণের লক্ষণ বোঝার আগেই অর্থাৎ ১ম পিরিয়ড মিস হবার কয়েকদিনের মধ্যে ব্যথা শুরু হলে অনেকে এপেন্ডিসাইটিস বা গ্যাস্ট্রিক সমস্যা মনে করে চিকিৎসা নিতে দেরি করে ফেলেন। তবে ডিম্বনালী রাপচার বা ডিম্বনালী ফেটে যাবার আগে কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায়। যেমনঃ
- রক্তক্ষরণ শুরু হতে পারে যা কিছুটা নিয়মিত পিরিয়ড এর মত তবে তা কম বা বেশি হতে পারে।
- তলপেট এবং পেলভিক এরিয়া তে প্রচন্ড ব্যাথা শুরু হতে পারে।
- ঘাড় এবং কাঁধেও ব্যথা অনুভুত হতে পারে।
- শরীর খুব দুর্বল এবং মাথা ঝিমঝিম করতে পারে।
- পেটের ভিতর রক্তক্ষরণের ফলে ব্লাড প্রেশার কমে যাবে।
- পালস বেড়ে যেতে পারে।
একটোপিক প্রেগনেন্সি নির্ণয়

স্বাভাবিক প্রেগনেন্সি নির্নয়ের জন্য রক্ত (blood) বা প্রস্রাব (urin) টেস্ট এবং আল্ট্রাসনোগ্রাম-ই যথেষ্ট। তবে একটোপিক প্রেগনেন্সির শনাক্তে রোগীর তলপেট, পেলভিক এরিয়া ভালভাবে পরীক্ষা করার প্রয়োজন হয়। সাথে জরায়ু তে কোনো ভ্রূণ বেড়ে উঠছে কিনা বা ভ্রূণের উপস্থিতি আছে কিনা পরিক্ষা করে দেখার প্রয়োজন হয়। hCG হরমোন এর মাত্রা ও পরীক্ষা করার প্রয়োজন হয় কারন, সাধারনন একটোপিক প্রেগনেন্সিতে hCG এর মাত্রা স্বাভাবিক এর থেকে কম হয়। এছাড়া রক্তে প্রজেস্টেরনের মাত্রা পরীক্ষা করেও একটোপিক প্রেগন্যান্সি চিহ্নত করা যেতে পারে।
মেডিকেল ইমেজিং বিষয়ে জানতে পড়ুনঃ রোগ নির্ণয়ে মেডিকেল ইমেজিং
একটোপিক প্রেগনেন্সি; চিকিৎসা ও করণীয়

যাদের ইতোপুর্বে একটোপিক প্রেগনেন্সির ইতিহাস আছে, বিবাহিত মহিলা যাদের অনিয়মিত পিরিয়ড হয়, দীর্ঘদিন যাবত বানধ্যত্বের চিকিৎসা নিচ্ছেন বা উপরে উল্লেখিত একটোপিক প্রেগনেন্সির কোন কারন বিদ্যামান আছে তাদের হঠাৎ তলপেটে প্রচন্ড ব্যথা শুরু হওয়া মাত্রই ডাক্তারের শরনাপন্ন হওয়া উচিৎ।
আবার প্রেগনেন্ট হওয়ার পরে বাচ্চার অবস্থান জানতে প্রথম দুমাসের মধ্যে একটা Pregnancy Profile করতে হবে। কেননা ডায়গনোসিসে নিশ্চিত প্রমান মিললে Ectopic Pregnancey Sac Rupture হওয়ার আগেই অপারেশন না করেও শুধু ঔষধ প্রয়োগের মাধ্যমে চিকিৎসা শুরু করে রোগীর মৃত্য ঝুঁকি কমানো সম্ভব।
একটোপিক প্রেগনেন্সির চিকিৎসা নির্ভর করে রোগীর প্রেগনেন্সির অবস্থার উপর আর এই প্রেগনেন্সি অবস্থা জানতে প্রয়োজন HGC (হিউম্যান কোরিওনিক গোনাডোট্রপিন) হরমোনের মাত্রা নির্ধারণ, যা প্রেনেন্সি অবস্থায় শরীরে উৎপন্ন হয় এবং এই হরমনের সাহায্যে ভ্রূনের স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পরীক্ষা করা সম্ভব হয়।
প্রথম দিকে যদি একটোপিক অবস্থা নির্ণয় করা সম্ভব হয় তবে চিকিৎসক নিজস্ব তত্বাবধানে মেডিকেশনের মাধ্যমে চিকিৎসার ঝুকি গ্রহন করতে পারেন। সেক্ষেত্রে চিকিৎসক methotrexate ইনজেকশন সিঙ্গেল শট অথাবা প্রয়োজনে ডাবল শট দিতে পারেন। ১ম শট গ্রহন করার পরে পরবর্তী ৩দিন থেকে এক সপ্তাহের মধ্যে পুণরাই HCG টেষ্ট করে প্রয়োজন বোধে ২য় শট প্রদান করবেন।
অপরদিকে Ectopic Pregnancey Sac Rupture হলে অর্থাৎ ফ্যালোপিয়ান টিউব ফেটে গেলে বা পেটের মধ্যে রক্তক্ষরণ শুরু হলে ঔষধের মাধ্যমে আর চিকিৎসা সম্ভব হবেনা, সেক্ষেত্রে রোগীকে দ্রুত রক্ত দেয়ার পাশাপাশি অপারেশনের কোন বিকল্প থাকে না।
দুটি প্রক্রিয়াতে এই অপারেশনটি করা যায়,
- ১. পেট কেটে ও
- ২. ল্যাপারোস্কপির মাধ্যমে।
রোগীর জন্য অপারেশনের কোন পদ্ধতি প্রজোয্য হবে তা চিকিৎসা ব্যবস্থার পর্যাপ্ততা ও রোগীর অবস্থার উপর বিবেচনা করে চিকিৎসক সিন্ধান্ত নেবেন।
একটোপিক পরবর্তী পুনরায় গর্ভধারণ
অনেকের মনে প্রশ্ন থাকে যে, যাদের একবার একটোপিক প্রেগনেন্সি ধরা পরে তারা পরবির্তকালে স্বাভাবিকভাকে গর্ভধারন করতে পারেন কি না? সেক্ষেত্রে, যদি আপনার ফেলোপিয়ান টিউব স্বাভাবিকভাবে কাজ করে তবে আপনি অবশ্যই সন্তান ধারন করতে পারবেন।
একবার একটোপিক প্রেগনেন্সি (ectopic pregnancy) হওয়ার ঠিক কতদিন পরে আপনি আবার গর্ভধারণ করতে পারবেন তা আপনার ডাক্তারের কাছে থেকে জেনে নিন। তবে একটু বাড়তি সতর্কতা তো অবশ্যই পালন করতে হবে।
তবে মনে রাখবেন একবার একটোপিক হলে যেহেতু পরবর্তীতে আবারও হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় তাই সন্তান ধারনের প্রথম দিকেই পারিক্ষা করে আপনার গর্ভাবস্থা নিশ্চিত হয়ে নিন। তাই প্রশ্ন যখন একটোপিক প্রেগনেন্সি, প্রয়োজন একটু বাড়তি সতর্কতা! আপনার একটু বাড়তি সচেতনতাই আপনাকে এই অনাকাংখীত বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারে।